ভবদহের মানুষের প্রতি এই জল-নিপীড়ন শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনার ফল নয়। মূল দায় হলো রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক ‘পদ্ধতি’ বা ‘কাঠামো’র। অর্থাৎ যত দিন না এই নিপীড়নমূলক কাঠামো ভাঙছে তত দিন ভবদহের জলাবদ্ধতা শেষ হবে না। ভবদহের মানুষের মানবাধিকারও সুরক্ষিত হবে না।
Published : 13 Oct 2024, 06:12 PM
নরওয়ের সমাজবিজ্ঞানী ইয়োহান গাল্টং সর্বপ্রথম ‘কাঠামোগত সহিংসতা’র ধারণা প্রদান করেন। পৃথিবীতে শান্তি অধ্যয়নের জনক বলে পরিচিত এই মানুষটি ১৯৬৯ সালে তার এক লেখায় প্রথম উল্লেখ করেন যে অধিকার বা মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু প্রত্যক্ষ সহিংসতার মাধ্যমেই হয় না সেটি কাঠামোগতভাবেও হতে পারে। এর প্রায় চার দশক পরে স্লোভেনিয়ার মার্ক্সবাদী দার্শনিক স্লাভয় জিজক ‘পদ্ধতিগত সহিংসতা’র ধারণা নিয়ে আসেন। সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে কাঠামোগত সহিংসতা পদ্ধতিগত সহিংসতা থেকে সামান্য আলাদা হলেও দুটি ধারণা একে অপরের পরিপূরক। অধিকার বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি ধারণা একে অপরের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কারণ পদ্ধতিগত যে কোনো ধরণের অধিকার লঙ্ঘন ধীরে ধীরে রাষ্ট্র বা সমাজে একটি বৈষম্যমূলক কাঠামো তৈরি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে সেই কাঠামো শোষণের বা বঞ্চনার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। পদ্ধতিগত বা কাঠামোগত যাই হোক না কেন এই ধরণের সহিংসতা এক ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার সংগঠক।
গত ৮ অক্টোবর (২০২৪) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত একটি সংবাদে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা যশোরের ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতাকে ‘পদ্ধতিগত মানবাধিকারের লঙ্ঘন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এক বিবৃতিতে কমিশন দাবি করেছে যে, “বছরের পর বছর ধরে মানবিক বিপর্যয় সংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়া বা সমস্যার সমাধান না করা পদ্ধতিগত মানবাধিকারের লঙ্ঘন”। ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার সামগ্রিক পরিস্থিতি যদি উপরোক্ত তত্ত্বের কাঠামোতে ফেলে বিবেচনা করা হয় তাহলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দাবির সঙ্গে সেটি সর্বাংশে মিলে যায়। সেক্ষেত্রে বলা যায় এটি কোনো সাধারণ বিবৃতি নয়। এটি ভবদহের জল-নিপীড়নের সত্যের উম্মোচন মাত্র। বহু দেরিতে হলেও অবশেষে সত্যটা স্বীকার করার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অন্তত একটা ধন্যবাদ পেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো এই পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় কার? কারণ ভবদহ জলাবদ্ধতার সঠিক ও টেকসই সমাধানের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি এই ধরণের পদ্ধতি বা কাঠামোগত মানবাধিকার লঙ্ঘন একদিনে তৈরি হয়নি। তাই এই অন্যায়ের টেকসই ও স্থায়ী সমাধানের জন্য এই নিপীড়নমূলক কাঠামো কিভাবে তৈরি হলো সেটা জানা জরুরি। এর পেছনের দায় ও দায়ী নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাঠামোগত বা পদ্ধতিগত নিপীড়নের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি অপ্রাকৃতিক। অর্থাৎ মানবসৃষ্ট বা ইচ্ছাকৃত আরোপিত একটি নিপীড়ন ব্যবস্থা। যে নিপীড়নের পেছনে স্থানিক বাস্তবতার চেয়ে অনিচ্ছা বা অনীহা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে লোনা পানির আগ্রাসন রোধে ১৯৬০-এর দশক ও তার পরবর্তী সময়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩৯টি পোল্ডার গঠন করা হয়। ১৯৬১ সালে ভবদহ অঞ্চলে পানি নিষ্কাশনের জন্য যে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয় তা ওই পোল্ডার প্রকল্পের অংশ। ভবদহ একদিকে যশোর জেলার মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগরসহ সদর উপজেলার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে ভবদহ অঞ্চল খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও সাতক্ষীরার কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। যা একদিকে মুক্তেশ্বরী-টেকা-হরি আর অন্যদিকে আপার-হরিহর-বুড়িভদ্রা নদীগুলো দিয়ে বেষ্টিত। এই অঞ্চলের প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত আছে আরও ৫২টিরও বেশি বিল। দুই লাখেরও বেশি কৃষক এখানকার কৃষিখাতের সঙ্গে সরাসরি নির্ভরশীল। লক্ষ্য ছিল লোনা পানি প্রবাহ রোধ করে এ অঞ্চলের কৃষকদের চাষাবাদে সাহায্য করা। কিন্তু দুই দশক পার না হতেই যথাযথ পরিকল্পনা ও পরিচর্যার অভাবে এই স্লুইস গেট একসময় অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে নদীগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পলি জমে এই অঞ্চলের নদী ও খাল-বিল ভরাট হয়ে যায়। এক সময় এই উপকারী প্রকল্পই হয়ে উঠে ভবদহের কৃষকের জন্য অভিশাপ। আশির দশকের শেষের দিকে ওই অঞ্চলে জলাবদ্ধতা একটি স্থায়ী রূপ নেয়। এই জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় সাড়ে ৫৩ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমির অর্ধেকেরও বেশি জমি ক্ষতিগ্রস্থ। এর সঙ্গে জড়িত শত শত গ্রামের লক্ষ লক্ষ জনগণ। প্রতি বছর বৃষ্টি হলেই খবরের শিরোনাম হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় এখানকার মানুষ।
সরকারি অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কারণে সংকট নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প আসলেও ভবদহের জলাবদ্ধতার কোনো সুরাহা হয়নি। বরং দিন দিন সংকট আরও গভীর ও জটিল রূপ নিয়েছে। এই মৃত ও কার্যত অবৈজ্ঞানিক প্রকল্প ভবদহের মানুষের জন্য এখন শাঁখের করাত। প্রকল্পের কারণে শুষ্ক মৌসুমে তৈরি হয় পানির সংকট আর বর্ষা মৌসুমে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। প্রথমদিকে শুষ্ক মৌসুমে কিছুটা পানি নেমে গেলেও কিছু কিছু এলাকায় সেটি স্থায়ী রূপ নিতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত বেশি পলি জমতে থাকে জলাবদ্ধতার স্থায়িত্বও তত বাড়তে থাকে। সেই হিসেবে আশির দশকের পর থেকে ওই জনপদের মানুষের জীবনে নতুন একটি বিশেষণ যুক্ত হয়। তাহলো ‘পানিবন্দী’। এটাই যেন ভবদহ অঞ্চলের মানুষের নতুন নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। অথচ এটি একটি সমধানযোগ্য সমস্যা। ২০১৯ সালে সরকারের ‘পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা’ (ওয়ারপো) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট’ একটি যৌথ গবেষণায় দেখায় যে ভবদহ অঞ্চলের পানির জলাবদ্ধতার জন্য প্রধানত হরি নদীর পলি দায়ী। হরি নদী ২৪ ও ২৫ নম্বর পোল্ডারের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত। ভবদহ অঞ্চল যেহেতু ২৪ ও ২৫ নম্বর পোল্ডারের মধ্যে অবস্থিত সেহেতু পলি নিষ্কাশনের অভাবে তৈরি হয়েছে এই জলাবদ্ধতা। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে মূল বক্তব্য হলো হরি নদী দিয়ে প্রবাহিত প্রাকৃতিক পলি অকেজো স্লুইস গেটে আটকে এই পোল্ডার এলাকায় মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী অঞ্চলের মানুষ স্থানীয়ভাবে প্রচলিত প্রাকৃতিক ‘টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট’ বা টিএরএম ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে আসছে। একসময় হরি নদীর প্রবাহ প্রাকৃতিক রাখার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলেও অবহেলার কারণে সেটাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। নিজের দেশের একটি নির্দিষ্ট জনপদের মানুষের প্রতি কেন এই অবজ্ঞা সেটির উত্তর খুঁজছিল এই অঞ্চলের মানুষ। আপাত দৃষ্টিতে কিছু উত্তর মিললেও এই দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক বৈষম্যের আসল রহস্য ছিল অজানা। আমার মনে হয় দেরিতে হলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সেই রহস্যের জ্বালামুখ উম্মোচন করেছে। ভবদহের মানুষের প্রতি এই জল-নিপীড়ন শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনার ফল নয়। মূল দায় হলো রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক ‘পদ্ধতি’ বা ‘কাঠামো’র। অর্থাৎ যত দিন না এই নিপীড়নমূলক কাঠামো ভাঙছে তত দিন ভবদহের জলাবদ্ধতা শেষ হবে না। ভবদহের মানুষের মানবাধিকারও সুরক্ষিত হবে না।
আমরা যদি বৈশ্বিক পদ্ধতি বা কাঠামোগত অধিকার বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে এই ধরনের বৈষম্যমূলক পদ্ধতি বা কাঠামো ঔপনিবেশিক শাসকদের সমাজব্যবস্থায় বেশি লক্ষ্যণীয়। যে সমাজে সভ্যতার আড়ালে এই ধরনের কাঠামোগত নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়। সেখানে স্পষ্টত দুটি দলের অবস্থান থাকে। একটি দল শক্তিশালী বা মূলধারার জনগোষ্ঠী এবং আরেকটি দল অপেক্ষাকৃত দুর্বল বা অবহেলিত জনগোষ্ঠী। সমাজে তাদের এই বিপরীতমুখী অবস্থার নির্ণায়ক হলো ক্ষমতা। অর্থাৎ ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি দল আরেকটি দলকে সমাজের সমধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখে। দুর্বল অংশের উপর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। এখন প্রশ্ন হলো ভবদহ তো কোনো উপনিবেশিক অঞ্চল নয়। ধরা যাক প্রকল্পটি যেহেতু পাকিস্তান আমলের সেহেতু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় এই সীমাহীন উদাসীনতা অনেকটা স্বভাবিক ছিল। কিন্তু এখন তো আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। তবুও কেন এখনও সেই একই উদাসীনতা। এখনও কেন সেখানে এই ধরণের ঔপনিবেশিক বঞ্চনার পদ্ধতি বিদ্যমান থাকবে? তবে আশার দিক হলো কাঠামোগত বা পদ্ধতিগত এই ধরণের নিপীড়নের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি নিরাময়যোগ্য। সমাধানযোগ্য। অর্থাৎ চাইলেই এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছা ও সচেতনতা। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা এবং জনগণের সচেতনতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের সচতনতা পূর্ণমাত্রায় থাকলেও রাষ্ট্রের সদিচ্ছা একদমই শূন্য। আর রাষ্ট্র যেহেতু একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তাই বলা যায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই টিকে আছে এই ‘পদ্ধতিগত মানাবাধিকার লঙ্ঘন’। তবে আশা করছি যে দীর্ঘ দিন পরে হলেও রাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান যেহেতু সত্যটা ধরতে পেরেছে সেহেতু এবার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নয় কাজের অগ্রগতি দেখতে পাবে ভবদহের মানুষ।
আরও পড়ুন:
ভবদহের সমস্যা মেটে না কেন? ব্যাখ্যা চায় মানবাধিকার কমিশন
যশোরে পানিবন্দি ২৮ গ্রাম, ভেসে গেছে ঘের-ফসল
ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও সমাধান