‘বিভক্ত করো এবং শাসন করো’— এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসা খুব দরকার। সেটা না হলে যে অসাধারণ দেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন তরুণরা দেখেছেন, ওই স্বপ্ন আবারও ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।
Published : 24 Aug 2024, 06:57 PM
ট্যাগ (Tag) শব্দটির সঙ্গে জীবনে প্রথমবার পরিচিত হয়েছিলাম ঝাঁ চকচকে কোনো শপিংমল বা দোকানের পণ্যের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট এক টুকরো কাগজে লেখা ‘Price tag’ শব্দবন্ধনীর মাধ্যমে। কালের বিবর্তনে এ শব্দটি পণ্যের গায়ে ঝুলে থাকলেও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রমরমার যুগে এটি অনেক বেশি ব্যাপকতর ও আগ্রাসী অর্থ ধারণ করেছে। এখন এ শব্দের নানা ব্যবহার হয় বিরুদ্ধ মতকে বোঝানোর জন্য। সে বিরোধিতা হতে পারে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা নিদেনপক্ষে দৈনন্দিন পারিবারিক ছুটকো ঝুট-ঝামেলাও। এভাবে আমরা সবাই প্রতিদিন ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, যৌক্তিকভাবে হোক বা অযৌক্তিক, সরাসরি হোক বা ঘুরিয়ে— নানা পদ্ধতিতেই নানাভাবে ‘ট্যাগায়িত’ হয়ে চলেছি।
বিষয়টি নিয়ে আরেকটু বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা যাক। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর থেকেই দেশে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, ছাত্র-তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি সত্য না করে কিছু ক্ষেত্রে এখনও আগের সংস্কৃতি (অপসংস্কৃতি বলাই শ্রেয়) থেকে আমরা এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি। আওয়ামী লীগ আমলে, কেউ সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড বা ইউনিট পর্যায়ের কোনো নেতার বিরুদ্ধে কথা বললেও ‘বিএনপি-জামায়াতের দোসর’ নামক ট্যাগ জুটে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। যার সবশেষ বা সম্ভবত সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে শেখ হাসিনা কর্তৃক কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ ট্যাগ দেওয়ার কথাটা উল্লেখ করা যায়। এছাড়া, সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা, জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের প্রতিবাদ, বিদেশে অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কথা বলা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ বা অন্য যেকোনো সর্বজনীন বিষয় নিয়ে যে-ই কথা বলেছে বা রাস্তায় নেমেছে, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা বিশ্বাস নির্বিশেষে তাকে বিএনপি-জামায়াতের দোসর বা পক্ষান্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ দেয়া হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই একই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা বা পূর্বের সরকারের সময়কার কোনো ভালো কাজের কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে আপনার নামের সঙ্গে ‘লীগের দালাল’ বা ‘আফসোস লীগ’ বা ‘হতাশা লীগ’ ইত্যাদিসহ নানা ধরনের ট্যাগ লেগে যাচ্ছে। আপনি যদি বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত হাজারও ভাস্কর্য, শিল্প-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানে হামলার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাহলেও আপনি পেতে পারেন আওয়ামী দালালের ট্যাগ। আবার সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিতে ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়াসহ নানা বিষয়ে আপনি যদি নির্মোহ বা নৈর্ব্যক্তিক অথবা যৌক্তিক কোনো কিছু লিখতে যান, তাহলেও আপনার কপালে জুটতে পারে ‘ভারতের দালাল’ নামক ট্যাগ। কিংবা, ভবিষ্যতে দেশে সাম্রাজ্যবাদী বা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে কথা বললে আপনার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে হাজারও ট্যাগ।
এখন প্রশ্ন হলো, কী কারণে এই ট্যাগের অপসংস্কৃতির এত রমরমা অবস্থা তৈরি হলো এবং এর ফলে জাতীয় জীবনে কী ধরনের প্রভাব পড়ে? এই প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রবাদপ্রতীম বাক্য বা উক্তির কথা প্রথমে একটু স্মরণ করে নিই। প্রাচীন গ্রীক লেখক এ. এসপের একটি উক্তি পৃথিবীতে শত সহস্রবার উচ্চারিত হয়েছে, আর তা হলো— ‘United we stand, divided we fall’। যার বঙ্গানুবাদ করলে খানিকটা এমন হতে পারে— ‘একতায় বিজয়, বিভক্তিতে পরাজয়’। আবার এই উপমহাদেশ থেকে যখন ব্রিটিশরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্বদেশে ভেগে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই তারা এক ঐতিহাসিক কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ পলিসি গ্রহণ করে। আর তা হলো— Divide and rule। অর্থাৎ, ভারতবর্ষের মানুষের মন ও মগজে এমনভাবে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ঢুকিয়ে দাও, যাতে করে তারা কখনও ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর বুকে বিশাল শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে না পারে। অনেকটা এই পলিসির কারণেই ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে এখনও সাম্প্রদায়িক সংঘাত লেগেই রয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা এখনও সম্ভব হয়নি। অবশ্য, এই পদ্ধতির প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন প্রাচীন গ্রীসের শাসক দ্বিতীয় ফিলিপ।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভিজাত্যের প্রতীক টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা সারাবিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে বৈশ্বিক রাজনীতির পথচলাই ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ওই ঘটনার পর আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে লাখো মানুষের মৃত্যুই শুধু হয়নি, পুরো দেশটিই ধ্বংস হয়ে গেছে। তখনকার সময়ে এক বক্তব্যে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন— ‘Either you are with us, or against us’। অর্থাৎ, ‘হয় আপনি আমাদের সঙ্গে অথবা আমাদের বিরুদ্ধে’। তার ওই উক্তিকে শিরোধার্য করেই অনেক মানুষ এখনও পথ চলেন। পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে এই নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন, তার বহু প্রমাণ দেওয়া সম্ভব।
এই যে বিভক্তির রাজনীতি, মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করা, সমাজে নানা ধরনের শ্রেণি তৈরি করা, ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না’র রাষ্ট্রব্যবস্থা— এ সবকিছুরই বিরোধিতা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না রাখা, সব ধরনের বৈষম্য দূর করা এবং সবার জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্যই প্রাণ দিয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দুই লাখ নারী। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন যা পরে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তারও মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্য দূর করা। রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সমানাধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু, যারা এই অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছেন তারাই যদি স্বৈরাচারী শাসকদের মতো বিভক্তিমূলক কথাবার্তা বলেন বা কথায় কথায় কাউকে নানাভাবে ট্যাগায়িত করেন, তাহলে মূলত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল স্পিরিটকেই অস্বীকার করা হয়।
‘বিভক্ত করো এবং শাসন করো’— এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসা খুব দরকার। সেটা না হলে যে অসাধারণ দেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন তরুণরা দেখেছেন, ওই স্বপ্ন আবারও ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। তাই, আর কোনো বিভাজন নয় প্রয়োজন প্রকৃত অর্থে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। আর এর মাধ্যমেই সম্ভব, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকে প্রকৃত অর্থে বৈষম্যহীন, মৌলবাদমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। সকলকে ওই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।
পুরো লেখাজুড়ে বিভাজনের বিপক্ষে বললেও লেখা শেষ করতে চাই একটি বিভক্তির আহ্বান জানিয়েই। আর তা হলো, ন্যায়-অন্যায়ের বিভাজন। সমাজে ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। তাই আসুন, দল-মত-রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে যে-ই অন্যায় করবে তার বিরুদ্ধেই জোরালো অবস্থান নিই, সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলি।