Published : 02 Mar 2021, 08:04 PM
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "আমরা মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় করেছি, আমরা সিভিল এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় করেছি। অর্থাৎ সাবজেক্টগুলো আমরা দেখে দেখে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যে এলাকায় যে ধরনের শিক্ষার খুব বেশি গুরুত্ব, আমরা সেভাবেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করে দিচ্ছি। দিচ্ছি এজন্য যে সকলেই যেন শিক্ষাটা যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে।"
প্রধানমন্ত্রী বলেন, "বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা এখন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ শিক্ষা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এটা শুধু দেশে না বিদেশেও। আর আমাদের দেশে এজন্যই প্রয়োজন… আমি একশটা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। সেখানে অনেক কারিগরি লোক লাগবে। দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। কাজেই সেই দক্ষ জনশক্তি আমরা সৃষ্টি করতে চাই।"
আমরা এটা জানি প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তা করেন। তাই কয়েকটা প্রশ্ন আজ তোলা জরুরি। তার আগে দু-একটা কথা বলতে চাই। আমি যখন এ লেখা লিখছি তখন দেশের ভেতরে-বাইরে মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মুশতাক আহমেদ কত বড় লেখক ছিলেন সেটা বড় কথা না। বড় বিষয় কারাগারে তার অকাল মৃত্যু। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে মানুষের মনে বিশেষত সুধী মহলে তর্ক-বিতর্ক থাকলেও আইনটির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। সরাইল, রামুসহ দেশের নানা এলাকায় মানুষের জীবন যখন ভয় ও আশংকায় যখন সাম্প্রদায়িকতা গিলে নিতে চেয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও শান্তি, তখন এর দরকার পড়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সে শান্তি, সে নিরাপত্তা কি আদৌ আছে সমাজে? দেশের মানুষ একদিকে যেমন উন্নয়ন, সড়ক, পুল আর টাকার ঝলক দেখছে তেমনি তাদের চোখে এমন কিছুও পড়ছে যার সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলানো কঠিন। এটা মানা কঠিন কারাগারে কোন মানুষের এমন মৃত্যু হবে। যে কিনা বারবার জামিন পেতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর অপরাধটি জামিনযোগ্য বলে শ্রুত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি আসলেই সব জানেন? এখনো কিন্তু আল জাজিরার প্রতিবেদনের সঠিক উত্তর বা জবাব দেওয়ার কাজটি হয়নি। বিদেশে বসে আমরা এই প্রতিবেদনের মূল কথা ও রহস্য ধরতে পারলেও দেশের যারা কর্তা বা যারা জবাব দেওয়ার দায়িত্বে তারা নিরব। সরকার একটা কাজ দারুণ করেছে। আল জাজিরা নিষিদ্ধ করার মতো কোন বাজে বা খুচরা কাজ করেনি। কিন্তু যে কথা বলতে চাই, সত্তরের দশকে আমরা তরুণ বেলায় দেখেছি বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দিতে ব্যর্থ ছিল তাহের উদ্দিন ঠাকুরের দল। তাদের হাতে তথ্য ছিল অথচ বাসন্তী ও জালের মিথ্যা গল্প খাওয়ানো হয়েছিল মানুষকে। তখনকার মুশতাক গং একই কায়দায় তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে জাতিকে পিছিয়ে দিয়েছিল অনেক বছর। আজ যখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তকমা লাভ করেছে তখন এমন সব অপঘটনার পেছনে কারা আছে বা কেন হচ্ছে তার রহস্য উদঘাটন করা জরুরি।
ফিরে আসি শুরুর প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সে কারণেই কিছু বিষয় তুলে আনা জরুরি। বিজ্ঞান প্রযুক্তি কারিগরি শিক্ষা দেশ ও জাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার দরকার পড়ে না। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে লেখাপড়া তো বটেই পুরা পরিবেশই এখন বিজ্ঞান বিরোধী। যে প্রসঙ্গ তুলেছিলাম মুশতাক আহমেদের মতো মানুষরা মারা গেলেও ধর্মব্যবসায়ীরা সমানে সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলছে। তাদের ব্যাপারে শিথিলতা কিন্তু দৃশ্যমান। এরা না মানছে কোন আইন-কানুন, না কোন সামাজিক নিয়ম। কেন তাদের বেলায় ব্যতিক্রম? এর কারণ রাজনীতি হলেও মানুষ সব বোঝে। থাক রাজনীতি। কথা হচ্ছে যে লেখাপড়া সমাজ সংসার দেশকে এগিয়ে নেবে বলে প্রধানমন্ত্রী বলছেন তার বিরুদ্ধে এরা সক্রিয়। বিশেষত গ্রামের সরল মানুষদের মগজ ধোলাই করে তারা। এমনই প্রভাব যে, দেশের মানুষের একাংশ বিজ্ঞান, দর্শন, কারিগরি পড়াশোনাকে মনে করে নাজায়েজ। এমন সব স্কুল আছে যেখানে ছবি এঁকে মানুষের শরীর বোঝানো বা দেখানো হয় না। মূল ধর্মের আদর্শ ও সরলতা থকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখছে এরা। এখন এই পরিবেশে কীভাবে সম্ভব বিজ্ঞানমুখী সমাজ তৈরি করা? আওয়ামী লীগ এত বছর ধরে ক্ষমতায় কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে কারো এসব নিয়ে না আছে মাথাব্যথা, না কোন চিন্তা।
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এবং তার সহকারী মন্ত্রী দুজনই আধুনিক মানুষ। তাদের মেধা, চিন্তা ও মননশীলতা সমৃদ্ধ করার মতো। কিন্তু তাদের হাত-পা কি আসলেই খোলা? আমরা মাঝেমাঝেই দেখি বিজ্ঞানমুখী মানুষজনের ওপর আক্রমণ। হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, দীপনের অপমৃত্যু দেখেছে জাতি। নৃশংসভাবে নিহত এরা না ছিলেন অপরাধী, না কোন দাগী কেউ? কেবল আধুনিকতার কারণে জান হারানো এদের কথা কি আমরা মনে রেখেছি? আমরা কি সে ঘটনাগুলি আবার না হবার নিশ্চয়তা পেয়েছি? আজ দেশের মানুষের বিশেষত আধুনিক মনের মানুষের জীবন আসলেই কি নিরাপদ? এটা নিশ্চিত হলেই আমাদের দেশে সবকিছু অবাধে করা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রী স্কুল-কলেজে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রী সংখ্যা কেন বেশি তা খতিয়ে দেখার কথাও বলেছেন। দারুণ পর্যবেক্ষণ। আবারও বলতে হচ্ছে এই ছাত্রীরা আমাদের এগিয়ে রাখা নারী শক্তি হবার পরও তাদের বেলায় অপশক্তি সবচাইতে বেশি সক্রিয়। তারা এদের নানাভাবে ঠেকাতে চেয়েও পারছে না বলেই আমরা পাকিস্তানকে ফেলে সামনে চলে এসেছি। এটা পাকিস্তানিরা স্বীকার করলেও আমাদের অন্ধ পাকিস্তান ভক্তরা মানছে না। শেখ হাসিনার কারণে না পারলেও মাঝে মাঝে তারা তাদের অপশক্তির কথা জানান দেয়। সে সময়কালে কঠিন হবার পরিবর্তে সরকারকে ছাড় দিতেও দেখেছি। যে কারণে হয়তো আজ তারা দমে যাবার পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টিতে তৎপর। ছাত্রদের বেলায় এটা মানতেই হবে এর পেছনে নানাবিধ কারণের ভেতর মূল কারণ হলো সমাজে অন্ধকারের অশুভ প্রভাব। এরা একদিকে মৌলবাদের শিকার আরেকদিকে যৌনতার। ফেইসবুক মোবাইল আর অপরাধ জগতের অবাধ সংযোগে এদের জীবনে না আছে শান্তি, না কোন স্থিরতা। এখন অপরাধ জগতের নায়কদের বয়স দেখলেই তা বোঝা সম্ভব। তাই ছাত্রদের ফিরিয়ে আনতে সবার আগে দরকার শুভ ও মঙ্গলের এক সমাজ। না হলে এই ব্যবধান বাড়বেই।
প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদ পূর্ণ করতে হলে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অপরাজনীতি এবং একমুখী সবকিছু থেকে বেরিয়ে মানুষকে আনতে হবে আলোয়। শুধু অর্থ আর টাকার জোগানে উন্নয়নশীল দেশ বানালেও জায়গায় পৌঁছাতে হলে লাগবে শিক্ষা ও আধুনিকতা। সে দুয়ার কি খুলবেন আপনারা?