Published : 29 Aug 2020, 05:03 PM
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে দেশের লাখ লাখ মানুষ যেমন কাজ হারিয়েছেন তেমনই দেশের বাইরে গিয়ে যারা বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেন তাদের জীবনেও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মেঘ দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে করোনা-উত্তর কালের নতুন নিয়মকানুনের কারণে প্রবাসীরা চাকুরিচ্যুত হচ্ছেন। একইসাথে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কাজ করা অভিবাসী শ্রমিকরাও রয়েছেন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। ফলে পুরো অভিবাসন খাতটাই সংকটে পড়েছে৷
দেশের অর্থনীতির চার খুঁটির অন্যতম প্রধান হচ্ছে প্রবাসে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো রেমিটেন্স। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি৷ দেশের অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে কারণগুলো রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে প্রবাসী আয়। গত অর্থবছরেও ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। হুন্ডি এবং অন্যান্য পথে পাঠানো টাকাকে হিসেবে ধরলে এর পরিমাণ আরও ৪-৫ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যাবে। গার্মেন্টস খাতের কাঁচামাল আমদানি, যন্ত্রপাতি কেনার খরচ বাদ দিলে গার্মেন্টস খাতের আয়ের চেয়ে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে।
বর্তমানে পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ প্রবাসী কর্মরত। মানে প্রায় প্রতি ১৫ জনে একজন বাংলাদেশী জীবিকার জন্যে দেশের বাইরে অবস্থান এবং কাজ করছেন। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতিবছর যে ২২ লাখ কর্ম প্রত্যাশী দেশের শ্রমবাজারে যোগ হয় সেখান থেকে প্রায় গড়ে ৭ লাখের মতো কাজের সন্ধানে পাড়ি জমায় দেশের বাইরে। এই প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে৷ এককভাবে শুধু সৌদি আরবেই আছেন অন্তত ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি৷ আরব আমিরাতে (ইউএই) আছেন ১৫ লাখ৷ ওমান মালয়েশিয়ায় আছেন ১০ লাখেরও বেশি। এরপর কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, বাহরাইনে বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্যে, কানাডাতেও বেশ ভালো সংখ্যক প্রবাসী আছেন। এই প্রত্যেকটি দেশের অর্থনীতিই করোনাভাইরাসের প্রভাবে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যার অবধারিত প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন এবং দেশের অর্থনীতিতে।
এ সঙ্কট মধ্যপ্রাচ্যে বেশি প্রকট। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় সেখানের দেশগুলোতে তৈরি হয়েছে নজিরবিহীন পরিস্থিতি৷ বন্ধ রয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান, হোটেল, মোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ কারণে এসব দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতন নেমে এসেছে অর্ধেকে, কোথাও তারও কম। কাজ বন্ধ থাকার ফলে অনেকক্ষেত্রেই এসব শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ফিরে আসা শ্রমিকদের এই সংখ্যাটা শেষ পর্যন্ত ১০ লাখেও ঠেকতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, জরুরি অবস্থায় নিয়মিত-অনিয়মিত সকল অভিবাসীর সুরক্ষা দেয়া শ্রম গ্রহণকারী দেশের কর্তব্য। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ করোনাভাইরাসের প্রভাবে বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাই ছাঁটাই করার আগে কর্মীদের অন্তত ছয়মাস সময় দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু আরব দেশগুলো অভিবাসী শ্রমিকদের প্রাপ্য অর্থের ব্যবস্থা না করেই তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কঠোর হয়ে উঠছে। ফলে অনেকটা নীরবে দেশে ফিরতে হচ্ছে এসব দেশে অবস্থান করা প্রবাসী শ্রমিকদের।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, উপসাগরীয় দেশগুলো প্রায় প্রতিটি বড় খাতে অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। তারপরও তারা অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
গত ২৭ অগাস্ট প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ২৭ অগাস্ট পর্যন্ত প্রায় ৫ মাসে ২৬টি দেশ থেকে চাকরি হারানোসহ নানা কারণে ৮৫ হাজার ৭৯০ প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬৫৭ জন নারী কর্মীও রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি মোট ২৭ হাজার ৬৫৮ জন ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আর ১৭ হাজার ৩১৭ জন ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। এই ফেরত আসা শ্রমিকদের বেশিরভাগই করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে কর্মস্থল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এসেছেন। এছাড়াও গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটিতে আসা ৬ লাখ ২৪ হাজার শ্রমিকেরও একটা বড় অংশের পুনরায় কর্মস্থলে ফেরার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মহামারীর কারণে এ বছরই দেশটিতে ১২ লাখ বিদেশী কর্মী চাকরি হারাবেন৷ সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস ঢাকায় পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, আগামী তিন বছরে দশ লাখ লোক চাকুরি হারাতে পারেন৷ তবে কাজ বন্ধ থাকলেও অনেক প্রবাসীই দেশে থাকা স্বজনদের কথা ভেবে সঞ্চয় ভেঙে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এর ফলে জুন মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রবাসী আয় বাড়ছে। যদিও বৈদেশিক কর্মসংস্থান গত চার মাস ধরেই বন্ধ৷
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে সাত লাখ লোক বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছিলেন, সেই হিসেবে প্রতিমাসে যান ৫০ থেকে ৬০ হাজার কর্মী৷ কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বিদেশে লোক পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ৷ গত চারমাসে অন্তত দুই লাখ লোক বিদেশে যেতে পারেননি৷ এর মধ্যে প্রায় আশি হাজার লোকের পাসপোর্ট-ভিসা সবই প্রস্তুত ছিল৷ এ প্রসঙ্গে বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-র মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ৭৮ হাজার ৪২৫ জন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার সবকিছু মোটামুটি চূড়ান্ত ছিল৷ করোনাভাইরাসের কারণে তারা যেতে পারেননি৷ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লগ্নি আটকা পড়েছে এজেন্সিগুলোর৷
এদিকে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসা ৭০ শতাংশ প্রবাসী উপার্জনহীন হয়ে চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা আইওএম-এর এক জরিপে উঠে এসেছে। দেশের অভিবাসনপ্রবণ ১২টি জেলায় বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের ওপর জরিপ চালিয়ে তারা এমন তথ্য পেয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইওএম বলেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশ ফেরত মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন এবং ৫৫ শতাংশ বিদেশ ফেরত বলেছেন তাদের ওপর ঋণের বোঝা রয়েছে। এতে বলা হয় মহাজন বা সুদে টাকা ধার দেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের ক্ষেত্রে ৬২ শতাংশ ঋণগ্রহীতাকে সুদ গুণতে হচ্ছে ৫০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীরা কেমন আছেন সেটা জানতে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকেও এপ্রিল ও মে মাসে ৫৫৮ জন প্রবাসী কর্মীর ওপর আরেকটি জরিপ পরিচালনা করা হয়৷ জরিপে জানা যায়, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর সময়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই কোনো আয়ের উৎস নেই৷ ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা এখন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন৷ ৩৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই৷ ৯১ শতাংশ বলেছেন, তারা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা পাননি৷
সঙ্কটময় এই সময়ে প্রবাসীদের পাশে রাষ্ট্রসহ সবার থাকাটা জরুরি৷ কারণ, যারা ফিরে আসছেন, তাদের আর্থিক ক্ষতির কোনো শেষ নাই। এদের অনেকেই পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লোন নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই টাকা শোধ না হতেই ফিরে আসতে হচ্ছে। অনেকেই আবার ফ্রি ভিসায় গিয়েছিলেন, ফলে তাদের কোনো নিয়োগকর্তা নেই। অন্যদিকে লকডাউন থাকার ফলে ভিসা নবায়ন করতে না পেরে খালি হাতে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। এর ফলে পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক নানারকম সমস্যার মুখে পড়ছেন তারা। যারা ঋণ নিয়ে গিয়েছেন, তারা পড়েছেন ভয়াবহ চাপে।
কাজ হারিয়ে ফেরা বিশাল এই প্রবাসী জনবলের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান তৈরি করাও নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন কাজ। তবে এ চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতে হবে। সরকার তা নিয়েছেও। চাকরিচ্যুত কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদেশফেরত এই কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য ইতোমধ্যেই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের অনুকূলে ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করেছে সরকার। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে বিনিয়োগ ঋণ প্রদানের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিলও গঠন করেছে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছে, যারা করোনাভাইরাসের কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, সেই শ্রমিকদের ওয়েজ আর্নার্সের কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। তবে এর বেশি কেউ চাইলে তাকে ওয়েজ আর্নার্স স্কিমের কাগজপত্র দেখাতে হবে।
এছাড়া প্রবাসীদের কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়া টাকাও এসব প্রত্যাবাসিত শ্রমিকদের জন্য ব্যয়ের আরেকটি উৎস হতে পারে। একজন প্রবাসী বিদেশে যাওয়ার সময় ৩ হাজার টাকা প্রবাসী কল্যাণ তহবিলে জমা দিয়ে যায়, বছরে সে তহবিলে প্রায় ২২৫-২৫০ কোটি টাকা জমা হয়। গত ১০-১২ বছরে সে তহবিলে দুই-আড়াই হাজার কোটি টাকা জমা পড়েছে। এই তহবিলের টাকাও শ্রমিকদের কল্যাণে যথাযথভাবে ব্যয় করা দরকার।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান জানিয়েছেন, ১৭ হাজার কোটি টাকার আরেকটি ফান্ড গঠন করা হচ্ছে। এই ফান্ডের টাকা দিয়ে ফিরে আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসন করা ও উদ্যোগে সহায়তা করা হবে। সরকারের নেওয়া এই উদ্যোগগুলো অন্ধকারে আলো দেখাচ্ছে।
ঘাম ও অশ্রু মেশানো রেমিটেন্স সরবরাহ করে অর্থনীতিতে শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড় করাতে ভূমিকা রাখছেন যেসব প্রবাসীরা মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপে আজ তারাই তীব্র মানবিক সঙ্কটে। এরা দেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন, বিনিময়ে পেয়েছেন কমই। এখন রাষ্ট্র ও সরকারকে দেশে এবং প্রবাসে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এদের জীবনকে নিরাপদ ও স্বস্তিকর করে তুলতে।