Published : 01 Mar 2021, 07:20 PM
ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস। ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার অধিকার সংরক্ষিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এরই মাঝে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। ভাষা আন্দোলন না হলে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হয়তো সম্ভব হতো না, আর স্বাধীনতা অর্জন না হলে তার সুবর্ণ জয়ন্তীও হতো না। তাই আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম।
ভাষা আন্দোলন ও একুশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে হলে একুশের প্রেক্ষাপট জানতে হবে, একুশের চেতনা বুঝতে হবে এবং তা অনুধাবন করতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরপরই ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রসংগটি সামনে চলে আসে। বাংলা ভাষাভাষী নাগরিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ৭ শতাংশের ভাষা উর্দুকে যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের প্রস্তাব আসে তখনই বাঙালি তার প্রতিবাদ করে এবং যথারীতি বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেরুয়ারি ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। কার্ফিউ ভঙ্গ করতে গিয়ে ভাষার জন্য জীবন দেন রফিক, বরকত, সালাম, জাব্বারসহ আরও অনেকে। ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল দুর্বার আন্দোলন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রদেশের প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে এমনভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় যে তাকে উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত ডাকতে হয়েছিল। যাই হোক, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলে রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ের মাধ্যমে ভাষার জন্য আন্দোলনের দৃশ্যত সমাপ্তি এখানেই ঘটে।
যাই হোক, ভাষার দাবি মেনে নিলেও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের শোষণ ও বৈষম্য চলতেই থাকল। ফলে ভাষার জন্য আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটলেও অধিকারের জন্য আন্দোলন চলতেই থাকল। তারই ধারাবাহিকতায় অধিকার, স্বাধীকার, স্বায়ত্বশাসন এবং সবশেষে স্বাধীনতার জন্য আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হলো। আমরা যুদ্ধ জয় করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেলাম। পৃথিবীতে খুব কম রাষ্ট্রই আছে যাদের রাষ্ট্রের নাম হয়েছে ভাষার নামে। সাধারণত দেশের নামে ভাষার নাম হয়েছে তেমনটাই দেখতে পাওয়া যায়। এখানেও একুশের চেতনাই জড়িত।
ভাষা আন্দোলন বিষয়টা নিতান্তই ভাষার জন্য ছিল না, পুরো বিষয়টাই ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পেছনেও যুক্তি ছিল অর্থনৈতিক। হিন্দু জমিদার আর জোতদারদের হাত থেকে মুসলমানদের মুক্ত করে স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভাষার সাথে অর্থনীতির খুবই শক্ত একটা সম্পর্ক আছে। ভাষার নিজস্ব একটা শক্তিও আছে। যেমন, ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ শাসন করতে লাগল তখন তারা ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করল। ফলে তখনকার শিক্ষিত মুসলিম সমাজ, যাদের ভাষা ছিল ফার্সি তারা হিন্দুদের চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চাকরিতে পিছিয়ে পড়ল। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দুকে প্রতিহত করার কারণও ছিল মূলত অর্থনৈতিক। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও চাকুরিতে বাঙালিরা নির্ঘাত পিছিয়ে পড়ত। তাছাড়া আত্মপরিচয় ও আবেগের বিষয় তো ছিলই। আরবি হরফে বাংলা লিখতে হতো, কল্পনা করা যায়?
পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আন্দোলনের ধরণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র কয়েকমাস পরেই যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব দেন, তখনই ঐ সভা থেকেই "না না" বলে প্রতিবাদ হয়েছিল। সেদিন জিন্নাহ বিব্রত হয়েছিলেন, বক্তৃতার মাঝে কয়েক মিনিট চুপ করে থেকেছিলেন। প্রসঙ্গটি উল্লেখ করছি এজন্য যে, আমরা সব সময় বলি, "একুশ মানে মাথা নত না করা"। একুশের এই শিক্ষাই আমাদের পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল। আমাদের অধিকার বিষয়ে যে সচেতনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার যে স্পৃহা, যে সাহস তা-ই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এনে দিয়েছিল। ভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের যে তীব্রতা ছিল, পরবর্তী অন্যান্য আন্দোলনেও সেই তীব্রতা, দুঃসাহসিকতা লক্ষ্য করা গেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা মাত্র নয় মাসে সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হই। পৃথিবীতে বহু জাতি আছে যারা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সামষ্টিকভাবে সচেতন নয়, তাদের আন্দোলনে কোন তীব্রতা নেই, এবং সবচেয়ে বড় বিষয় তাদের যোগ্য নেতা না থাকার কারণে তারা দাবি আদায় করতে বার বার ব্যর্থ হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অনেক প্রতিবেশী দেশের মধ্যেও এমন ব্যর্থতা আমরা দেখতে পাই। অনেক আন্দোলনই এরই মাঝে হারিয়ে গেছে। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর মতো একজন মহান নেতা পেয়েছিলাম। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বলছিলাম ভাষার শক্তির কথা, একুশের চেতনার কথা। একুশের পথ বেয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা সুবর্ণ জয়ন্তীতে পৌঁছে গেছি। নিংসন্দেহে এরই মাঝে আমাদের অর্জনও কম নয়। আত্মপরিচয়ে আমরা পরিচিত হতে পেরেছি, অনেকটাই স্বনির্ভর হতে পেরেছি। বিশ্ববাসীকে মাতৃভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব বুঝাতে আমরা সক্ষম হয়েছি এবং বিশ্বে মাতৃভাষার বিষয়ে আমরাই নেতৃত্ব দিচ্ছি। দেশ অর্থনৈতিকভাবে যত শক্তিশালী হবে, বাংলা ভাষার গুরুত্বও তত বাড়বে। আমরা বর্তমানে ইংরেজি, আরবি, জাপানিজ, চায়নিজ, কোরিয়ান ভাষা কেন শিখি? কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য। দেশ উন্নত হলে একসময় অন্য ভাষাভাষীরাও বাংলা শিখতে বাধ্য হবে। বিদেশীরা আমাদের দেশে পড়তে আসবে, চাকরি করতে আসবে, আমরা তাদেরকে আইএমএল-এ পাঠিয়ে দেব বাংলা শেখার জন্য যেমনটা বর্তমানে আমরা বিদেশে গেলে করি। খবরে প্রকাশ, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি পেতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে টাকায়; বাৎসরিক ৬০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। আমরা ধনী হলে নিশ্চয়ই বাংলাও একদিন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে আমাদের ব্যর্থতাও কম নয়। আমরা আজও বাংলাকে সর্বস্তরের যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার পেছনেও পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও বিশ্বায়ন জড়িত। কারণ, যে ছেলে ইংরেজিতে ভাল, সে সবক্ষেত্রেই এখনও এগিয়ে থাকে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালগুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনাও হয় অর্থনৈতিক কারণেই। ইংরেজিতে পড়াশোনা করলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে বা চাকরি নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। তাছাড়া বাংলা ভাষায় আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ বই নেই। ফলে অধিকাংশ তথ্যই আমাদেরকে অন্যদের কাছ থেকে জানতে হয়। আমরা নিজেরা জ্ঞান সৃষ্টিতে তেমন এগিয়ে যেতে পারিনি। আমরা যদি জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হতাম তখন বাংলায় লেখা তথ্য অন্যরা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করতো।
ভাষা আন্দোলনের যে তীব্রতা ছিল, "মাথা নত না করার" যে প্রত্যয় ছিল তা বর্তমানে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। সমাজে শোষণ নিপীড়ন এখনও আছে কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে আমরা কি তীব্র প্রতিবাদ করতে পারছি বা করছি? আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে তেমন জোরালো কোন মতামত বা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ধারণা ভালো নয়, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের হাতে। দুর্নীতি দমনে আমাদের উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য নেই। প্রশাসনের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ, কেউ কেউ দুর্নীতির দায়ে বিচারে শাস্তিও পাচ্ছেন। সামাজিক নিরাপত্তা এখনও নিশ্চিত হয়নি, ধনী-গরীবের ব্যবধান এখনও ঘোচেনি, নারীর ক্ষমতায়ন এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ ভাষা আন্দোলনের পেছনে বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশাই তো ছিল।
একুশের চেতনায় একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। আমরা অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে এখনও সফল হতে পারিনি। আমাদের চলনে বলনে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় বিষয়ে আমরা এক ধরনের দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে আছি। সরল বিশ্বাসে কোন একটি বিষয় জানতে চাইলেও দশবার ভাবতে হয়। ভাষা আন্দোলনের পর গত ঊনসত্তর বছরে আমাদের একুশের চেতনায় ভাটার টান। ফেব্রুয়ারি মাস তথা একুশে ফেরুয়ারিতেই আমাদের চেতনা জাগ্রত হয়, অন্যসময় ভুলে থাকি। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতেই নয়, অন্যান্য সময়ও একুশের চেতনা, একুশের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আমাদের আরও বেশি বেশি আলোচনা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে একুশের চেতনাকে সঞ্চারিত করতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে একুশের চেতনাকে আমরা যত বেশি জাগ্রত করতে পারব, আমাদের সুবর্ণ জয়ন্তী ততই সফল ও স্বার্থক হবে।
আক্ষেপ হয় যখন দেখি আমাদের একুশ লুট হয়ে যাচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শহীদ দিবস। ১৯৯৯ সালে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে আমাদের আবেগের এবং শোকের এই দিবসটির ওপর কর্পোরেটদের দৃষ্টি পড়েছে। শোকের একুশ এখন যতটা না পালিত হয় তারচেয়ে বেশি উদযাপিত হয়। বাস্তবতাকে হয়তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না তারপরেও একুশের চেতনাকে ধারণ করতে হবে। তবেই আমাদের সুবর্ণ জয়ন্তীও সফল ও সার্থক হবে। আর বৈষম্যহীন স্বনির্ভর বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমরা গলা ছেড়ে গাইব, 'মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা'!