Published : 19 Nov 2020, 12:14 AM
গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসব দেশপ্রেমিক বাঙালি সৈনিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে গোপন বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের অন্যতম কর্নেল (অব.) শওকত আলী মিয়া। এই আন্দোলনের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরিণতিতে উদ্ভব হয়েছিল কথিত ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য)। সামরিক-বেসামরিক ৩৫ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে দায়ের করা এই মামলার এক নম্বর অভিযুক্ত ছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির দূত শেখ মুজিবুর রহমান এবং ২৬ নম্বর অভিযুক্ত ছিলেন কর্নেল (অব.) শওকত আলী। মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তান সেনাদের হাতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তার ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান।
শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারি শরীয়তপুর জেলাধীন নড়িয়া উপজেলার লোনসিং গ্রামে। বাবা মুন্সি মোবারক আলী ছিলেন ব্যবসায়ী। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৯৫৩ সালে লোনসিং কেপুপাড়া ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্টিক পাস করেন। পরে তিনি ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় নিজ এলাকায় মিছিল সংগঠিত করেন। পরে ঢাকায় এসে কায়েদে আজম (পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী) কলেজের ছাত্র থাকাকালে ওই কলেজে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি কম ও এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
শওকত আলী ১৯৫৮ সালে বি কম পরীক্ষা দিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ৫৯ সালের ২৪ জানুয়ারি কমিশন পান এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হন। চাকরি জীবনের প্রথম ও শেষ দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনানিবাসে এবং ৬৩ সাল থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিভিন্ন সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার গোপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন এবং ১৯৬৮ সালের ১০ জানুয়ারি করাচিতে গ্রেপ্তার হন। সে সময় তিনি করাচির কাছে মালির সেনানিবাস এলাকায় ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় অর্ডিন্যান্স স্কুলের প্রশিক্ষক ছিলেন। এর দু-এক মাসের মধ্যে তার মেজর হিসেবে পদোন্নতির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ৬৯ এর জুনে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে যুক্ত অন্যদের সঙ্গে তাকেও অবসর দেওয়া হয়।
আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পর তিনি যশোরের রাজাঘাট এলাকায় একটি কার্পেটিং জুট মিলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরি করেন। চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হলে তিনি এতে অংশ নেন।
স্বাধীনতার জন্য গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আসক্তিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ২০০৫ সাল থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি (লেখক)। ২০০৭ সালের ১০ মার্চ ঢাকার উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরে তার বাসভবন 'পালাশী অ্যাপার্টমেন্ট' এ বসে এ লেখককে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সাক্ষাৎকারে জানা যায় পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের সঙ্গে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ, বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে ক্ষোভ, স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সংশ্লিষ্টতাসহ নানান তথ্য।
বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান
স্বাধীনতার জন্য গোপন বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় নিজের জড়িত হওয়ার পটভূমি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ছাত্রজীবন থেকে আমি তরুণ শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। তখন থেকেই আমার সব সময় মনে হয়েছে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সব দিক দিয়ে বিরাট এক বৈষম্য বিরাজ করছে। আমরা যেখানে চাকরি করতাম, সেখানে বাঙালিদের সংখ্যা এত কম ছিল যে, তা ক্ষেত্রবিশেষে চার থেকে ছয় জনের বেশি ছিল না। পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের এত কম প্রতিনিধিত্ব দেখে আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগে। এক জায়গায় বাঙালি-অবাঙালি চাকরি করতে গিয়ে ওদের (পশ্চিমাদের) আচার আচরণে মনে হলো যে, আমরা মাইনরিটি (সংখ্যালঘু) আর ওরা মেজরিটি (সংখ্যাগুরু)। বাংলা ভাষার জায়গায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা, অর্থনৈতিক শোষণসহ বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার নানান অপচেষ্টা আমার মনে রেখাপাত করে। আমার মনে হলো এভাবে পাকিস্তান নামক এক দেশে বাঙালিরা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে না। কাজেই দেশকে স্বাধীন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এরই মধ্যে দেশে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের নানা পর্যায় আমাকে আরও উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালির মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। অন্যদিকে আমরা বাঙালি যারা সশস্ত্র বাহিনীতে ছিলাম তাদের অনেকেই ছয় দফার কথা জানতে পেরে এ নিয়ে আলোচনা করি এবং ছয় দফাকে সমর্থন করি। আমাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন বাংলাদেশ পাওয়ার সংকল্প দৃঢ় হয়। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার যে চেতনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে আমার মনে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব।
এরই মধ্যে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালেই আমি জানতে পারি যে, পাকিস্তান নৌবাহিনীতে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছে যাঁরা সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। ওই সময় আমি কুমিল্লা সেনানিবাসে ক্যাপ্টেন পদে চাকরিতে নিয়োজিত। সেখানে মেজর ডা. শামসুল আলম (মামলার ২০ নং আসামি) নামে আমার এক বন্ধুই (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল) মূলত আমাকে ওই বিপ্লবী সংস্থার কথা জানিয়ে বলেন যে, তিনিও ওই সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। কালবিলম্ব না করে আমিও তাদের সঙ্গে যুক্তি হই এবং কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকরিরত অন্য বাঙালি সহকর্মীদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। তৎকালীন লে. মাহবুবুর রহমানও (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধান) আমাদের সদস্য হয়েছিলেন। যদিও তিনি সাক্ষী প্রমাণের অভাবে গ্রেপ্তার বা মামলার আসামি হননি।'
কর্নেল (অব.) শওকত আলী জানান, তার জানামতে বিপ্লবী সংগঠনের সামরিক দিক থেকে মূল সমন্বয়ক ছিলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কাজের এক পর্যায়ে কমান্ডার মোয়াজ্জেম, স্টুয়ার্ড মুজিব, সুলতান উদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদ বাবুল, কমান্ডার রউফ, লে. মতিউর রহমান প্রমুখের সঙ্গে জনাব শওকতের যোগাযোগ ঘটে।
সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী লীগকেও জানানো যাবে না
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সময়কাল সম্পর্কে জনাব শওকত আলী বলেন, 'জানতে পেরেছিলাম ৬৪ সাল থেকে আমাদের নৌবাহিনীর সহকর্মীরাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি যখন করাচিতে রাজনৈতিক সফরে যেতেন তারা বৈঠক করতেন এবং তার অনুমতি নিয়েই তারা অগ্রসর হয়েছেন। তবে বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় হওয়ায় সবাই কখন, কোথায় কী হচ্ছে সবকিছু জানতেন না। জানার সুযোগও ছিল না। আমাদের মধ্যে যে বৈঠক হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার যে পরিকল্পনা তা বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতেই করা হয়েছে এবং যা কিছু হবে বঙ্গবন্ধুর নামে হবে। দেশ স্বাধীন হবে তার নামে। তবে এসব কিছুই গোপন থাকবে। কারণ এটা এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার যা গোপন রাখাটা ছিল জরুরি। আমাদের তৎপরতার বিষয় জানাজানি হলে পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোই যেত না। তাই এমনকি বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগকেও তখন বিষয়টি না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হয়তো ভাবছিলেন, এ নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা করলেও তখনকার পরিস্থিতিতে তা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এত গোপনীয়তার মাঝেও আমরা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছি। সমস্ত ঘটনা ফাঁস হয়ে গেল।'
কর্নেল (অব.) শওকতের মতে, 'যে কোনো বিপ্লবী কর্মকান্ডের চূড়ান্ত সফলতা না আসা পর্যন্ত কৌশলগত কারণে তা গোপন রাখতে হয়। একই কারণে বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় 'স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস' বা 'বিপ্লবী পরিষদ' ইত্যাদি নামে পৃথক সংগঠন তৈরি হয়েছিল যা আমরা আগে জানতাম না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন অধিকাংশ রাজনৈতিক সহকর্মীও জানতেন না তিনি কখন, কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন। আসলে আমি যেটা বুঝেছি, বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। আর এ জন্য তিনি এক একটা গ্রুপ কিংবা এক একটা সংগঠনকে এক একভাবে সংগঠিত ও উজ্জীবিত করেছিলেন।'
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ প্রসঙ্গে
ভারতের সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্রকারী খ্যাত আসামিদের যোগাযোগ প্রসঙ্গে কর্নেল (অব.) শওকত জানান, ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার নিজস্ব পরিকল্পনা ও সূত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন। সেটা আইউব খানের সামরিক শাসনের প্রথম দিককার ঘটনা। বঙ্গবন্ধু নিজেই আমাদের বলেছিলেন যে, তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ভারতের ভেতর দিয়ে লাহোরও গিয়েছিলেন। তার সেই আগরতলা বা ভারতে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের আলোচ্য আগরতলা মামলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। তবে আমাদের বিপ্লবী সংগঠনের পক্ষ থেকে দুজন লোক (আলী রেজা ও স্টুয়ার্ড মুজিব) আগরতলা যান অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। আগরতলা মামলার অভিযোগপত্রের মধ্যেও বিষয়গুলো এসেছে। তবে পরবর্তী সময়ের নানা ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের একটা যোগাযোগ অবশ্যই ছিল, যাতে প্রয়োজনের সময় ভারত আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল শওকত
কর্নেল (অব.) শওকত আলী মিয়া ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন পর্যন্ত তিনি যশোরের রাজঘাট এলাকায় ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের আগাখানীদের একটি কার্পেটিং জুট মিলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরি করতেন। ১৯৬৯ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরি চলে যাবার পর তিনি ওই জুট মিলে চাকরি নেন এবং পরিবার নিয়ে মিল কম্পাউন্ডে থাকতেন। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তিনি আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা দেখে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা চান তিনি। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে কর্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করলে ওসমানী জানান, 'রাজনৈতিকভাবে একটা সমাধান হয়ে যেতে পারে। যুদ্ধের প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। তবে দরকার হলে খবর দেওয়া হবে।' পরে আগরতলা মামলার অন্য দুই আসামি ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান (পরে ব্রিগেডিয়ার ও রক্ষীবাহিনী প্রধান) এবং ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদার সঙ্গে (পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল) আলাপ করলে তারাও স্বচ্ছ কোনো ধারণা দিতে পারেননি। বললেন, 'প্রয়োজনে খবর দেওয়া হবে।' শেষে অনেকটা হতাশ হয়েই জনাব শওকত যশোর ফিরে আসেন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ-হামলা প্রতিরোধের ব্যাপারে প্রাথমিক পরিকল্পনা নেন।
কর্নেল শওকত বলেন, 'আমার নিজস্ব একটা চিন্তা ছিল যুদ্ধ শুরু হলে কোন অবস্থায় কী করতে হবে। এ নিয়ে স্থানীয় এমপি শাহ হাদিউজ্জামানসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিকবার কথাও বলি। আমাদের কাছেই ছিল যশোর সেনানিবাস এবং খুলনায় ছিল পাকিস্তানিদের একটি ব্যাটেলিয়ান। তাও যশোরের কাছাকাছি। ধারণা ছিল, যশোরের সঙ্গে খুলনার রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া গেলে পাকিস্তানিরা বেকায়দায় পড়বে। সে অনুযায়ী ২৬ মার্চই আমরা জনগণের সহযোগিতায় যশোর ও খুলনার মধ্যকার সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিই। কিন্তু যশোর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের একদল রেললাইন ও আর একদল সড়ক পথ মেরামত করতে করতে ২৭ মার্চই রাজঘাট এলাকায় চলে আসে। এসেই তারা আমাদের জুটমিল ঘেরাও করে।
কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন না দেওয়ায় এবং অন্যদিকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরে আমাদের ওপর শ্রমিকদের প্রচণ্ড চাপ ছিল পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি এবং অন্য এক ব্রিটিশ নাগরিক (মহাব্যবস্থাপক) ২৬ মার্চ দিনভর তদবির করে টাকা যোগাড় করে ২৭ মার্চ শ্রমিকদের পাওনা মেটানোর ব্যবস্থা করি। দুপুরে বাসায় খেতে এসে পাকিস্তানিদের ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে আমার স্ত্রীর পরামর্শে সবাইকে ঘরে রেখে আমি কৌশলে চলে যাই কাছে অবস্থিত ভৈরব নদীতে। সেখানে আমাদের জুটমিলের একটি নৌকা বাধা ছিল। ২৬ মার্চই সেটি ঠিক করে রেখেছিলাম অবস্থা বেগতিক দেখলে মাদারীপুরে নিজ এলাকায় চলে যাবার জন্য। তখনও প্রাথমিক ধারণা ছিল-ভারতে গিয়ে নয় বরং দেশের ভেতরে থেকে গেরিলা যুদ্ধ চলবে। নৌকায় উঠে দেখি সেখানেও দুদিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে গেছে। পরিবার থাকলে হয়তো ধরা পড়ে যেতাম। কোনো রকমে তাদের নজর এড়িয়ে নৌকায় করে অপর পাড়ে চলে আসি। পরে ওপার থেকে আসা অন্য লোকদের কাছে সৈন্যরা ঘুরে ফিরে চলে গেছে বলে জানতে পেরে আবার আর একটি ছোট নৌকা সংগ্রহ করে বাসায় আসি এবং একই নৌকায় করে স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। এর আগে বাসায় গিয়ে জানতে পারি, পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার খোঁজে বাসায় এসে সবাইকে গালিগালাজ করে এবং ভয়ভীতি দেখায়। তারা ছেলেদের দিয়ে বাসায় লাগানো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, দেওয়ালে সাঁটা কালো পতাকা ইত্যাদি নামিয়ে ফেলে। দোতলায় একজন সহকারী ব্যবস্থাপক থাকতেন, তাকেও মারধর করেছে তারা। যাওয়ার সময় শাঁসিয়ে যায়, বাসা ছেড়ে যেন কেউ না যায়। যা হোক, ওরা চলে যাবার খবর জেনে আমি স্ত্রী-ছেলেদের নিয়ে ভৈরব নদীর অপর পাড়ে আসি। সেখান থেকে আর একটি বড় নৌকা নিয়ে তিনদিন পর শ্বশুর বাড়ি নড়িয়া পৌঁছি। সেখানে স্ত্রী-সন্তানদের রেখে চলে আসি মহকুমা সদর মাদারীপুর। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা (পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী) প্রয়াত আবদুর রাজ্জাকসহ স্থানীয় কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে দেখা হয় সেখানে। আমাকে পেয়ে তারা সবাই খুশি। তারা আমাকে মাদারীপুর মহকুমার কমান্ডার নিয়োগ করেন। আমি মাদারীপুর কলেজে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় সদর দপ্তর স্থাপন করি। সেখানে থেকে অস্ত্র সংগ্রহ, ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, মুক্তিবাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ করা ইত্যাদি দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। মাদারীপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক (পরে সচিব) সৈয়দ রেজাউল হায়াতসহ পুলিশ ও স্থানীয় জনগণ আমাকে সার্বিক সহযোগিতা দেন। এক পর্যায়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, বেগমগঞ্জ ফেনী, পরশুরাম হয়ে বেলোনিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছি। বিএসএফ আমাদের কোনো বাধা দেয়নি। যাওয়ার পথে যেদিন চাঁদপুর পৌঁছি সেদিন পাকিস্তান বিমানবাহিনী চাঁদপুর আক্রমণ করে। সীমান্ত পার হওয়ার পর 'বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি' নামে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের (স্টুয়ার্ড মুজিবসহ) 'জয় বাংলার লোক' সম্বোধন করে অভ্যর্থনা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সেখান থেকে জিপে করে আগরতলা যাই এবং খোঁজ খবর নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে সার্বিক পরিস্থিতি এবং করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করি। তিনি আমাকে কুমিল্লা সীমান্তে অবস্থানরত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক এবং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করে মাদারীপুর এলাকায় কাজ করার জন্য তার সহযোগিতা নিতে বলেন। আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন আগরতলা মামলার ৩নং আসামি স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দেখা করার পর তিনি আমাকে কিছু দিকনির্দেশনা ও সঙ্গে কিছু গোলাবারুদ ও অস্ত্র দিয়ে মাদারীপুর পাঠিয়ে দেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য ৫০ জন করে এক একটি ব্যাচ তার দপ্তরে পাঠাতে বলেন।
আমি এবং স্টুয়ার্ড মুজিব দুটি বস্তায় এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ মাথায় নিয়ে ৯ এপ্রিল রওনা দিয়ে অনেক অজানা-অচেনা পথ পাড়ি দিয়ে বহু কষ্টে সম্ভবত ১২ এপ্রিল মাদারীপুর পৌঁছি। সেখানে ফণীভূষণ মজুমদার এমপি (পরে মন্ত্রী), আওয়ামী লীগ নেতা আসমত আলী খান এমপি, এমএ মান্নানসহ (টুনু মান্নান) স্থানীয় অনেকের সহযোগিতায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু করি।'
কর্নেল (অব.) শওকতের দেওয়া তথ্য মতে, কয়েকদিনের মধ্যে ফরিদপুর শহর পাকিস্তানিদের দখলে আসে এবং মাদারীপুরও পতন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে মে মাসের মাঝামাঝি আবার ২নং সেক্টরের সদর দপ্তরে চলে যান। সেখানে মাদারীপুর এলাকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে পাঠানো এবং ২নং সেক্টরে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে তিনি কোলকাতা ৮নং থিয়েটার সড়কে কর্নেল ওসমানীর সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শওকত আলী স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে থেকে যান এবং পর্যায়ক্রমে কর্নেল হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অক্টোবরেই তাকে অকাল অবসর দেওয়া হয়। তিনি ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং পর পর পাঁচবার (১৯৭৭, ১৯৯৯, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে) জাতীয় সংসদের সদস্য এবং ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থতাজনিত হাসপাতালে (সিএমআইচ) ভর্তি ছিলেন। ১৬ নভেম্বর প্রায় ৮৩ বছর বয়সে এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী মারা যান।