Published : 04 Jul 2021, 10:55 PM
কবি শামসুর রাহমান প্রজন্মের পরের সময়ে বাংলাদেশের চার কবিকে আড্ডায় আলোচনায় অনানুষ্ঠানিকভাবে 'চার খলিফা' বলে অভিহিত করতেন কেউ কেউ। এ চার খলিফা হলেন- রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন এবং হাবীবুল্লাহ সিরাজী। আমরা 'মানিক জোড়' শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এ চার কবিকে একসাথে দুই মানিক জোড় বলা যায়। এই যে দ্বিবিধ জোড় এটা কেবল কথার কথা ছিল না। তাদের দৈনন্দিন জীবনে, চিন্তায়-ধ্যানে-জ্ঞানে-মননে- লেখকজীবনে-চলনে-বলনে নিত্য যোগসূত্র ছিল। এদের পরষ্পরের সঙ্গে সম্পর্কের বিরল এক রসায়ন অনুভব করার সুযোগ আমার হয়েছিল। ঢাকা শহর বাংলাদেশের সাহিত্য পরিমণ্ডল তাদের সৃষ্ট এ বিরল আবহ থেকে ছিটকে পড়লো শেষতক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর চলে যাওয়ার কারণে। এর মাধ্যমে বাংলা কবিতার খলিফা যুগের অবসান হলো।
এ চার খলিফা প্রত্যেকের পরের প্রজন্মের নানা বয়সের সকলের সঙ্গে স্নেহ ও অনুরাগের সম্পর্ক ছিল। আমার মনে হয়েছে শামসুর রাহমান যুগে ঢাকার কবিতা পরিমণ্ডলে তার একক প্রাধান্য ছিল। তারপরে যেন এ চারজন রাহমান ভাইয়ের রেখে যাওয়া জায়গা যত্নে মিলেমিশে তার শাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন। এর কেন্দ্রে ছিল শামসুর রাহমানের হাতে গড়া সংগঠন জাতীয় কবিতা পরিষদ।
তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কবিতা পরিষদের সূত্রে। তাদের সকলের স্নেহভাজন হবার সুযোগ আমার হয়েছিল। অবারিত স্নেহ ও অনুরাগে তাদের সঙ্গে একটা 'ব্ল্যাংক চেক' সম্পর্ক হয়েছিল। বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধায় এরকম একটা জায়গায় ছিল আমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ। দেখা হলে, সালাম দেবার সঙ্গে সঙ্গে বেলাল ভাই জিজ্ঞেস করতেন, 'আনিস, তুমি কেমন আছ ভাই'। রবিউল ভাই এবং সিরাজী ভাই একই ডাকে স্নেহসিক্ত করতেন।
রফিক ভাই ছিলেন আমার এলাকার, আমরা দুইজনেই টাঙ্গাইলের, রফিক ভাই ঘাটাইলের আর আমি তার পাশের মধুপুরের। রফিক ভাই আমাদের আঞ্চলিক টানে বলতেন, "ভাই কেমন আছো"। 'সেই কেমন আছো ভাই' বলার প্রজন্মের আরও একজন চলে গেলেন।
উপরের স্নেহের ছায়া দেওয়া হাতগুলো একে একে সরে যাচ্ছে। আর মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়া বলতে যা বোঝায় সময়টা আমাদের সেরকমই যাচ্ছে। সিরাজী ভাইয়ের বয়স ও স্বাস্থ্য যেরকম ছিল তাতে তার চলে যাবার কোন আশঙ্কা ছিল না। তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেন। পরিমিত জীবনধারা রপ্ত করেছিলেন। শেষতক ঢাকায় অবস্থানকালে উনি একদিন বললেন, "তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করব। কিন্তু সেটা অফিসে তো আর সুবিধা হবে না। এই ঝামেলা, ওই ঝামেলা করে আর আলাপ জমবে না। তুমি এক কাজ করো, তুমি যেকোনও দিন যত সকালে পারো আমার বাসায় চলে এসো। তাহলে অফিসে যাবার আগে কয়েক ঘণ্টা দুই ভাইয়ে কথা বলা যাবে।"
একদিন সকালে হয়েছিল আমাদের সেই আলাপ। তখনও তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হননি। সকালের নাস্তার এক পর্যায়ে ভাবীকে ডেকে বললেন, আমি কি আরো একটা রুটি খেতে পারব? ভাবী পুষ্টির হিসেব দেখে সায় দিলেন। সিরাজী ভাই আরো একটা রুটি খেলেন। আলাপের বেশিরভাগ জুড়ে তিনি আমার কাজ, লেখালেখি, আর আমার পরিবারের খোঁজখবর নিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এক পর্যায়ে কিছুটা আক্ষেপ করে বললেন, তিনি দেশান্তরী হবেন। মেয়ের কাছে চলে যাবেন। তার কথায় ও টানে তার অভিমানী মেজাজ টের পেয়ে আমি তাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, "সিরাজী ভাই, আমি আপনার ছেলের বয়সী ছোট ভাই, আপনাকে অনুরোধ করব, দেশান্তরী না হতে। লেখকের জন্যে দেশভ্রমণ ভাল। কিন্তু একেবারে দেশান্তরী বড় বেদনাদায়ক।" আমার কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন, "লেখকের বিদেশে চলে যাওয়া মানে কবরে চলে যাওয়া।" শেষ পর্যন্ত তিনি দেশান্তরী হননি। সিরাজী ভাইও তার অভিমান থেকে রেহাই পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার পরে।
সিরাজী ভাইকে এই পদে দায়িত্ব দেওয়াটা ছিল এক ধরনের বিপ্লব। বাংলা একাডেমির ইতিহাসে আমলাতন্ত্র আর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক প-িতি মোড়লের বাইরে থেকে নিখাঁদ একজন কবি, অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় আবার যিনি প্রকৌশলী, এরকম একজন মানুষের এ পদে দায়িত্ব পাওয়া সহজ কথা ছিল না। আমি আমার দেশ-বিদেশের সহকর্মীদের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছিলাম, আমাদের বাংলা একাডেমিতে নিখাদ একজন কবিকে নির্বাহী পদে বসানো হয়েছে। তার দায়িত্ব পালনের বেশিরভাগ সময় মহামারীর খপ্পরে ছিল। যে কারণে তার কাঙ্ক্ষিত পরিকল্পনাগুলো এগিয়ে নিতে পারেননি। শেষের দিকে স্বাস্থ্যও আর অনুকূলে ছিল না।
এক সময় তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু সাধারণ সম্পাদক। আমি ওই কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। ততদিনে শামসুর রাহমান আমাদের মাঝে নাই। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক মিলে শামসুর রাহমানের নামে পুরস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তের নামও বাছাই করা হয়েছে। এটা নিয়ে ব্যাপক গোলযোগ। পুরস্কারের জন্য নামটিও ঘোষণা করা হবে। এদিক-সেদিক মার মার কাট কাট অবস্থা। এই সিদ্ধান্তে আমারও সায় ছিল না। কিন্তু তাই বলে এটা নিয়ে গণ্ডগোল বাড়ুক সেটাও ভাল লাগছিল না। আমি একাই গেলাম সিরাজী ভাইয়ের কাছে। বললাম, "সিরাজী ভাই একটা কথা ছিল।" উনি বললেন, "এখানেই বলবে? না কি আসতে হবে?" আমি বললাম, "লোকজন থেকে দূরে গেলে ভাল হয়।" তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দিকে এলাম আমরা দুজন। আমি বললাম, "পুরস্কারের সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়নি।" সিরাজী ভাই বললেন, "আনিস শেষ পর্যন্ত তুমিও? সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাদের কি এখতিয়ার নাই এরকম একটা উদ্যোগ নেবার?" আমি বললাম, "আপনাদের সে এখতিয়ার আছে। তবে কৌশলগত একটু ভুল হয়েছে। ভুলটা এখনও ঠিক করা যায়।" তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "ভুলটা কী?"
উত্তরে বললাম, "বিষয়টা কার্যনির্বাহী কমিটিতে উঠিয়ে আলোচনা করে নিতে পারতেন। সে সুযোগ এখনো আছে।" এই কথা শুনে তিনি একটু দম নিয়ে বললেন, "দেখি কি করা যায়।" তবে শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটা চালু হয়নি। জাতীয় কবিতা পরিষদের বর্তমান নেতৃত্বের কেউ কেউ যে অজুহাতে শামসুর রাহমান পুরস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন, তারা কেন এত বছরেও সে অজুহাত ঠিকঠাক করে পুরস্কারটা চালু করলেন না? অথচ শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদেরও তারা পদ দখল করে আছেন। প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন তোলা যায় শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের উল্লেখযোগ্য কাজ কী?
সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে পুরস্কার নিয়ে ওই কথোপকথনের পর আমি অনেকটা অস্বস্তিতে। আমি আর তার সামনে পড়ি না। বেশ কয়েক মাস পর তৎকালীন হোটেল শেরাটনে জেমকন পুরস্কার অনুষ্ঠানে আমিও গিয়েছি, তিনিও এসেছেন। আমি দূর থেকে তাকে দেখেছি। আমাকে তিনি দেখেননি। ভাবলাম আজকে আর এড়িয়ে চলার সুযোগ নাই। তাই আমি মনের ভেতরে দুরুদুরু ভাব নিয়ে কাছাকাছি যাই, ভেতরের শব্দ মুখ দিয়ে বের হতে চায় না, হাত তুলে সালাম দিই আর আস্তে করে বলি- 'সিরাজী ভাই…'। তিনি কয়েক কদম এগিয়ে এসে আনিস বলে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'কেমন আছো তুমি ভাই?"
এরপর আমি আর ঢাকা শহরে খুব একটা স্থিত হতে পারিনি নানা কারণে। ফোনে এবং মেইলে যোগাযোগ ছিল। একবার জার্মানিতে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত আমাদের দেশের এক কবি সিরাজী ভাইয়ের কাছে ফোন করে আমার বিরুদ্ধে খেদ ঝেড়েছেন। সিরাজী ভাই আমার কাছে জানতে চাইলেন, ওই নির্বাসিতের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ আছে কিনা! আমি বললাম, না তো। তার সঙ্গে জীবনে কখনো দেখা হয়নি। আমরা একে অপরের লেখালেখির খবরাখবর রাখি। এরপর সিরাজী ভাই বললেন, ওই নির্বাসিত ঈর্ষান্বিত হয়েছেন বটে! "ওসব পাত্তা দিও না। কাজ করে যাও, লিখে যাও", পরামর্শ দিলেন তিনি।
তিনি বাংলা একাডেমির দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই আমি ঢাকায় যাই আমার নিজের কাজে। তিনি আমাকে তার বাসায় সকালের নাস্তার দাওয়াত দিলেন। কথা প্রসঙ্গে পরামর্শ চাইলেন, "বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে কী কী করা যায়?" বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শত ভাষায় শত প্রকাশনা হতে পারে আমার দেওয়া ধারণাটা তার পছন্দ হয়েছিল। তারপর বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর বিদেশি ভাষায় অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া যায়। এ ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকলেও উপরের দিকে আমলাতান্ত্রিক খবরদারির কারণে পেরে উঠেননি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা এপিক মনোলগ 'আমি শেখ মুজিব' নাটকটি বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্য করেছে আর নানা মহাদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে জেনে এটির ইংরেজি সংস্করণ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের ইংরেজির এক সাবেক অধ্যাপক ও অনুবাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক অধ্যাপক ও অনুবাদকের বিরোধিতার কারণে সে উদ্যোগ এগিয়ে নিতে পারেননি। এরপর তিনি একদিন বললেন, "আনিস শুনো, আমি তো কবি, পড়াশোনা করেছি প্রকৌশল বিদ্যায়। এই চেয়ারে বসে অধ্যাপকদের পোদ্দারি আর আমলাদের খবরদারির কারণে কাজ করা যায় না। আমি তো ভাই প-িতও না, আমলাও না। আমার হয়েছে সমস্যা।"
তবে স্বস্তির খবর হলো সেই এপিক মনোলগ 'আমি শেখ মুজিব' একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তালিন, লন্ডন এবং নিউ ইয়র্ক থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে। ইচ্ছে ছিল বইটার ইংরেজি সংস্করণ হাতে পাবার পরে সিরাজী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বইটা তার হাতে দিব। সে সুযোগ আর থাকল না।
সিরাজী ভাইয়ের তিন বছরের কম সময়ে বাংলা একাডেমির দায়িত্ব পালনকালে একাডেমি এবং বইমেলা বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে অনেক সময় কড়া পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লিখেছি, কথা বলেছি। সেসব তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেননি। ব্যক্তিগত সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। অথচ এই সিরাজী ভাইয়ের আশেপাশের কবিতা পরিষদের নেতৃত্বের কেউ কেউ তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ন্যূনতম পর্যবেক্ষণ সহজভাবে নিতে পারেননি। তারা ব্যক্তিগত সৌজন্যটুকু রক্ষা করেননি। লেখালেখির ক্ষেত্রে সত্য প্রকাশের এমনই মানদণ্ড লেখার ভেতরে সত্যপ্রকাশের খাতিরে পাঠকের কথা মনে রাখতে নাই। আমিও তা করি না। সিরাজী ভাই একদিন বললেন, "ভাই লিখে যাও। কে কী ভাবল, বলল, ওসব মাথায় রেখে সময় নষ্ট করো না।"
আমাদের দেশটা বড় কাড়াকাড়ির দেশ। সেই কাড়াকাড়ির দেশে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে থেকে নানাদিকের চাপ সামলেছেন। এমনকি আমার মত অভাজনের কড়া পর্যবেক্ষণও হাসিমুখে সয়ে গেছেন। তারপর অপার উদারতা দেখিয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলার অনুষ্ঠানসূচিতে আমার নাম ঢুকিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ করেছেন সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য। এসব অনুষ্ঠানের একটি ছিল বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যের ওপর, অন্যটি ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবি আসাদ চৌধুরীর একটি বইয়ের।
সিরাজী ভাইয়ের চলে যাবার পরে আমাদের প্রজন্মের অনেকের উপর থেকে অগ্রজ প্রজন্মের সহনশীল উদার ও আগ্রহী স্নেহমাখা নক্ষত্রগুলোর একটির প্রস্থান হলো। কিন্তু তিনি থেকে যাবেন আমার মনে যতদিন বেঁচে থাকব।