ভাষার অধিকারের দাবি, স্বাধিকার-স্বাধীনতার দাবি, গণতন্ত্রের দাবি ও বৈষম্যমুক্তির দাবির এ দীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রায় ছাত্রতরুণেরা তাদের দাবিতে হয়ে উঠেছে আরও স্পষ্ট, নেতৃত্বস্থানীয় ও কেন্দ্রীয় ভূমিকাপালনকারী।
Published : 31 Oct 2024, 07:15 PM
নকশিকাঁথার মতই অনেক শ্রম, ঘাম, রাতজাগা সংগ্রাম ও শিল্পিত মমতায় গড়া বাংলাদেশের গণমানুষের ইতিহাস। এ ইতিহাস গর্বের ও একান্তই বাংলার। আর এর শিল্পীতুল্য কারিগর বাংলাদেশের ছাত্রতরুণ জনতা। পৃথিবীর আর কোনো জাতির ইতিহাসে ছাত্রতরুণের ভূমিকা এতটা মুখ্য কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখার বিষয়। আজকের লেখাটি কয়েক প্রজন্ম ধরে বোনা সেই নকশি কাঁথারই গল্প— বায়ান্নো থেকে চব্বিশে ছাত্রতরুণের নেতৃত্বে গড়া ইতিহাসের এক বিবর্তনধারা।
বিবর্তনের একটি বৈশ্বিক রূপ রয়েছে। বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পুরনো। এর প্রয়োগ অনেক শাস্ত্রে ও দর্শনে রয়েছে এবং আরও বেশি হওয়া সম্ভব। এ হচ্ছে গতির এক বিমূর্ত রূপ। এগিয়ে যাওয়া, চলমানতা। ধরা যাক বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের কথা। তার আবিষ্কার তারও পূর্ববর্তীদের অর্জন ব্যতীত সম্ভব হতো না। তাই তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, “আমি অন্যদের চেয়ে বেশি দূর দেখেছি কারণ আমি বিরাটকায় মানুষদের কাঁধের ওপর দাঁড়িয়েছি।”
আলবার্ট আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন, কার্ল মার্ক্সসহ সবাই তাই— অন্যান্য বিরাটকায় মানুষদের কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেয়েছেন। বর্তমান প্রজন্মকে আবার দেখতে হয় তাদের কাঁধে দাঁড়িয়ে। কারণ এভাবেই জ্ঞান, সমাজ ও অন্য সবই ধীর পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বিকশিত হতে থাকে।
ইতিহাসও এই নিয়ম মেনেই চলে। ইতিহাসে আন্দোলন-সংগ্রামেরও আছে এক অনিবার্য ধারাবাহিকতা— একটি সুতায় গাঁথা মালার মত। এমন নয় যে, ইতিহাসে সুতা কখনো কাটে না, কাটে বৈকি, কারণ সে তো যন্ত্র নয়। তবু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখলে ফুটে ওঠে এক অনিবার্য ধরন বা প্যাটার্ন।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনসংগ্রামেও আছে তেমনই এক প্যাটার্ন যা ইতিহাসের দীর্ঘ পথচলার দিকে দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্ট হয়। তেমনি আছে এদেশের তরুণ ও ছাত্রসমাজের চোখধাঁধানো সব আন্দোলন-সংগ্রামের মাঝেও। বাংলাদেশের ইতিহসের এক বড় অংশ জুড়েই তো তরুণ ও ছাত্ররা— ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ হয়ে ওঠে ছাত্ররা। জাতীয় বৈষম্য ও সংকটের বিরহী সুর প্রথম বেজে ওঠে ছাত্রসমাজের মনে, ঝংকার দিয়ে কেঁপে ওঠে দ্রোহের তন্ত্রী। এই ঝংকার শোনা গেছে ভাষা আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থান পর্যন্ত। প্রায় শত বছরের এই সাফল্যের গৌরবগাথায় লেখা হয়েছে জানা-অজানা বহু আত্মত্যাগী বীরের নাম। আর পতন হয়েছে ৩ জন শক্তিশালী একনায়কের— ঊনসত্তরে আইয়ূব খান, নব্বইয়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও চব্বিশে শেখ হাসিনা।
এই পতনসমূহ তৈরি করেছে পরবর্তী কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্র। যদিও সেসব পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে পারেনি, অনেকক্ষেত্রেই নতুন সংকট তৈরি করেছে যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এগিয়েছে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্য। আইয়ূব খানের পতন নতুন যুগের দরজায় কড়া নাড়ে যা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পরিণতি পায়। এরশাদের পতন নিয়ে আসে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতায় তা আবার নতুন স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টি করে। হাসিনার পতন আরেক নতুন যুগের কড়া নাড়ছে, যদিও নতুন সংকটের ইঙ্গিতসহ।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্রগণআন্দোলন চলাকালে বিশ্বখ্যাত মার্ক্সবাদী লেখক তারিক আলী সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, “বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ সরকারে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সাহসী ছাত্রদের সঙ্গে শতভাগ একাত্মতা জানাচ্ছি। এ অঞ্চলে বাঙালি ছাত্রদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ অতীত। তারা তাদের ওপর এক নতুন ভাষা (উর্দু) চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং সেই ১৯৪৮-এ জিন্নাহর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে শহীদ হয়েছে। সে পরিকল্পনা বাতিল হয় ও ঢাকায় রয়েছে সেসব শহীদের স্মৃতিতে তৈরি মিনার। ১৯৬৮-৬৯ সালে এই ছাত্ররা পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রদের সঙ্গে মিলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসককে উৎখাত করে। ... আজ স্বৈরতান্ত্রিক গোত্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা। আশা করছি তারা জিতবে।”
১৯৪৮ থেকে ২০২৪ একসূত্রে গাঁথা বাংলাদেশের ছাত্রগণআন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস। শতবছরের এই রাজনৈতিক ঘটনাবলির যোগসূত্র বোঝাটা খুবই জরুরি। আন্দোলন-সংগ্রামগুলো এই বিনিসুতার মালায় গাঁথা একেকটি পুঁতির দানার মত। কিন্তু এই মালার দুই প্রান্ত খোলা। ইতিহাস এমনই এক বহমান নদী যার দুই প্রান্ত কখনো এক হবার নয়, শুধুই চলমানতা।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের গভীরে যে চেতনা ক্রিয়াশীল ছিলো তাই নিরীক্ষা ও ভুল সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শতবছর ধরে স্পন্দিত। ভাষা আন্দোলনের গভীরের চেতনাটি মানুষের মুক্তি যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। মানুষের মুক্তি হোঁচট খাওয়ার ফলেই আবার নব্বইয়ের ছাত্র জাগরণ। তার গণতান্ত্রিক ফল কুক্ষিগত হওয়ার ফলেই চব্বিশের এই অভূতপূর্ব ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান। তাই বলে এখানেই শেষ নয়।
ভাষার মুক্তি, জাতীয় মুক্তি, গণতন্ত্রের মুক্তি ও বৈষম্য থেকে মুক্তি— এসব মুক্তির চেতনাই ওই আন্দোলনগুলোর মর্মকথা। বৃহৎ মুক্তির চেতনা থাকার ফলেই মানুষ এসব আন্দোলনে আত্মাহুতি দেয়। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ার সংকট তৈরি হয় যখন ওই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পূর্ণমাত্রায় আসে না। এই মুক্তির চেতনাই নতুন নামে দানা বাঁধে নতুন প্রজন্মকে ঘিরে। ইতিহাসের চক্রযান তাই বলে একজায়গায়ই পড়ে থাকে না, এর চাকা ঘুরতে ঘুরতে জনগণকে নিয়ে হাজির করে মুক্তি সংগ্রামের নতুন সড়কে।
ষাটের দশক জুড়ে ছাত্রতরুণদের আন্দোলন বৃহৎ রাজনৈতিক মোড় নিয়ে একাত্তরে বিদেশি শক্তিকে হটিয়ে এক নতুন স্বাধীন দেশ তৈরি করেছে। কিন্তু এক বিদেশি ভাষা উর্দুর পরিবর্তে আরেক বিদেশি ভাষা ইংরেজি উর্দুর চেয়েও প্রতাপ নিয়ে চেপে বসেছে আমাদের ঘাড়ে ও মগজে। বিদেশি লুণ্ঠকদের হাত থেকে দেশ মুক্ত করা সম্ভব হলেও দেশি লুণ্ঠকদের হাতে জাতি জিম্মি হয়ে আছে। বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসন দূর হলেও বারবার দেশি স্বৈরশাসনের খপ্পরে পড়ছে মানুষ।
ছাত্র আন্দোলনও দানা বেঁধেছে বারবার। ভাষার অধিকারের দাবি, স্বাধিকার-স্বাধীনতার দাবি, গণতন্ত্রের দাবি ও বৈষম্যমুক্তির দাবির এ দীর্ঘ ঐতিহাসিক যাত্রায় ছাত্রতরুণেরা তাদের দাবিতে হয়ে উঠেছে আরও স্পষ্ট, নেতৃত্বস্থানীয় ও কেন্দ্রীয় ভূমিকাপালনকারী।
এই যাত্রায় নব্বইয়ের আন্দোলনের ভুল অতিক্রমেরও পণ ছিলো স্পষ্ট। নব্বই পর্যন্ত রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে ছাত্ররা। এবার ছাত্ররাই ছিলো নেতৃত্বে, অন্যরা শক্তি যুগিয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিশেষ বিশেষ দলীয় আদর্শের বদলে সার্বিক নৈতিক চেতনায় বেশি আলোড়িত ছিলো। মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দেশজুড়ে সর্বব্যাপি দুর্নীতি ও যথেচ্ছ অধিকার কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে তাদের মনে ছিলো জ্বলন্ত ক্ষোভ।
তবে ইতিহাসের নকশি কাঁথায়্ও প্রযুক্তির ছাপ পড়েছে। কেননা আগেরগুলো হাতে বোনা হলেও চব্বিশের আন্দোলনে ডিজিটাল ছাপ ছিলো। এখানে সাংগঠনিক বার্তার আদান-প্রদান ও সমাবেশের প্রস্তুতি ঘটেছে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে। আগের ভার্টিক্যাল নেতৃত্বের বদলে হরাইজোন্টাল বা আনুভূমিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে। স্বৈরাচারী সরকারের অ্যানালগ এককেন্দ্রিক নেতৃত্ব মুখ থুবড়ে পড়েছে নতুন প্রজন্মের বহুকেন্দ্রিক ডিজিটাল নেতৃত্বের সামনে।
এবারকার স্লোগানসমূহও আগের চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী। ‘বিকল্প কে? তুমি আমি,’ ‘দেশটা কারো বাপের না,’ ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’— এসব স্লোগানে রয়েছে ছাত্রতরুণদের বিকশিত চেতনার ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ। আছে গভীর দেশপ্রেম ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নতো ঠুনকো, ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গেই ভেঙ্গে যায়। অতীতে যেমন ভেঙ্গেছে। তাই সাবধান থাকা প্রয়োজন।
সবচেয়ে বেশি সতর্কতা প্রয়োজন নকশি কাঁথাটিকে ছিঁড়ে না ফেলায়। মনে রাখা প্রয়োজন চব্বিশের এই ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ একাত্তরে মহাসিন্ধুর কল্লোলময় স্বাধীনতার সম্প্রসারণমাত্র। মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের বৈষম্যহীন জীবনের স্বপ্নই এবার ছাত্রজনতার বুকে কড়া নেড়েছে। ভাষিক অধিকারের চেতনা মুক্তির চেতনা হয়ে নব্বইয়ের পাড় উছলে চব্বিশে আছড়ে পড়েছে জলোচ্ছ্বাসের মত। কিন্তু ইতিহাসের পথ চলমান ...।