যে মানুষেরা রাষ্ট্রের সকল অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থাকবেন বলে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে, ওই মানুষগুলোই নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে কী পরিমাণ অনিশ্চয়তার ভেতরে থাকে, সে খবর কতজন রাখেন!
Published : 03 Oct 2024, 12:13 AM
এনটিভির সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের মৃত্যুসংবাদটি শোনার পরে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বরিশালের খ্যাতিমান সাংবাদিক লিটন বাশারের মুখ। লিটন বাশার মারা গেছেন ২০১৭ সালের জুনে। তার সোয়া সাত বছর পরে সীমান্ত খোকনের মৃত্যুর সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? লিটন বাশারের মৃত্যুর কারণ ছিল হার্টের অসুখ। আর সীমান্ত খোকনের মৃত্যুটি আত্মহনন। কিন্তু তারপরও সীমান্ত খোকনের মৃত্যুসংবাদ শোনার পরে কেন আমরা লিটন বাশারের কথা স্মরণ করব— ওই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে জানতে হবে খোকন কেন নিজেই নিজের সীমান্ত ঠিক করে দিলেন। অর্থাৎ কেন তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিলেন?
সীমান্ত খোকন মারা গেছেন ৫৩ বছর বয়সে। ২০১৭ সালে যখন লিটন বাশারে মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স ৪৬। বেঁচে থাকলে এখন তার বয়সও হতো ৫৩। অর্থাৎ সীমান্ত খোকন ও লিটন বাশার ছিলেন সমবয়সী। কিন্তু দুজনের মৃত্যুর মাঝখানে ব্যবধান ৭ বছর।
সীমান্ত খোকন আমার চেয়ে বয়সে বড়। কিন্তু দারুণ বন্ধুবৎসল। নবম সংসদে আমরা একসঙ্গে সংসদ ও নির্বাচন কমিশন কাভার করেছি। সীমান্ত ভাই তখন আরটিভির সিনিয়র রিপোর্টার। আমি এবিসি রেডিওতে। আমাদের অফিসও পাশাপাশি। কারওয়ান বাজারে। ওই কারণে প্রায়ই অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে সীমান্ত ভাইয়ের গাড়িতে অফিসে ফিরতাম। সংসদে নিয়মিত ছিলাম বলে কবে কোন কমিটির মিটিং, এজেন্ডা কী, বড় কিছু হবে কিনা ইত্যাদি জানার জন্য সীমান্ত ভাই ফোন করতেন। গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে যেতেন এবং আমাদের দুজনের টাইমিং মিললে তিনি সাধারণত আমাকে কারওয়ান বাজার স্টার কাবারের সামনে থেকে পিক করতেন।
একসময় সীমান্ত ভাই রিপোর্টিং ছেড়ে নিউজ এডিটর হয়ে বসে গেলেন। আমিও তা-ই। ফলে আমাদের আর মাঠেঘাটে কিংবা অ্যাসাইনমেন্টে দেখা হতো না। ব্যক্তিগত পরিসরে যোগাযোগটাও সেভাবে আর ছিল না। এমনকি ফেসবুকেও না। কিন্তু তিনি যে এনটিভিতে কাজ করছেন, শারীরিক কিছু সমস্যা আছে— এসব অল্পবিস্তর জানতাম। এর মধ্যে মঙ্গলবার দুপুরে তার মৃত্যুসংবাদটি কানে আসে। এক অদ্ভুত বেদনাবোধ তৈরি হয়। গভীর মমতামাখা তার মুখখানি ভেসে ওঠে। আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার, কথা কম বলা এবং নির্বাচন কমিশনের পুরোনো ভবনের গাছতলায় হঠাৎ কাউকে জোর গলায় ডাক দেয়া; লম্বা ছিলেন বলে একসঙ্গে অনেকগুলো টিভি ও রেডিওর মাইক্রোফোন সিইসির সামনে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা— সবমিলিয়ে সীমান্ত ভাই একজন অসম্ভব ভালো মানুষ, সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, আন্তরিক। কিন্তু কী এমন ঘটল যে এরকম একজন মানুষকে শেষমেষ আত্মহননের পথেই বেছে নিতে হলো?
সীমান্ত খোকনের মৃত্যু নিয়ে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক।
১. এনটিভির বার্তা সম্পাদক সীমান্ত খোকনের মৃতদেহ মিলল নিজের ঘরে: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
২. সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার: প্রথম আলো।
৩. সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার: সমকাল।
৪. এনটিভির বার্তা সম্পাদক সীমান্ত খোকনের মৃত্যু: যুগান্তর।
৫. সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের রহস্যজনক মৃত্যু: কালবেলা।
৬. এনটিভির বার্তা সম্পাদক সীমান্ত খোকন আর নেই: এনটিভি অনলাইন।
সীমান্ত খোকন সবশেষ যে টেলিভিশনে (এনটিভি) কাজ করতেন, তাদের অনলাইনের খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় তিনি নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি স্ত্রী এবং দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তিনি শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নে। সীমান্ত খোকন জাতীয় প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ সাংবাদিক ফোরাম ঢাকার সাবেক সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন।
পুলিশের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবর বলছে, সকাল থেকে সীমান্ত খোকনের রুমের দরজা বন্ধ ছিল। দুপুর দেড়টার দিকে পরিবারের সদস্যরা চাবি দিয়ে রুমে প্রবেশ করে দেখেন তিনি ফ্যানের সঙ্গে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস নিয়েছেন। পরে পুলিশকে জানালে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
তার কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলা গেছে, ২০১৯ সালে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর কোভিডেও আক্রান্ত হন। সব মিলিয়ে তার প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শারীরিক দুর্বলতা। কোনোভাবেই নিজেকে ‘ফিট’ মনে করতেন না। শারীরিক এই দুর্বলতা তাকে মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। বছর কয়েক ধরে তিনি কাজেও খুব একটা মনোযোগ দিতে পারতেন না। কিন্তু সহকর্মীদের আন্তরিকতায় নিউজরুমে তার ঘাটতি বোঝা যেত না। সহকর্মী এবং কর্তৃপক্ষও তাকে আগলে রাখতেন। যখনই ছুটি চেয়েছেন, পেয়েছেন। অক্ষমতার কারণে একাধিকবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু সহকর্মীরা বারবার সেটি আটকে দিয়েছেন। এমনকি কর্তৃপক্ষও তাকে জানিয়েছিল যে তিনি যতদিন খুশি ছুটি নিতে পারেন। চাকরি ছাড়ার প্রয়োজন নেই। এরকম একটি আন্তরিকতাপূর্ণ কর্মপরিবেশও খোকনকে তার চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণে বাধা দিতে পারল না! বুধবার দুপুরে এনটিভি ভবনের নিচে তার জানাজায় একাধিক সহকর্মীর চোখে অশ্রু দেখেছি।
একটু পেছনে ফেরা যাক।
২০১৭ সালের ২৭ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান লিটন বাশার। সবশেষ তিনি ইত্তেফাকের বরিশাল অফিসের রিপোর্টার ছিলেন। যে বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, বাংলাদেশের গড় আয়ু (৭২) বিবেচনায় সেটি যথেষ্ট কম। একজন প্রাণবন্ত, সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষের হৃদয়যন্ত্রে যে গুরুতর ব্যাধি বাসা বাঁধল, তিনি নিজে সেটি টের পেলেন না? হার্টের অসুখ এমন নয় যে, কোনো ধরনের সতর্ক সংকেত ছাড়া হুট করে একজন মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। তার মানে লিটন বাশার টেরই পাননি যে তার হার্টে বড় ধরনের অসুখ হয়েছে অথবা সেটি পের পেলেও তিনি আমলে নেননি কিংবা পারিপার্শ্বিক নানা চাপ ও বাস্তবতার কারণে তিনি হার্টের ব্যারাম এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন।
এই বয়সের একজন সাংবাদিকের মৃত্যু শুধু ওই পরিবার নয়, বরং ওই প্রতিষ্ঠানটিরও বড় ক্ষতি। লিটন বাশারের মতো আরও অনেক সাংবাদিক তরুণ বয়সে বা জীবনের এমন একটি সময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, যখন তার ঘরে এক বা একাধিক ছোট সন্তান; স্ত্রী হয়তো কোনো চাকরি করেন না। অতএব তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ওই পরিবারটি ভীষণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এর একটি বড় উদাহরণ আমার সাবেক সহকর্মী সুদীপ দে— যিনি সবশেষ গাজী টেলিভিশনে চাকরি করতেন। ২০২২ সালের ২১ অগাস্ট যখন তার মৃত্যু হয়, তখন বয়স ৩৫ বা তার কিছু কম-বেশি। তিনি যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, পারিপার্শ্বিক নানা চাপ ও অনিশ্চয়তা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল। মনে আছে সবশেষ রাজধানীর পান্থপথের একটি হাসপাতালে যখন তার সঙ্গে দেখা তখন তার এলোমেলো অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম: তোর আসলে কী সমস্যা? উদভ্রান্তের মতো সুদীপ বলছিল: ‘দেখো ভাই আমার মাথা ঠান্ডা করার ওষুধ দিছে। আমি কি পাগল?’
তার কিছুদিন পরে শুনি যে সুদীপ মারা গেছে। চিকিৎসকের ভাষায়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। কী এমন চাপ ছিল তার যে মস্তিষ্ক সেই ভার বহন করতে পারল না?
এখানে প্রশ্ন দুটি।
১. পেশাগত অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের কী পরিমাণ সাংবাদিক মানসিক চাপে আছেন এবং তার ফলে তারা কী ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন? প্রশ্নটা এ কারণে যে, কর্মক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপের পরও সাংবাদিকদের পর্যাপ্ত মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই এটা জরুরি। কেননা সাংবাদিকরা যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলছেন, যে সাংবাদিকরা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখছেন, তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কাজটা নিতে হলে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। না হলে আখেরে ক্ষতিটা ওই পুঁজিরই।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক তার একটি গবেষণার জন্য কয়েকটি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন এরকম: কোন বিষয়গুলো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মানসিক চাপে রাখে বলে আপনি মনে করেন? আমি এর জবাব দিয়েছি এরকম: চাকরির অনিশ্চয়তা ছাড়া আর যেকোনো চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা আমাদের আছে। যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ এমনকি আইনি জটিলতা মোকাবেলা করেও সাংবাদিকরা অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সারা বছরই কম-বেশি চাকরির অনিশ্চয়তার ভেতরে থাকতে হয়। তাছাড়া সর্বজনগ্রাহ্য কোনো বেতন কাঠামো নেই। হাতেগোণা কিছু প্রতিষ্ঠান ওয়েজবোর্ড মেনে চলে। কিন্তু ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় সেটিও অনুপস্থিত। একটানা অনেক বছর কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পরে যেদিন তিনি সেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে যেতে হয় শূন্য হাতে। অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সংকটও তাদেরকে মানসিকভাবে চাপে রাখে। ফলে যে মানুষেরা রাষ্ট্রের সকল অনিয়ম ও অব্যস্থাপনার বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থাকবেন বলে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে, সেই মানুষগুলোই নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে কী পরিমাণ অনিশ্চয়তার ভেতরে থাকে, ওই খবর কতজন রাখেন!
২. সীমান্ত খোকন কোনো আর্থিক অনিশ্চয়তার ভেতরে ছিলেন না। চাকরির বাইরেও তিনি বেশ স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। প্রতিষ্ঠানও তাকে সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেছ বলে তার সহকর্মীরা জানাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও তিনি বেঁচে থাকতে চাইলেন না। কেন চাইলেন না, ওই কারণেই যে প্রশ্নটা এখন সামনে আসছে তা হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের অর্ধশতকেও কি এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, যেখানে যেকোনো জটিল রোগীকেও ভরসা দেয়া যায়? একজন অসুস্থ মানুষের প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের যে দায়, সেটি কি আমরা সবাই পালন করতে পারছি?
সীমান্ত খোকনের একজন সহকর্মী বলেছেন, তার প্রেসক্রিপশন ও মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফাইল এত বড় যে, সেগুলো এক জায়গায় করলে বিরাট আকার ধারণ করবে। কিন্তু কোনো চিকিৎসায়ই তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। ওষুধের পর ওষুধ খেয়েছেন। তার মানে তার অসুখটাই কি ধরা যায়নি? ডাক্তাররা শুধু একটির পর একটি ওষুধ পরিবর্তন করেছেন? চিকিৎসায় ভালো না হয়ে একপর্যায়ে তিনি মেডিটেশন শুরু করেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই মেডিটেশনও তাকে রক্ষা করতে পারল না। মৃত্যুর কাছেই অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু কেন? তিনি নিজেকে এই পৃথিবীর জন্য, এই দেশের জন্য, প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের জন্য অপ্রয়োজনীয় মনে করলেন? তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে তিনি এখানে অপাঙক্তেয়?
‘অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’