Published : 11 Oct 2020, 06:24 PM
সারাদেশ উত্তাল। ক্ষোভে ফুঁসছে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। বিশেষ করে, তরুণ-যুবারা। শহরে-বন্দরে মিছিল-শ্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে রাজপথ। হাজারো কন্ঠে গগনবিদারী রবে আওয়াজ উঠছে: নারী নির্যাতক ও ধর্ষকদের অবিলম্বে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে, জনসম্মুখে এ শাস্তি কার্যকর করতে হবে, প্রয়োজনে ধর্ষণকাণ্ডের দ্রুত বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করতে হবে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি বিধানকল্পে বিদ্যমান আইনে সংশোধনী আনতে হবে। আনন্দের বিষয়, এখন পর্যন্ত এসব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মোটামুটিভাবে শান্তিপূর্ণ। মনে হচ্ছে, অহিংস প্রতিবাদ-বিক্ষোভও যে কতটা শক্তিশালী বার্তা দিতে পারে তা দেশবাসী আরো একবার দেখতে পেল।
নিকট অতীতের আরও কিছু চাঞ্চল্যকর কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা গেছে, সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনতার আবেগের প্রতি সাড়া দিতে খুব কমই সময় নিয়েছে। ঘটনার পরিকল্পক ও সংগঠক বলে অভিযুক্তদের অনেকেই এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে। এতে করে এসব সন্ত্রাসীদের দমনে ও আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়ার বিষয়ে সরকার যে দৃঢ়সংকল্প তাতে সন্দেহের অবকাশ কমই থাকছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপাতদৃষ্টিতে সরকার এ ধরনের অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণের পরও কেন এসব নিয়ন্ত্রণে আসছে না, একের পর এক ঘটেই চলেছে?
বেগমগঞ্জের ঘটনায় যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হল, একজন অসহায়, নিরীহ নারীর ওপর তার নিজ গৃহে এরকম বর্বর নির্যাতনের পর পুরো একটি মাস চলে গেলেও কেন কেউই টু শব্দটিও করল না। পুলিশ প্রশাসন কিংবা মিডিয়া কেউই কোন অভিযোগ পেল না, এমনকি জানতেও পারল না। পাড়া-পড়শি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মোড়ল-মাতবর, জনপ্রতিনিধি সবাই নির্বাক হয়ে থাকল। খবরে দেখা যাচ্ছে, আশপাশের লোকজন এখনও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না, অনেকেই তো স্বীকারই করছে না যে, তাদের জ্ঞাতসারে এমন কোন ঘটনা ঘটেছে। হয়তোবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনার ভিডিওটি প্রকাশ না পেলে পুরো বিষয়টি চিরকাল অন্ধকারেই থেকে যেত।
অনেকেই বিস্মিত হলেও ওয়াকিবহাল মহল পুরো বিষয়টি নিয়ে নির্যাতিত নারী ও এলাকাবাসী নির্বাক থাকায় খুব বেশি অবাক হচ্ছেন না। ঐ জনপদের মানুষ যে এখনো মুখ খুলতে চাচ্ছে না তাতেই কি বুঝা যাচ্ছে না, সন্ত্রাসীরা এলাকায় কেমন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে? আপনি কি ভাবছেন, এসব অসহায় মানুষ থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি পর্যন্ত যাওয়ার সক্ষমতা রাখে? এটা কেবল তখনই ঘটতে পারত যদি এসব সন্ত্রাসীদের চ্যালেঞ্জ করার মতো একটা অংশ এলাকায় বিদ্যমান থাকত? শুধু কি তাই? যদিও আমরা জানি, 'পুলিশ জনগণের বন্ধু', এ প্রবচনটাও এ দেশে বহুল প্রচলিত: 'থানার পাশ দিয়ে কানাও হাঁটে না'। পুলিশ কিংবা আদালতে যখন এসব বিপন্ন মানুষ যাবে, তার ফলে যে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর আরও উগ্রভাবে চড়াও হবে না সে নিশ্চয়তা কি আমরা দিতে পারছি? মামলা-মোকদ্দমা চালানোর জন্য যে অর্থের সংস্থান প্রয়োজন, তা এসব 'দিন আনে দিন খায়' কিসিমের লোক কোত্থেকে করবে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এসব কারণে গাঁও গেরামে যেসব বিবাদ-বিসংবাদ হয় তার খুব কমই থানা-পুলিশ কিংবা কোর্ট-কাছারি পর্যন্ত গড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এলাকার মোড়ল-মাতবর, চেয়ারম্যান-মেম্বাররাই স্থানীয়ভাবে বিচার-সালিসের মাধ্যমে এসব নিষ্পত্তি করে। সাধারণ মানুষ তাদের কাছেই নালিশ নিয়ে যায়। ন্যায্য কোন মীমাংসা হলে তো ভালো, নইলে উপরওয়ালার কাছে ছেড়ে দেয়া ছাড়া এদের আর কিইবা করার থাকে?
এখানেই সমস্যার মূল ও সমাধান নিহিত। বিষয়টি কি এমন, স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে? এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের চোখ রাঙানিকে ভয় পাচ্ছে অথবা তাদের হাতে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে? কিংবা, এমনও তো হতে পারে যে, সন্ত্রাসীরাই সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পদসমূহ দখল করে বসেছে। মোট কথা, যেভাবেই ঘটুক না কেন, স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস ও অপরাধকাণ্ডের বিরুদ্ধে যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটিকে পুনরুজ্জীবিত করা না গেলে শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা-প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সম্ভব হবে তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। এখানেই চলে আসে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। সরকারকে স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসের সাথে জড়িত নয় কিংবা সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন না এমন লোকদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। দলীয় বিবেচনার উর্দ্ধে উঠে সন্ত্রাসীদের উপর ক্র্যাকডাউন করতে হবে। সমাজে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এ বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে, সন্ত্রাসের সাথে ন্যূনতম সংশ্রব আছে এমন যে কোন ব্যক্তি সরকার ও প্রশাসনযন্ত্রের কাছে অপাঙ্ক্তেয় বিবেচিত হবে। যদিও আমরা খুব স্পিরিট নিয়ে বলে থাকি, 'সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই, সন্ত্রাসীদের কোন দল নেই', অনেকেই মনে করেন, সন্ত্রাসীরা সবসময় একটি দলেই ভীড় জমায় যে দলটি স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী – সেটা সরকারি দলই হোক কিংবা অন্য কোন দল।