Published : 16 Mar 2022, 07:33 PM
রাজনীতির মহাকবি মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মাতৃভূমি থেকে আট হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রার্থিত নির্বাসনের নির্জন নিরালায় বিভোর হয়ে শুনছিলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা এবং অজয় চক্রবর্তী ও রশিদ খানের কণ্ঠে বেহাগ রাগের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতটি।
"মহারাজ একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে
চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে
মহারাজ একি সাজে"
বঙ্গবন্ধুর কথা মনে হলে মনে পড়ে গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউসের কথা। বাঙালির মুক্তির জন্য তার ব্যক্তিগত জীবনের নিদারুণ ত্যাগ, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি (চার হাজার ৬৮২ দিন) কারাবরণ, দু-দুবার মৃত্যুদণ্ডের জল্লাদকে পরাভূত করে ফিরে আসা, রক্তস্নাত স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান, বাঙালির জন্য স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনা– এসবের কল্পকাহিনীতে পরিপূর্ণ মনে হবে বঙ্গবন্ধুর জীবনের মহাকাব্য।
মনে হয় কবিগুরু 'ওই মহামানব আসে' গানটি লিখেছিলেন তূর্য-বাদকের ভূমিকায়
"ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক –
এলো মহাজন্মের লগ্ন।"
বঙ্গবন্ধু– "ওই মহামানব"– তার মর্তে্য আসার কারণেই পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল "মহাজন্মের লগ্ন"। এই মহান অর্জন বাঙালির ঘরে পৌঁছে দিতে বঙ্গবন্ধুকে সইতে হয়েছে সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতন।
নির্যাতনের লৌহ শৃঙ্খলে তাকে কারাবন্দি করা হয় মাত্র আঠাশ বছর বয়সে। তাকে বিচ্ছিন্ন করা হলো আঠারো বছর বয়সের বালিকা বধূ বেগম ফজিলাতুন নেছার মায়াবী বাঁধন ছিন্ন করে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বারো বার কারারুদ্ধ হয়ে বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েও তিনি বাঙালির জন্য স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনার সংগ্রাম থেকে এতটুকু সরে দাঁড়াননি। বাঙালি হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য দেবদূতের মতো আবির্ভাব ঘটেছিল কালজয়ী এই মহামানবের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রজীবনে আমি তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। দেখেছিলাম মহামানবকে কাছ থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ছিল কল্পনাতীত। বিজয়ের পরে দেখলাম অসহনীয় ধ্বংসস্তূপ। আমার জন্মস্থান পটুয়াখালী শহর গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত, আগুনে পুড়ে ছারখার। অনেক শহরের অবস্থা ছিল এরচেয়েও করুণ। পথ-ঘাট-স্থল যোগাযোগ বিপর্যস্ত। ভৈরবসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজগুলো শত্রু সেনারা ভেঙ্গে দিয়েছিল। নদীপথে যোগাযোগও অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জাহাজ ও নৌকা চুরমার করে ডুবিয়ে দিয়েছিল নদীর বক্ষে।
প্রচলিত মুদ্রাকে বারবার অচল ও পরিবর্তন করে পরাধীন পূর্ব বাংলার অর্থনীতির বুকে বেয়োনেট বিদ্ধ করেছিল নির্লজ্জ নরাধম নরপশুরা। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে বঞ্চিত করেছিল বাঙালিদের। পরনের কাপড় উধাও করে দিয়েছিল। শস্যের গুদাম শূন্য পড়ে রইল। আমার স্পষ্ট মনে আছে রেশনে পেয়েছিলাম প্যান্টের দুই পিস ও জামার দুই পিস নিম্নমানের কাপড়– স্বাধীনতার একটু পরেই। ঢাকায় সরকারি অফিসে কাজের জন্য দরকারি আসবাবপত্রের অভাব ছিল প্রকট। অফিস, আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু অচল হয়ে গিয়েছিল।
এমনই এক ভয়ানক পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেট। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, ও ওসমানীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে পুনরায় গতিমান করার দুস্তর দায়িত্ব। বাঙালির সৌভাগ্য, ফাঁসির মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন বিজয় দিবসের পর এক মাস যেতে না যেতেই। তার নেতৃত্বে মৃতপ্রায় জনপদে এলো আবার প্রাণের সঞ্চার। অতি দ্রুতগতিতে বঙ্গবন্ধু এবং তার বিজ্ঞ মন্ত্রীপরিষদ পুনরুদ্ধার করেছিলেন বিপর্যস্ত অর্থনীতি। তার জিয়নকাঠির স্পর্শে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রাণ ফিরে পেল। সাধারণ কর্মপ্রবাহে গতি এলো। স্বাধীনতা প্রাপ্ত নতুন দেশটিকে তিনি সযত্নে উপহার দিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত এক বলিষ্ঠ শাসনতন্ত্র।
পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি সাবধানে অতি সন্তর্পণে স্নায়ুযুদ্ধে বিবদমান বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন। গ্রিক মহাকবি হোমারের ট্রয় যুদ্ধ বিজয়ী মহানায়ক অডিসিয়াসের মতো তিনি যেন বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে অতিশয় দক্ষতায় স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করলেন বিশ্বের দরবারে।
এই মহামানবের যাদুর স্পর্শে যুদ্ধে বিজয়ী ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেল। বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি নিদারুণ বিরল ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের সেনানিবাস এখনও রয়েছে জার্মানি, জাপান ও অন্যান্য দেশে। বঙ্গবন্ধুর এই অভূতপূর্ব অর্জন পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভারতের তৎকালীন নেতৃত্বও সাধুবাদের দাবিদার। যুদ্ধ বিজয়ী সৈন্যরা এত তড়িৎ গতিতে ফিরে যায়– এর দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা নেই। বঙ্গবন্ধুর জিয়নকাঠির স্পর্শে সব কিছুই সম্ভব ছিল।
আমাদের অন্তহীন নিদারুণ বেদনা এই মহামানবকে জীবন দিতে হলো নরাধম জঘন্য কুলাঙ্গার বেঈমানদের অস্ত্রের আঘাতে। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে অবর্তমান। কিন্তু বাঙালির স্মৃতির মণিকোঠায় তিনি রয়েছেন চিরঞ্জীব। তবুও মন মানে না। আজ বৈশ্বিক মহামারী আর বিবিধ অনাচারের মাঝে ইচ্ছে হয় কবি সুকান্তের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে বলি,
"হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে
এখানে মৃত্যু এসে হানা দেয় বারবার
লোক চক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার"
[পাদটীকা: ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যার কভার পৃষ্ঠায় বিশ্ব বিখ্যাত ম্যাগাজিন 'নিউজউইক' বঙ্গবন্ধুকে ভূষিত করেছে , "poet of politics"]