Published : 20 May 2020, 08:43 PM
জামায়াতের প্রয়াত আমীর গোলাম আযমের একটি বই আছে "আমার বাংলাদেশ" শিরোনামে। বইটির প্রকাশক জামায়াতের প্রেস হিসাবে পরিচিত আধুনিক প্রকাশনী। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ সঙ্কটকালে হঠাৎ করে এ নামের একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে দেখা গেল এ মাসের গোঁড়ার দিকে। যারা গোলাম আযমের বইটির সাথে পরিচিত তারা নড়েচড়ে বসলেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর পূর্বে কোনো বইয়ের নামে দল গঠিত হয়নি। বিশ্ব ইতিহাসেই এ ধরনের ঘটনা বিরল। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, কার্ল মার্কসের "কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার" পুস্তিকাটিকে ঘিরে এর নামে নানা দেশে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে। ঠিক এ বিষয়টাকে অনুকরণ করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছে আমার বাংলাদেশ পার্টি।
এ দলটির আহ্বায়ক হয়েছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব। আর সদস্য সচিব হয়েছেন মুজিবুর রহমান মঞ্জু, যাকে জামায়াত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। মুজিবুর রহমান মঞ্জু জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য ছিলেন। ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি হওয়ার আগে চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।
সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী দলটির সাথে আরো আছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আইনি লড়াই চালানো ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমদ ভুঁইয়া, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ। দেখা যাচ্ছে, আমার বাংলাদেশ গঠনে যারা ভূমিকা পালন করছেন, তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ভাবে জামায়াত রাজনীতির সাথে যুক্ত অথবা সহানুভূতিশীল ছিলেন।
এর বাইরেও যে কয়েকজন আছেন, তারা হয় ডান বা দক্ষিণপন্থার রাজনীতির সাথে যুক্ত। "ইসলামপন্থার" রাজনীতির প্রতি তাদের সবারই দুর্বলতা প্রবল। তারা কেউই বামপন্থীদের মত রাজনীতি থেকে ধর্মকে পুরোপুরি বিসজর্ন দেওয়ার পক্ষপাতী নন। তারা সেক্যুলার বাংলাদেশের কথাও বলেন না। ফলে যারা জামায়াত রাজনীতির বিপক্ষে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, এ দলটি আসলে জামায়াতেরই বি টিম।
জামায়াত যেহেতু প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারছে না, নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনও করতে পারছে না, তাই তাদের দরকার আরেকটি প্ল্যাটফর্মের, যেখান থেকে তারা রাজনীতি করতে পারবেন। বিষয়টিকে তারা সরলীকৃত ভাবে "নতুন বোতলে পুরানো মদ," এভাবেই দেখতেই আগ্রহী। তাদের এরকম মনে হবার আরো কারণ জামায়াতের সাংগঠনিক পদ্ধতি অনেকটা কমিউনিস্ট পার্টির মত।
জামায়াত বা এ ঘরানার "ইসলামপন্থীরা" যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কাঠাম এবং কৌশলকে অনুকরণ করে সেটা অন্য ঘরানার "ইসলামপন্থীদের" মাঝে দেখা যায় না। নিষিদ্ধ অবস্থায় কোনো কোনো দেশে কমিউনিস্ট পার্টিকে দেখা গেছে মূল দলকে আন্ডারগ্রাউন্ডে রেখে ভিন্ন নামে প্রকাশ্যে দল গঠন করতে।
অনেকটা জামায়াত ঘরানার দল মিসরের মুসলিম ব্রদারহুডকে আমরা দেখেছি নিষিদ্ধ থাকাকালীন সময়ে ফ্রীডম এ্যন্ড জাস্টিস পার্টি গঠন করতে, যাতে তারা সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এ প্ল্যাটফরম ব্যবহার করেই ব্রাদারহুডের সদস্য মোহাম্মদ মুরসি ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জামায়াত সংশ্লিষ্টরাই 'আমার বাংলাদেশ পার্টি' গড়ে তোলাতে অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জেগেছে, এটা আসলে কমিউনিস্ট পার্টিকে অনুকরণ করা জামায়াতেরই আরেক কৌশল কিনা। তারাও কি আসলে মুসলিম ব্রদারহুডের মত প্রতিকূল পরিবেশ দেখে, মূল দলকে গোপন রেখে, আলাদা একটা প্ল্যাটফরম গঠন করে আবার রাজনীতিতে সামনে আসতে চাচ্ছেন?
এটা বোঝার আগে যে বিষয়টা আগে বোঝা জরুরি সেটা হল, মঞ্জুর মত একজন নিবেদিত জামায়াত নেতা কেন দল থেকে থেকে বহিস্কৃত হলেন? এ বিষয়টি বুঝতে পারলেই বোঝা যাবে আমার বাংলাদেশ গঠনের তাৎপর্য।
জামায়াতের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর থেকেই মঞ্জুসহ জামায়াতের ছোট একটা গ্রুপ দলের নাম পরিবর্তন করে ভিন্ন নামে দল গঠনের কথা উত্থাপন করে। বিশ্বের পরিবর্তিত বাস্তবতায় এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে তারা এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, "ইসলামপন্থার" উপর নির্ভর করে কোনো দলকে একটি পর্যায়ের পর বর্তমানে আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তারা জোর দেন ইসলাম ধর্মের সাথে মিল রেখে দলের নাম বাদ দিয়ে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির মত দল গড়ে তোলার উপর। তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি সব ধরনের ধর্মীয় শ্লোগান এবং প্রতীক বাদ দিয়ে বিএনপির চেয়ে আরেকটু বামে সরে এসে ডান ধারার দল গড়ে তোলা যায়।
পার্টি ফোরামে কেউ কেউ এ দাবিও তোলেন, দলের নেতৃত্বের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে তারাসহ দলগতভাবে জামায়াতের উচিৎ ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য কৌশলগত কারণে হলেও জাতির কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া। এ কাজটি না করতে না পারলে বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতির আর কোনো ভবিষ্যত নেই। তারা এটাও মনে করেন যে, ক্ষমা না চেয়ে ভিন্ন নামে দল গঠন করলেও, তারা রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবেন না। কেননা জনগণ দেখবে যে, একই যুদ্ধাপরাধীরা ভিন্ন নামে দল করছে।
এখন প্রশ্ন হল, ক্ষমা চাওয়ার বা ভিন্ন নামে দল গঠনের ইস্যু কি মঞ্জুই প্রথম উত্থাপন করেন, নাকি এ বিষয়গুলো ক্ষুদ্র ধারা হয়ে হলেও দলে সব সময়ই উপস্থিত ছিল? জামায়াতের বাইরে যারা আছেন, তাদের ধারণা দলটি ক্যাডার-ভিত্তিক, সমসত্ত্ব একটি দল। এখানে অন্যান্য দলের মত উপগ্রুপ, কোন্দল, মতবিরোধ এসব নেই। এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত আবার নিজদের এভাবেই ব্র্যান্ডিং করতে পছন্দ করে। কিন্তু বিষয়টা আসলেই কি তাই?
জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৭৯ সালের মে মাসে আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় থেকেই, ক্ষুদ্র পরিসরে একটা অস্থিরতা দলে সব সময়ই ছিল। বাংলাদেশ জামায়াতের ইতিহাসে দলের সবচেয়ে প্রখ্যাত নেতা হলেন মাওলানা আব্দুর রহিম। বাংলা ও উর্দুতে ইসলাম এবং "ইসলামপন্থার" রাজনীতি, এ দুটো বিষয় নিয়ে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়া সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী ও ইউসূফ আল-কারযাভীর বই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
জামায়াত যখন পুনর্গঠন করা হয়, তখন দলে জায়গা দেওয়া হয়নি এ আব্দুর রহিমকে। যে চার জনের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে ঢাকাতে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করা হয় মাওলানা রহিম ছিলেন তাদের একজন। বাকি তিনজন হলেন মাওলানা রফি আহমেদ ইন্দরি, খোরশেদ আহমেদ ভাট ও মাওলানা কারি জলিল আশরাফি নদভি।
১৯৫৫ সালে মাওলানা আবদুর রহিম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে রহিম পাকিস্তান জামায়াতের নায়েবে আমির হন। রহিম নায়েবে আমির হবার পর গোলাম আযমকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রহিম সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাহোরে অবস্থান করছিলেন, সেখানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবস্থিত। ফলে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতের নীতিকে সমর্থন করলেও সরাসরি যুদ্ধাপরাধের সাথে রহিমের যোগ ছিল না।
১৯৭৪ সালে মাওলানা রহিম পাকিস্তান জামায়াত থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ। ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে জামায়াত তখন তার পুরো সংগঠন নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে সক্রিয়। পাকিস্তান আমলে মণি সিংহের নেতৃত্বে সিপিবি আন্ডারগ্রাউন্ডে সক্রিয় ছিল। সিপিবিকে অনুকরণ করে জামায়াতে দল ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়। তবে পার্থক্যের জায়গাটা ছিল এখানে যে, সিপিবি তার সহযোগী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নকে প্রকাশ্যে রাখতে পারলেও জামায়াতকে ইসলামী ছাত্র সংঘসহ আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়েছিল।
একটা বিষয় রহিম বুঝতে পারেন যে, ১৯৭১ সালের ভূমিকার কারণে জামায়াত নাম নিয়ে দেশে রাজনীতি করা কঠিন হবে। ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়। ১৯৭৬ সালে মে মাসে সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ধর্মীয় রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। তখন রহিম জামায়াতকে পুনুরুজ্জীবিত না করে নেজামে ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৪ অগাস্ট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটা জোট গঠন করেন। নেজামে ইসলামের মাওলানা সিদ্দিক আহমদকে এর প্রধান করা হয়। মুসলিম লীগের সাথে জোট বেধে আইডিএল ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে সংসদে ২০টি আসন লাভ করে। মাওলানা রহিমসহ জামায়াতের ছয়জন আইডিএলের ব্যানার থেকে নির্বাচিত হন।
নির্বাচনের সাফল্য রহিমের মাঝে এ প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয় যে, "ইসলামপন্থার" আন্দোলন জামায়াতের প্ল্যাটফরমকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। তিনি মনে করেন কৌশলগত কারণে হলেও নিজ প্লাটফরমে না থেকে জামায়াতের আইডিএলের ব্যানারে কাজ করা উচিৎ। এতে জামায়াতের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ রয়েছে সেগুলো আর কাঁধে নিতে হবে না।
"ইসলামপন্থীদের" প্রতি সহানুভূতিশীল জিয়া সরকার ক্ষমতায় থাকবার সুবাদে গোলাম আযম ভিসাবিহীন অবস্থায় অবৈধভাবে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। দেশে ফিরেই তিনি জামায়াতের ওপর নিজের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। মাওলানা রহিমের আইডিএলের মাধ্যমে রাজনীতি করবার ধারণাকে গোলাম আযম দেখেন জামায়াতের ওপর নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে। তিনি বুঝতে পারেন রহিম দলে থাকলে তার ব্যক্তিত্বের পাশে তিনি ম্লান থাকবেন। তাই পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা রহিমের সাথে আইডিএলে না থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
নাগরিকত্ব না থাকবার ফলে নির্বাচনের পরপরই গোলাম আযম আব্বাস আলী খানকে আইডিএল থেকে বের হয়ে এসে নিজস্ব ব্যানারে জামায়াতকে প্রকাশ্যে আনতে বলেন। এ কাজে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও আশীর্বাদ পান। ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তাই তাকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে।
গোলাম আযমের সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হয়ে রহিমের সাথে দল ছেড়ে চলে যান কট্টর স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট সাদ আহমদ। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার কারণে তিনি ১৯৭৪-৭৫ কালপর্বে কারান্তরীণ ছিলেন। "মুজিবের কারাগারে পৌনে সাতশ দিন" শিরোনামে তার একটি বই রয়েছে।
জামায়াত পুনর্গঠন করা হলেও নাগরিকত্ব না থাকবার জন্য গোলাম আযম প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে দলের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় স্বল্পভাষী, কাজে বিশ্বাসী আব্বাস আলী খানের ওপর। জামায়াত নাম দিয়ে দলকে প্রকাশ্যে আনবার ফলে বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে সাথে পান গোলাম আযম। কিন্তু দলের ক্ষুদ্র একটা অংশের মাঝে মাওলানা রহিমকে বাদ দিয়ে দল গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
দলে আবার কিছুটা অসন্তোষ দানা বাঁধে এ গোলাম আযমকে কেন্দ্র করেই তার নাগরিকত্ব ফিরে পাবার পর ১৯৯৪ সালে। নাগরিকত্ব পাবার পর আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে তিনি দলের আমির হন। আব্বাস আলী খানকে পদাবনতি ঘটিয়ে নায়েবে আমির করা হয়।
জামায়াতের কিছু তরুণ নেতাকর্মী এবং শিবিরের কারো কারো কাছে গোলাম আযমের এ সিদ্ধান্ত প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল নাগরিকত্ব পাবার পর গোলাম আযমের উচিৎ ছিল দলের উপদেষ্টা হিসাবে থেকে আব্বাস আলী খানকে ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ আমির হিসাবে নিয়োগ দেওয়া। দুটি কারণে তারা এরকমটি ভেবেছিলেন।
প্রথমটি হল, ১৯৭১ সালে আজমের ভূমিকা। তবে দ্বিতীয় কারণটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ নেতাকর্মীরা জামায়াত গড়ে তোলার পিছনে তাত্ত্বিক ছাড়া গোলাম আযমের বাস্তব কোনো ভূমিকা দেখতে পান নাই। পাকিস্তান আমলে জামায়াত গড়ে উঠেছে মাওলানা রহিমের নেতৃত্বে।
১৯৭২-৭৫ সালে দলের চরম দুর্দিনে ১৯৭৩ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে গোপন অবস্থায় থেকে দলের হাল ধরেন আব্বাস আলী খান। অপরদিকে, নেতাকর্মীদের বিপদের মধ্যে ফেলে দেশ থেকে পালিয়ে যান গোলাম আযম। আবার ১৯৭৯ সালে জামায়াত প্রকাশ্যে আসবার পর দলকে গড়ে তোলবার জন্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছূটে বেরিয়েছেন আব্বাস আলী খান। ফলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে আব্বাস আলী খানের।
গোলাম আযমের আমির হবার ঘটনা দলে অসন্তোষের জন্ম দিলেও আজমের প্রতি আব্বাস আলী খানের শর্তহীন আনুগত্য এ অসন্তোষকে বাড়তে দেয়নি। ভারপ্রাপ্ত আমির হিসাবে আব্বাস আলী খান দলকে একটা নতুন মাত্রায় নিয়ে যান। ১৫ (পরে ৮ ও ৫) এবং ৭ দলীয় জোটের সমান্তরালে একই সাথে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও গণসমাবেশের কর্মসূচি পালন করে জামায়াতকে তিনি অনেকটাই মূলধারায় নিয়ে আসতে সমর্থ হন। তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াত এতটাই 'অচ্ছুৎ' ছিল যে, বিএনপির পক্ষেও জামায়াতকে নিয়ে একসাথে জোটবদ্ধ হবার বিষয়টি ছিল কল্পনার বাইরে।
আব্বাস আলী খান অত্যন্ত কৌশলের সাথে দলকে এমন ভাবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সামিল করেন যাতে রাষ্ট্রশক্তির সাথে দলকে কোনোরকম সংঘাতে যেতে না হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে তিনি দেখেন দলকে সুসংগঠিত করে তৃণমূলে বিস্তার ঘটাবার সুযোগ হিসাবে। বস্তুত এ সময়কালেই ইসলামী ছাত্র সঙ্ঘের উত্তরসুরি হিসাবে মিলিট্যান্ট সংগঠন রূপে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের ব্যাপক উত্থান ঘটে।
এরশাদ পতনের পর জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পায়। খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ভিন্ন প্ল্যাটফরম থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়েতের অংশগ্রহণের ফলে অনেকেরই মনে হচ্ছিল জামায়াত বোধহয় মূলধারার রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায়।
১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে রাষ্ট্রশক্তির যে আশির্বাদের ছায়া জামায়াতের ওপর ছিল হঠাৎ করে তা সরে যায়। এর আগে গোলাম আযম নির্বাচনী প্রচারণার প্রায় শেষ দিকে খুলনাতে অনুষ্ঠিত জামায়াতের এক জনসভায় হঠাৎ করে বলে বসেন, "নৌকা মার্কা ঠেকাতে, ধানের শীষে ভোট দিন"। নির্বাচনী প্রাচারণার শেষ মুহূর্তে গোলাম আযমের মনে হয় নির্বাচনে হয়ত বিএনপি জিতে আসবে। বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসলে যাতে বিরূপ অবস্থায় পড়তে না হয়, তাই কৌশলগত কারণে এ বক্তব্য দেওয়া।
এতে আরেকটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গোলাম আযমের অদক্ষতা। ১৯৭১ সালেও তিনি ভুল বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না। তবে রাষ্ট্রশক্তির আশির্বাদ সরে যাবার বিষয়টাকে জামায়াত নেয় "টেস্ট কেস" হিসাবে—দেখতে চায় রাষ্ট্রের ছায়ার বাইরে থেকে সংগঠন এগিয়ে নেওয়া যায় কিনা। তবে এ বিরূপকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো জামায়াত নিজেই সরকারের অংশ হয়ে যায়। ২০০১-০৬ সময়কাল ছিল জামায়াতের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। শুধু জামায়াত নয়, বিশ্বব্যাপী "ইসলামপন্থার" আন্দোলনের সুবর্ণ সময় হল ২০০১-১০ কালপর্ব। ৯/১১ পরবর্তী সময়টা মনে করা হচ্ছিল "ইসলামপন্থাই" বোধহয় মুসলিম বিশ্বের চূড়ান্ত রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু রাশিয়ার পুনুরুত্থান সমস্ত হিসাব নিকাশ পালটে দেয়। "ইসলামপন্থার" রাজনীতি ক্রমশ প্রান্তের দিকে ধাবিত হয়। এর ঢেউ এসে লাগে বাংলাদেশেও।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে তখন প্রথম দিকে জামায়াত বিষয়টিকে হালকা ভাবে নিয়েছিল। তারা এটাকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শ্লোগান হিসাবেই দেখছিল। তারপর যখন জামায়েতের শীর্ষ নেতৃত্ব একের পর এক আটক হতে থাকে, তখনো বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে জামায়াত একে বিরোধী দলকে হয়রানি করবার প্রক্রিয়া হিসাবেই দেখে—যে ধরনের হয়রানি ভারত বা পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেখা যায়। তাই প্রথমদিকে এরশাদ আমলের মত নেতাদের মুক্তির দাবিতে অনেকটা লোক দেখানো প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্যেই জামায়াত নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে। কিন্তু সত্যি সত্যি যুদ্ধাপরাধের রায় দেওয়া যখন শুরু হয়, তখন জামায়াতের টনক নড়ে উঠে।
শিবিরের ওপর নির্ভর করে জামায়াত রাষ্ট্রের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে জামায়াত এবং শিবিরের বহু কর্মী নিহত হয়। অনেকে কারাবন্দী হন। মামলা, হুলিয়া, আত্মগোপন ইত্যাদিতে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে যান। সারা দেশে জামায়াত, শিবির তাদের সব কার্যালয় বন্ধ করে দিয়ে দলকে অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় মাওলানা রহিমকে বাদ দিয়ে জামায়াত পুনর্গঠনের সময় যে বিতর্কগুলো দলে ছিল তা আবার নতুন করে সামনে চলে আসে।
কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচাবার জন্য দলকে রাষ্ট্রের মুখোমুখী করবার যৌক্তিকতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেন। কয়েকজন নেতার ব্যক্তিগত স্বার্থে দলকে ব্যবহারের অভিযোগ আসে। মঞ্জুর মতো কেউ কেউ এ সিদ্ধান্তে আসেন, যুদ্ধাপরাধের দায় মাথায় নিয়ে পরিবর্তীত জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় জামায়াত নামক দলটির বাংলাদেশে আর কোনো ভবিষ্যত নেই। তারপরও শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা মনে করেন, দলের স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের দল থেকে বহিষ্কার করা উচিৎ। এছাড়া রাজনীতিতে এগোবার আর কোনো উপায় নেই। মঞ্জুসহ এ চিন্তার অনুসারীরা জামায়াতে সংস্কারপন্থি হিসাবে চিহ্নিত হন। লক্ষ্যণীয় যে, সাইফউদ্দিন মানিক এবং নুরুল ইসলাম নাহিদরা যখন সিপিবি ভাঙ্গেন, তখন তারাও নিজেদের সংস্কারপন্থি বলতেন।
দলের ইতিহাসে সবচেয়ে সঙ্কটকালে মঞ্জুর এ অবস্থান দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে অধিকাংশ নেতাকর্মীর কাছে প্রতীয়মান হয়। মঞ্জুসহ তাদের অনেককেই ২০১৮ সালে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কার হবার পর মঞ্জুর প্রথম রাজনৈতিক প্রকল্প "জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ" ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারপর তিনি কৌশলগতভাবে আরেকটু ডানে সরে তার প্রাক্তন রাজনৈতিক গুরু গোলাম আযমের বইয়ের শিরোনাম অনুসারে গড়েন 'আমার বাংলাদেশ পার্টি'। কিন্তু প্রশ্ন হল, এটি কি জামায়াতেরই আরেকটা প্ল্যাটফরম?
এক কথায় এর উত্তর হল না। মিসরে মোহাম্মদ মুরসিসহ অন্যরা ব্রাদ্রারহুড নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি গঠন করেছিলেন মূল দলের সাথে বিরোধ বা দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবে নয়, বরং মূল দলের সমর্থন নিয়ে, কৌশলগত রাজনীতির অংশ হিসাবে। অপরদিকে, মঞ্জু দল গঠন করেছেন জামায়াতের নীতির সাথে বিরোধ করে এবং সম্ভবত নিজে প্রধান নেতা হবার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করবার জন্য। দলের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসময়ে দলের সাথে না থেকে তিনি দলে ভাঙ্গন ধরিয়েছেন। দলে ভাঙ্গন, কোন্দল ইত্যাদি নাই বলে জামায়াত এতদিন যেটা বলে বেড়াত—এ ধরনের ব্র্যান্ডিংকে তিনি চুরমার করে দিয়েছেন।
মানিকের রুপান্তরিত কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির রাজনীতিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি মঞ্জুর আমার বাংলাদেশ পার্টি চাপে থাকা জামায়াত রাজনীতির জন্য একটা বাড়তি চ্যালেঞ্জ। মানিক রুপান্তরিত হয়ে ডান ধারার রাজনীতির দিকে সরে এসেছিলেন। জামায়াত থেকে বের হয়ে এসে মঞ্জু কোন ধারার রাজনীতি করতে চাচ্ছেন?
সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাজনীতি করবার কথা বলেছেন আমার বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও সেখানে কেউই বলেননি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল আকাঙ্খা যে সেক্যুলার বাংলাদেশ, সেটা গড়ে তোলার কথা। সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের কথাও তারা বলেননি।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি দল এবং গ্রুপের একটা সাধারণ ঐক্য ছিল—সেটা হল সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এমনকি প্রচণ্ড আওয়ামী লীগ বিরোধী "পিকিংপন্থী" দলগুলোও তাদের মার্কসবাদী/মাওবাদী মতাদর্শগত কারণে সেক্যুলার বাংলাদেশ চাইত। তারা আওয়ামী লীগকে উল্টা সমালোচনা করত এই বলে যে, এরা প্রকৃত সেক্যুলার দল নয়।
সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে যে বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে সেটা হল, চরম দক্ষিণপন্থার অবস্থান থেকে কিছুটা ডান দিকে সরে এসে আমার বাংলাদেশ রাজনীতি করতে চায়। প্রশ্ন হল, মঞ্জুর দল সফল হলে কোন দলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় আমার বাংলাদেশ সফল হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জামায়াত এবং বিএনপি। সিভিল সমাজে সক্রিয় বিএনপি সমর্থক বলে পরিচিত এমন কয়েকজন ইতোমধ্যে আমার বাংলাদেশে যোগ দিয়েছেন। মঞ্জু যত সফল হবেন বিএনপি এবং জামায়াতের আরো অনেক নেতাকর্মী আমার বাংলাদেশে আসবেন। কিন্তু আমার বাংলাদেশ কি রাজনীতিতে সফল হবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কী বলে?
বাংলাদেশে দল হিসাবে সফল হবার জন্য তিনটি উপাদান জরুরি- ১)জননন্দিত জাতীয় নেতা থাকবার ইতিহাস, ২) জাতীয় ভাবে পরিচিত নেতৃত্ব দলে থাকা এবং ৩) ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় জনগণের কাছে পরিচিত রাজনৈতিক দল হওয়া, যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, সিপিবি ইত্যাদি।
আমার বাংলাদেশে এর তিনটিই অনুপস্থিত। নিকট অতীতে মিডিয়ার ব্যাপক সমর্থন নিয়েও সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চোধুরী বা কর্নেল অলি আহমদ কেউই সফল হননি। এর বাইরেও যারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারা খুব বড়জোর রাজনৈতিক ক্লাব গড়তে পেরেছিলেন। কাউকে কাউকে নাম সর্বস্ব দল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। আমার বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বলা যায়, "সফল" হলে এটি একটি রাজনৈতিক ক্লাব হবে, আর ব্যর্থ হলে ব্যানার সর্বস্ব সংগঠন হবে।