আশ্চর্য লাগছে, খুনের ঘটনার শিকার অনেক পরিবার বিচার চায় না। তারা পরিষ্কার করে বলেছে, কার কাছে বিচার চাইব!
Published : 02 Aug 2024, 10:21 AM
মানবাধিকার ও রাষ্ট্র
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যখন মাঠে নামল, রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজ নামল দমন-পীড়নে। একটি আন্দোলনকে দমনের যত উপায় আছে তার সবগুলোই ব্যবহার করা হলো। সরকারি হিসেবেই খুন হলো দেড় শতাধিক, দেশীয় গণমাধ্যম বলছে খুনের সংখ্যা প্রায় আড়াই শত, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হিসেবে সংখ্যাটা আরও বেশি। সংখ্যা যাই হোক, একটি খবরের কাগজ হিসেব করে দেখিয়েছে নিহতের বড় একটি অংশ শিক্ষার্থী। ১৫০ মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, নিহত ১১৩ জন কম বয়সী এবং শিক্ষার্থী ৪৫। ওই কাগজটিই ১৭৫ মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, নিহত ৭৮ শতাংশের শরীরে ছিল প্রাণঘাতী গুলির ক্ষত। যে প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না, প্রাণ কেড়ে নেওয়ার কোনো অধিকার তার নেই। রাষ্ট্র কারও প্রাণ দিতে পারে না। সুতরাং তা কেড়ে নেওয়ার কোনো অধিকার তার নেই। এটাই মানবাধিকারের মূল শিক্ষা। মানবাধিকার হলো পৃথিবীর সেরা ধর্ম। ধর্মের ক্রিয়ামূলে রয়েছে ধারণ, রক্ষা ও পালন। মানবাধিকারও তাই; রক্ষা, প্রগতি ও অঙ্গীকারের পূর্ণতা।
ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য মানবাধিকারের মূল ভিত্তি। মানবাধিকার ধারণা সকল মতাদর্শ ও ধর্মবিশ্বাসের উর্ধ্বে। কারণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য সর্বজনীনতা, যার নিচে সবাই আশ্রয় নিতে পারে।
যেকোনো মতাদর্শ ও ধর্মবিশ্বাস মূলত বিভক্তিমূলক, যা খণ্ডিত শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে। অন্যদিকে, মানবাধিকারের ধারণা অখণ্ডিত। মানবাধিকার জিতলে সবাই জিতে যায়, যেমন, মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, সাদা-কালো, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ এবং সবল ও অক্ষম। মানবাধিকার সবার জন্য, সবখানে, সমানভাবে। কারও জন্য কম কারও জন্য বেশি এমন নয়।
দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আজ ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। এ মুহূর্তে ব্যক্তি অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা বলে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রশ্নটি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টি এবং যেকোনো দল বা মতের নয়। বিষয়টিতে দেখতে হবে মানুষকেন্দ্রিকতায়। অথচ ওই উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি আমরা নির্মাণ করতে পারলাম না।
যেখানে ভয় থাকে, অভাব থাকে সেখানে মানবাধিকার থাকে না। আজ বাংলাদেশ ভয় ও অভাবের অভয়ারণ্য। সর্বোপরিসরে ভয় বিস্তৃত। ভয় দেখানো রাষ্ট্রের স্বভাব হয়ে দাঁড়াল। মনে রাখতে হবে কেউ ভয় না পেলে কাউকে ভয় দেখায় না। সরকার ভয় পাচ্ছে বলেই অন্যদের ভয় দেখাচ্ছে।
ভয় পূর্ণতা পাচ্ছে খুন, গ্রেফতার, মামলা, হামলা, হুমকি-ধমকির মধ্য দিয়ে। তবে রাষ্ট্রের তৎপরতা কেবল এর ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সার্ভেইল্যান্স চলছে। কেউ নিরাপদবোধ করছেন না। এক দমবন্ধ করার মতো পরিবেশ। মানুষ নির্মল বাতাস চায়। সুস্থ থাকতে চায়। চলমান সহিংসতা প্রতিটি নাগরিককে মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শিশু ও বয়স্করা আছেন অধিকতর খারাপ পরিস্থিতির ভেতর।
নজরদারির প্রসঙ্গে আসি। দেশের কমবেশি সকল নাগরিক আজ নজরদারির আওতায়। নজরদারি মানুষের জীবনে কী ভোগান্তি তৈরি করে তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাইতে আর কে ভালো উপলদ্ধি করেছেন?
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জাতির পিতার গতিবিধি পরিবীক্ষণের জন্য একটি ফাইল খুলেছিলেন যার নম্বর ছিল ৬০৬। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসকি সাত মার্চের ভাষণ প্রদানের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময় পাক গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ এড়াতে পথ পরিবর্তন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে রাষ্ট্রীয় নজরদারি যে কত বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেছিলে তা কি গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হয়েছে?
উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো বলেন, এখন নজরদারি কেবল ওভার স্ক্রিনিং-এর বিষয় নয় বরং আন্ডার স্ক্রিনিং-এর বিষয়ও বটে। প্রতিপক্ষের শরীর রসায়নও আজ নজরদারির বাইরে নয়। ব্যক্তির অনস্ক্রিন লাইফের কোনো মুহূর্তই নজরদারির বাইরে রাখার সুযোগ নেই। সবচেয়ে নিগৃহীত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধরন হলো নজরদারি।
অন্যদিকে, যোগাযোগের অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে, প্রতিটি ব্যক্তির মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে এবং কোনো রকমের বাধা ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো মাধ্যমে মতামত প্রকাশ, তথ্য জানা, সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (২) নম্বর অনুচ্ছেদে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে-
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়াও একাধিক আন্তর্জাতিক সনদে যোগাযোগের অধিকারের স্বীকৃতি মিলেছে। নাগরিকের যোগাযোগের অধিকার এক চরম সংকোচন পরিস্থিতির ভেতর পড়েছে। বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখার পর ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুলে দেওয়া হয়েছে। তা এখনও অবারিত নয় যদিও।
যাইহোক, মানবাধিকার রক্ষার মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের আবার রাষ্ট্রের দ্বারাই লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার। অর্থাৎ যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন তাদের কাছে ভুক্তভোগীদের প্রতিকার চাইতে হচ্ছে।
বছর দশেক আগে সাংবাদিকদের জন্য মানবাধিকার বিষয়ক প্রশিক্ষণে সাংবাদিক-প্রশিক্ষক মীর মাসরুরজামানের কাছে শোন একটি গল্প: রাম ও রাবণ বনবিহারে যাচ্ছিলেন। রামের পিপাসা পেলে তিনি একটা মাটির ডিবির ওপর হাতে থাকা ফলাটি গেঁথে পানি পানে গেলেন। ফিরে এসে যখন ফলাটি তুলছেন দেখলেন ফলার আগায় এক ফোঁটা রক্ত। রাম আহত হলেন। মাটি খুঁড়ে দেখা গেল একটি ব্যাঙ। রাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাড়া দেবে না! তাহলে তো ক্ষতিটি হতো না। ব্যাঙ প্রতিউত্তরে বলেছিল যখন আমরা কোনো বিপদের আশংকা করি তখন বলি ও রাম, রক্ষা করো। যেখানে স্বয়ং রাম যখন ফলা গাঁথছে তখন কার কাছে প্রতিকার চাইব।
আশ্চর্য লাগছে, খুনের ঘটনার শিকার অনেক পরিবার বিচার চায় না। তারা পরিষ্কার করে বলেছে, কার কাছে বিচার চাইব! নিপীড়ক রাষ্ট্রের চেয়ে ভয়ঙ্কর সত্তা আর কী হবে পারে?
মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক সনদ স্বাক্ষর করেছে। প্রতিশ্রুতি আছে মানবাধিকার সুরক্ষার। ওই দলিলগুলো নিস্ফলা প্রমাণ হচ্ছে।
খুনের লাল জামা
কবি পাবলো নেরুদার জীবনীকার মার্ক আইনার তার ‘নেরুদা এ বায়োগ্রাফি অব এ পোয়েট’-এ কবিকে উদ্ধৃত করে বলছেন, মানুষ একসঙ্গে অনেকের জীবনযাপন করে। অন্যের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জয়-পরাজয় তাকে প্রভাবিত করে। মানুষের অস্তিত্বজুড়ে রয়েছে জীবন ও জীবনহীন সত্তার উপস্থিতি। এ কারণে যখন কেউ আক্রান্ত হন তখন মূলত সবাই আক্রান্ত হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা খুন হয়েছেন তারা অনেকের রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় নন, পরিচিত-পরিজন নন কিন্তু খুন হওয়ার মানুষগুলোর জন্য তারা ব্যথা পাচ্ছেন। এ ব্যথা বা দুঃখবোধ আসছে মানুষ নামক সংযুক্তির কারণে। খুন হওয়া মানুষের ভেতর নিজেদের প্রতিস্থাপন করছেন। যোগাযোগের ভাষায় যাকে বলে এমপ্যাথেটিক ফিলিংস।
চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ তার বন্ধু তারেক শাহরিয়ারের স্মরণ সভায় মন্তব্য করেছিলেন, জীবন বিভক্ত করে, কিন্তু মৃত্যু এক করে। এসব অনাকাঙ্খিত খুন সংযোগের উপলক্ষ্য হয়ে উঠছে। কেউ যেন মনে না করেন, খুন হওয়া জনগণের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জীবন মূল্যবান। ভিন্ন মত, ভিন্ন দাবি, ভিন্ন পরিচয়ের জন্য কাউকে নিঃশেষ করা যায় না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি নায্য আন্দোলন। যেকোনো নায্য আন্দোলনের নৈতিকভিত্তি অনেক দৃঢ় হয়। হত্যা, হুমকি, মামলা, হামলা ও হয়রানি দিয়ে এ গতি রোধ করা যাবে না। কোনো গণআন্দোলন মখমলের চাদরের ওপর হয় না। হয় না কোনো ফুলবাগানে। তারা জেনে বুঝেই দাঁড়িয়েছে এক হৃদয়হীন কাঠামোর বিরুদ্ধে।
মানুষের পরিচয় হয়ে উঠছে খণ্ডিত, বিশ্বাস ও আদর্শভিত্তিক। মানুষকে টুকরো টুকরো করে বিবেচনা করা হচ্ছে। চলমান রাজনীতির মূল প্রবণতা ঘৃণা, ক্লেদ, প্রত্যাখান, দমন-পীড়ন।
ক্লেদাক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংযোগ আজও স্থাপিত হলো না। যাই হোক, শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমেছে। নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। দমন-পীড়ন চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ক্রমশ সুসংহত ও গতিশীল করছে। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে গড়ে উঠেছে বিশেষ ঐক্য। প্রথম পর্যায়ে আন্দোলনটি অনেকটা অরগানিক ছিল, নেতৃত্বের বিষয়টি অতটা স্পষ্ট না হলেও ক্রমশ তার একটি পরিকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত এ গণআন্দোলন পূর্ণাঙ্গতা পেলে তা হবে এক বিশেষ ব্যাপার।
প্রতিশ্রুত বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মুক্তি প্রশ্নে গণমানুষের ভেতর থেকে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কেবল এর ভেতরে রয়েছে আগামীর মুক্তি। এ ধরনের গণআন্দোলন ওইরকম উপলক্ষ তৈরি করে, আশা জাগায়। পরিশীলিত, প্রতিশ্রুতিশীল, উদ্ভাবনী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের কাছে উন্নত কোনো বিকল্প নেই। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস নিবিড়ভাবে পড়লে সেই বিষয়টি সহজে ধরা যায়।
গত ৩০ জুলাই ২০২৪, একটি জাতীয় দৈনিকে ইতিহাসবিদ দিপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন, “বাংলাদেশ শুধু এক বেদনাবিদ্ধ অঞ্চলমাত্র নয়, বাংলাদেশ একটি প্রতিশ্রুতির নামও বটে”। সেই প্রতিশ্রুতির বিজমন্ত্র লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে-সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও মানবিক মর্যাদায়। একটি জনকল্যাণমূলক, মানবিক মর্যাদা সম্পন্ন রাষ্ট্রের চাওয়া নিশ্চয় বিলাসী চাওয়া নয়।