সরকারি আনুকূল্য পাওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীরা যদি অনবরত ডিগবাজি খেতে থাকেন, সত্যি কথা না বলে ‘সরকার-পছন্দ’ কথা বলেন, তাহলে সমাজ ও সমাজের জনগণের ক্ষতি হয়।
Published : 11 Mar 2024, 07:43 PM
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, আইনজীবী, বিচারক— সকলেই বুদ্ধিজীবী হলেও আমরা বুদ্ধিজীবী বলতে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, গবেষক ও চৌকস সাংবাদিকদের বুঝি। তারা দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করেন, নানা ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, মানুষের অধিকার ও সুশাসনের কথা বলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কবিতা ও সাহিত্য রচনা এবং গবেষণার কাজও চলতে থাকে। সেজন্য ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী সমাজে অনন্য আসন লাভ করেন এবং সামষ্টিকভাবে বুদ্ধিজীবীরা সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ বলে বিবেচিত হন।
কোনো দেশ ও সমাজের এগিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে পড়ার সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা যায়। এ কারণে বুদ্ধিজীবীদের মনে করা হয় সমাজের বাতিঘর। মানুষের প্রত্যাশা, বুদ্ধিজীবীরা হবেন নীতিনিষ্ঠ, সাহসী ও উচ্চকিত। কোনো বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে এটির ব্যত্যয় হলে, তিনি কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন। তাহলে বুদ্ধিজীবীরা কি কোনো সুবিধা, সরকারি, বেসরকারি বা বিদেশি আনুকূল্য গ্রহণ করতে পারবেন না? আর যদি গ্রহণ করেন, তাহলে তার ধরন ও মাত্রা কেমন হবে? এ নিয়ে এন্তার বিতর্ক আছে। আছে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান লেখক, গবেষক ও চিন্তক সৈয়দ আবুল মকসুদের তৃতীয় প্রয়াণবর্ষিকী ছিল গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। এ উপলক্ষে সৈয়দ আবুল মকসুদ স্মৃতি সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে মকসুদ-লিখিত এবং প্রথমা থেকে প্রকাশিত ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ গ্রন্থটির ওপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সম্মানিত শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। বাঙালি মুসলমান বলা হলেও আসলে আলোচনাটি ছিল পূর্ববঙ্গীয় বা বাংলাদেশি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা নিয়ে। ফলে কোনো বিশ্লেষক শিরোনামটিকে ‘মিসনোমার’ বা ভ্রান্তিমূলক শব্দও বলতে পারেন।
সভার আলোচনায় বলা হয়, ষাটের দশক সম্পর্কে ইতিহাসের ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ বা মহাবয়ানে যেসব প্রশ্ন ও ফাঁকফোকর আছে, তা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছে এই গ্রন্থ। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, দেশভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথাগত ইতিহাসের বাইরে গিয়ে বিষয়গুলো দেখতে চেয়েছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। জানা-শোনা বিষয়গুলোতে তথ্য-উপাত্ত সন্নিবেশ করে নিজের মন্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। বক্তারা বলেন, খুব কম লেখকের মধ্যে আবুল মকসুদের মতো ইতিহাসবোধ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ দেখা যায়। মকসুদ লিখিত বইটির অন্যতম একটি দিক হচ্ছে— গত শতাব্দীর পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের ঢাকা-কেন্দ্রিক বড় বড় কবি ও সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম নিয়ে ধারাবাহিক বিশ্লেষণ। তার আলোচনা ও চিন্তাধারায় আমাদের সমাজকে পথ দেখানোর যে চেষ্টা করেছেন তা প্রশংসনীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণা থেকে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, বাঙালি মুসলমান ভাগ্য-বিড়ম্বিত তার নিজের স্বভাব-দোষে, ভাগ্যচক্রে এবং অন্যের কারণেও। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর ছিল বাঙালি মুসলমানের জীবনে একটি ক্রান্তিকাল। এ সময়ে বুদ্ধিজীবীদের সঠিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাদের অনেকেই সেটি নিতে পারেননি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়টি অর্থবহ হতো। কিন্তু সে ভুলের খেসারত জাতিকে এখনও দিতে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও মারাত্মকভাবে দিতে হবে।
আলোচনা সভায় নির্ধারিত বক্তা প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার, লেখক ইসরাইল খান এবং গবেষক কুদরত-ই-হুদা ছাড়াও দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত লেখক, অধ্যাপক, ও বিদগ্ধজনেরা আলোচনায় অংশ্রহণ করেন। সাংবাদিক এমরান মাহফুজের সঞ্চালনায় দু-ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এই আলোচনাটি হয়ে উঠেছিল উপভোগ্য, যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে শাণিত এবং একটি মৌলিক বিষয়ের ব্যবচ্ছেদে তৎপর।
আলোচকেরা বলেন, বাংলাদেশের খ্যাতিমান এবং মেধাবী লেখকদের একটি বড় অংশ ষাটের দশকে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। সরকারি আনুকূল্যে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এই সকল বুদ্ধিজীবীদের ভোল, বোল, এমনকি পোশাক পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে যেত। তাদের কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে টুপি পর্যন্ত পরতেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানে এসে তারা হয়ে যেতেন প্রগতিশীল! যেন তারাই প্রগতির ধারক এবং বাহক। তাদের সার্টিফিকেট ছাড়া কারও পক্ষে ‘প্রগতিশীল’ তকমা পাওয়াও সম্ভব হতো না। সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রগতিশীলতা যেন তাদের ‘মনোপলিক’ সম্পত্তি!
আলোচকেরা বলেন যে, আইয়ুব খানের কাছ থেকে আনুকূল্য নেওয়া এই সকল খ্যাতিমান লেখক ও সাহিত্যিকেরা ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে হয়ে যান বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও সমর্থক। তারা দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেও উচ্চতর মর্যাদা দিতে থাকেন। এই সকল ‘ডিগবাজি’ খাওয়া বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের পরে এমন একটি ‘ন্যারেটিভ’ বা বয়ান তৈরি করেন, যার সারমর্ম হচ্ছে— আইয়ুব খান এক ভয়াবহ স্বৈরশাসক ও দানব প্রকৃতির লোক এবং ৫০-এর ও ৬০-এর দশকের সব কিছু খারাপ। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়— এই সকল বুদ্ধিজীবীরা কেন আইয়ুব খানের কাছ থেকে নানা ধরনের আনুকূল্য নিয়েছিলেন? আবার তারাই কেন ‘ডিগবাজি’ খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ও আওয়ামী লীগের সমর্থক বনে যান? এই সকল বুদ্ধিজীবীরা আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্রকে’ও জায়েজ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘ছয় দফা’-কেন্দ্রিক আন্দোলন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটি থেকেও নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এসব বিষয় নিয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর ওপর অখুশি ছিলেন।
আলোচকেরা বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদী চরিত্র উন্মোচন করেন এবং এই সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটিকে তুলে ধরেন। এই তালিকায় এমন ক’জন লেখক, কবি ও সাহিত্যিক আছেন যাদের বাংলা সাহিত্যে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে— এই সুবিধাবাদী চরিত্রের জন্য কি তাদের সাহিত্য খারিজ হয়ে যাবে? আমরা যখন মস্ত বড় কবি ও সাহিত্যিকদের ‘পারসোনালিটি টাইপ’ বিশ্লেষণ না করে, তার পারিবারিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে কোনো একটা তত্ত্ব দিয়ে যেমন মার্কসবাদ অথবা ‘সুবিধবাদী’ তকমা দিয়ে ওই কবি বা সাহিত্যিককে বাতিল করে দেই, তখন মস্ত বড় ভুল করে বসি।
আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো ক্ষ্যাপা এবং উল্কার মতো তেজস্বী। তিনি ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জেলে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিবাদ নজরুলের মতো তেজস্বী এবং উত্তপ্ত নয়। আবার জীবনানন্দ দাশ শামুকের মতো গোটানো। কবি ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে বসে কথা বলতেও তার কুণ্ঠা, আড্ডা তো দূরের কথা। একই মানদণ্ডে একটা বাটখারায় যখন আমরা সবাইকে মাপতে যাই, তখন শুধু ভুল নয়, ভুল ‘ব্র্যান্ডিং’য়ের সঙ্গে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথকে ‘বুর্জোয়া কবি’ ও ব্রিটিশ-রাজের প্রতি প্রসন্ন বলে কেউ যদি বাতিল করে দেন, তাহলে সেটি কি ঠিক হবে? রবীন্দ্রনাথ ‘শক্তি’কে স্বীকার করেই শরৎচন্দ্রকে কলম চালানোর কথা বলেন। অর্থাৎ ‘স্টাবলিশমেন্ট’ বা রাজা-রাণী বা সরকারকে না চটিয়ে সাহিত্য চর্চার কথা বলেন। এটাকে কেউ রবীন্দ্রনাথের অপর্যাপ্ত প্রতিবাদ বা সুবিধাবাদ বলতে পারেন। এতে রবীন্দ্রনাথকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে যেমন ধোঁয়াশা তৈরি হয়, তেমনি রবীন্দ্রনাথের মতো একজন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিক কবিকে যথেষ্ট খাটো করা হয়।
আমাদের বুঝতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জীবনানন্দের ব্যক্তিত্ব তিন ধরনের। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদগুলো একটু নরম ও আর্দ্র। তিনি ব্রিটিশ রাজকে না চটিয়ে বা তাদের শক্তিকে স্বীকার করেই তার সাহিত্য চর্চা করেছেন। কিন্তু তার কাছ থেকে আমরা ‘রক্তকরবী’র মতো নাটক পেয়েছি, যেখানে তিনি এক চিরকালীন স্বৈরাচারী রাজার চরিত্র চিত্রন করে রাজা বা সরকারের শোষণ ও দুঃশাসনকে দেখিয়েছেন। আবার ‘গোরা’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি ধর্মান্ধতা ও ধর্ম বা জাতীয়তা নিয়ে বাড়াবাড়িকে কঠিন আঘাত করেছেন।
মোদ্দা কথা হচ্ছে— সুবিধাবাদ খারাপ জিনিস। বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদ তো ভয়াবহ! সরকারি আনুকূল্য পাওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবীরা যদি অনবরত ডিগবাজি খেতে থাকেন, সত্যি কথা না বলে ‘সরকার-পছন্দ’ কথা বলেন, তাহলে সমাজ ও সমাজের জনগণের ক্ষতি হয়। কেননা, সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের লোকেরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, ন্যায্যতার প্রশ্নে জনগণের পাশে দাঁড়ান। বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার কারণে গণতন্ত্র ও সুশাসন অর্থবহ হয়ে ওঠে, আবার তাদের কবিতা, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে সমাজের অন্ধকার কেটে যায়। এই প্রতিপাদ্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। তবে, পরিস্থিতির কারণে যদি কেউ আপস করেন বা আপস করতে বাধ্য হন, অথবা ব্যক্তিত্বের ধরন এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে শক্তিকে স্বীকার করেই কেউ যদি সাহিত্য চর্চা করতে চান; তাহলে তাকে বাতিল বা খারিজ করে দেওয়াটাও ন্যায্য বিচার নয়।