Published : 17 Jan 2012, 06:35 PM
দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি, যাকে কার্যত লকডাউন-ই বলা যায়, ঘোষণা হয় ২৬ মার্চ থেকে। সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রায় এক মাস যেতেই গত ২৬ এপ্রিল থেকে খুলে দেয়া হয়েছে গার্মেন্টস কারখানা। সম্প্রতি সাধারণ ছুটির মেয়াদ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হলেও ইতোমধ্যেই ১০ মে থেকে দোকানপাট ও শপিংমল খোলার সিদ্বান্ত নিয়ে জনমনে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাধারণ ছুটির পাশাপাশি সকল শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আরও শক্ত লকডাউন জারি রাখা দরকার ছিল নাকি জনগণের অসহযোগিতায় এমনিতেই শিথিল হতে চলা লকডাউন শীঘ্রই তুলে দেয়া দরকার তা নিয়ে আপামর জনসাধারণ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞদেরও নানারকম মতামত দেখা যাচ্ছে। এই তর্ক-বিতর্কের মাঝেই "আসুন, আমরা ভয় না পাই" শিরোনামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ ৪ মে প্রকাশিত মানোয়ার হোসেন-এর একটি লেখা পড়লাম। লেখাটিতে তিনি করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাক্বালে জীবন ও জীবিকা নিয়ে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতি বাঁচাতে লকডাউন তুলে দেয়ার পক্ষে আরও জোরালো কতগুলো যুক্তি না তুলে ধরেই তিনি অল্পতে লেখাটি সমাপ্ত করেছেন, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কটি রয়ে গেছে অসম্পূর্ণ। এখানে একটি ব্যাপার তিনি ঠিক ধরেছেন যে, এক মাসের অধিক সময় ধরে লকডাউনের এই মুহূর্তে জীবন নাকি জীবিকা এই প্রশ্নটি নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সমান গুরুত্বের সাথেই আলোচিত হচ্ছে এবং সামগ্রিক অর্থে অর্থনীতিকে এমন স্থবির করে রাখা বরং দেশের একটি বড় অংশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য আরও বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে, অন্যদিকে এটিও ঠিক যে, লকডাউন বিষয়ে আমরা অবৈজ্ঞানিকভাবে আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না এবং সারাবিশ্বের অভিজ্ঞতার আলোকেই আমাদের ধাপে ধাপে এই লকডাউন তুলতে হবে। এক্ষেত্রে, ব্যাপক সংক্রমণের হার ও কোনো প্রতিষেধক না থাকার কারণে কোভিড-১৯ এর তুলনা যক্ষ্মা বা অন্য কোনো ফ্লু ভাইরাসের সাথে না করাই শ্রেয় বলে মনে করি, যা তিনি তার লেখায় করেছেন।
অনেকেই যখন আমরা জীবিকা বা অর্থনীতির দোহাই দিয়ে লকডাউন তুলে নেয়ার পক্ষে মতামত দেই, তখন আমরা লকডাউন চালু রেখে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর যে সর্বসম্মত কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে তার পেছনে থাকা একটি মৌলিক যুক্তিই ভুলে যাই বা অগ্রাহ্য করি। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস (SARS-COV-2) শনাক্ত হবার পর থেকে এই প্রায় চার মাসের মতো সময়ে বিশ্ববাসী একটি ব্যাপারে অন্তত একমত যে, এই ভয়াবহ রকমের ছোঁয়াচে ভাইরাস খুব দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা খুব উচ্চমাত্রায় বেড়ে গেলে তা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। বিশ্বের কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই যেহেতু এরকম মহামারী সামলানোর জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাই একদিকে সংক্রমণ ছড়ানোর দ্রুততা কমিয়ে ও আক্রান্তের সংখ্যা কম রেখে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া এবং অন্যদিকে লকডাউন পরবর্তী সময়ে আরো বেশি পরিমাণ সংক্রমিত মানুষকে চিকিৎসা দেবার জন্য স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নেয়ার জন্যই বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধে লকডাউনকে একটি প্রয়োজনীয় কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই, করোনাভাইরাসের প্রাথমিক সংক্রমণের হার কমে আসার পর উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রথম ধাপে লকডাউন শিথিল করার প্রাক্বালে তারা দ্বিতীয় ধাপে আরো বড় ধরনের সংক্রমণ ঠেকাতে একদিকে যেমন জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন, তেমনি তাদের স্বাস্থ্যখাতকেও প্রস্তুত করছেন দ্বিতীয় ধাপে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায়। আর, স্বাস্থ্যখাতে সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তারা করোনাভাইরাস রোগী শনাক্তকরণে বেশি বেশি টেস্ট করা, শনাক্তকৃত রোগী ও তার সংস্পর্শে আসা অন্যান্য ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, ভেন্টিলেশন সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ প্রস্তুত করা এবং স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত প্রত্যেকের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে চলেছেন।
আমাদের দেশে বিগত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান লকডাউনে ব্যক্তি ও জাতীয় পর্যায়ে কতটা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত থাকলেও ক্ষতির পরিমাণ যে সারাবিশ্বের মতো বেশ বড়সড়ই হবে তা নিয়ে সবাই একমত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষকরা দাবি করছেন যে লকডাউনে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা হারাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যে হিসেবে গত ৪০ দিনের লকডাউনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকায়। অন্যদিকে, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ১৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার যা প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকার সমান। এই সবকিছুর পর, বাংলাদেশে যেখানে শ্রমজীবীদের প্রায় ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে এবং দেশের আগে থেকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত ২০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের সাথে উপার্জন হারিয়ে নতুন করে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হওয়া পরিবারের সংখ্যাও বিশাল, সেখানে অর্থনীতি বাঁচাতে ও মানুষের জীবিকা বাঁচাতে ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে দেয়ার আলোচনা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। তবে লকডাউন তুলে দেয়ার এই বিতর্কে আমাদের প্রথম প্রশ্নটিই হতে হবে, আমরা যে যুক্তিতে লকডাউন বাস্তবায়ন করেছিলাম তার মূলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বহুগুণে প্রস্তুত করার যে মৌলিক শর্ত ছিল তা আমরা পূরণ করেছি কিনা। কারণ, যতদিন পর্যন্ত আমরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে না পারব, ততদিন শুধু আমরা করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকবো তা-ই নয় বরং জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টের মতো যেকোনো লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণের মতো ঘটনাও ঘটতে থাকবে। তাই, নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে, করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে বেশি বেশি টেস্ট করে, শনাক্তকৃত রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুত করে, জীবনযাপনে অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে এবং নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী-চাকুরিজীবী-উদ্যোক্তাদের সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে কিভাবে ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেয়া যায় তার জন্য দরকার যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা।