Published : 25 Mar 2020, 10:44 PM
ভারত উপমহাদেশে বঙ্গবন্ধুর আগে এবং বঙ্গবন্ধুর সমকালে অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জাতির স্বার্থ এবং বাঙালি জাতির স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য বঙ্গবন্ধুই একমাত্র সফল নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এই সাফল্যের পেছনে অনেক কিছুই রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, তার ইতিহাস পাঠ, একটি জাতিকে স্বাধীন করার জন্য তার যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দরকার ছিল তার সবই ছিল।
বঙ্গবন্ধু একজন অসাধারণ নেতা ছিলেন। এটুকু বললে যথেষ্ট বলা হয় না। আসলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা, ক্যারিসম্যাটিক নেতা। তিনি সমস্ত বাঙালি জাতিকে, জাতি বলে তখনকার পূর্ববাংলার জনগণকে বোঝাচ্ছি, তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে জন্ম দিতে পেরেছিলেন। তিনি যথার্থই জাতির জনক। তখন এবং তার আগে আরও অনেক নেতা ছিলেন। হিন্দু এবং মুসলিম। তাঁরা যা পারেননি উনি তা পেরেছেন। ১৬৯টা আসনের মধ্যে তার দল দুটি আসন ছাড়া সমস্ত আসনে জয়লাভ করেছিল। এরকম নমুনা ইতিহাসে অন্য কোথাও আছে বলে আমার ধারণা নেই। হ্যাঁ, একথা স্বীকার করতে হবে, সময়টা অনুকূলে ছিল। কিন্তু সময় অনুকূলে থাকা ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগতভাবে অসাধারণ কোয়ালিটি ছিল। একজন অসামান্য নেতা হওয়ার যেসব গুণ, সেগুলো ছিল। সে জন্য তিনি এতগুলো আসনে জয়লাভ করেছিলেন।
হোসেন সোহরাওয়ার্দীর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, তিনি ১৯৬২ সালে মারা যান, কিন্তু তার আগেই তিনি লক্ষ করেছিলেন, তাঁর দলের মধ্যে তরুণদের একটি গ্রুপ ছিল- শেখ মুজিবের প্রভাবে যাঁরা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। তিনি কেবল পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখেননি, তখনই তিনি বাঙালির একটি দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এবং সেই বাঙালির দেশ, বাংলাদেশ তৈরি করেছিলেন শেষ পর্যন্ত। বস্তুত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতির জনক ছিলেন। জনক যেমন একটা সন্তানকে জন্ম দেন, তিনি তেমনি পূর্ববাংলাকে বাংলাদেশের নাম দিয়ে জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টি ছিল।
সম্প্রতি টিভির কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বারবার দেখার এবং শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমি লক্ষ করেছি, এর মতো উদ্দীপনামূলক ভাষণ দেয়া কল্পনার অতীত। তিনি এই ভাষণের মধ্যে যেভাবে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই ডাক সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়। এই যে আহ্বান, এই আহ্বান সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। এবং আমার ধারণা, একজন শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে যদি এই ভাষণটি আগে থেকে লিখে দেয়া হতো, মুখস্ত করেও তার পক্ষে এইরকম উদ্দীপনার স্বরে ভাষণটি পড়া সম্ভব হতো না। তিনি অসাধারণ বক্তা ছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, স্বাধীনতার ঘোষক সামরিক বাহিনীর এক মেজর। কিন্তু আমার ধারণা, সেই মেজরের কথায় কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। যুদ্ধ তার আগেই শুরু হয়েছিল। তাছাড়া, সেই মেজর যে কথা বলেন, সে কথা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বলেন। সেই পাঠ শুনে হয়তো কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সেই কথায় কেউ যুদ্ধ শুরু করেনি। যুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আঠারো দিন আগে। তাঁর আহ্বানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন।
তিনি ছিলেন এক অসামান্য অসাম্প্রদায়িক নেতা। তাঁর বহু বছর আগে গান্ধীজীই প্রথম রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্ম ব্যবহার করেন। আরেকদিকে ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনিও ধর্মের সাথে রাজনীতির ব্যবহার করেছেন। তিনি ধর্মটাকে ব্যবহার করলেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। ১৯৪৬-৪৭ সালে যখন বঙ্গদেশকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত করার কথা উঠল, গান্ধীজী, নেহেরু এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু নেতারা সমবেত হয়ে বাংলাদেশকে বিভক্ত করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে স্বাধীন করে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। তিনি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করেননি। দেশ যখন স্বাধীন হলো, তখনো তিনি ধর্মের নাম ব্যবহার করেননি। এবং আমরা আশ্চর্যের একটা জিনিস লক্ষ করি, তার পরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন, তারা সবাই ধর্মের নাম ব্যবহার করেছেন- জিয়াউর রহমান, এরশাদ ইত্যাদি। তাঁরা কথায় কথায় হজ করতে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির জন্য হজ করবার দরকার পড়েনি। বা ওমরাহ করার দরকার পড়েনি। তিনি কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতার বাণী দিয়ে দেশের মানুষকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। আমরা বলতে পারি, শেখ মুজিব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক নেতা ছিলেন। তিনি একবারও ধর্মকে ব্যবহার করেননি। ধর্মীয় স্লোগান ব্যবহার করেননি তার ভাষণে।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান হলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে একটা মস্তবড় অবদান হচ্ছে বাঙালি জাতির জন্য একটা স্বদেশ ভূমি গড়ে তোলা। বাংলার সংস্কৃতিকে অক্ষয় রূপ দিয়ে গেছেন শেখ মুজিব। তাঁর জন্যেই বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংগীতের চর্চা করতে পারছে এবং পারবে। এবং পৃথিবীতে একটিমাত্র দেশ আছে, বাংলা ভাষা যে দেশের রাষ্ট্রভাষা। বাঙালি সংস্কৃতি যে দেশের সংস্কৃতি।
বাঙালি জাতি যে আজকে গর্ব করে তার ভাষা নিয়ে, তার সাহিত্য নিয়ে, তার সংস্কৃতি নিয়ে- এই জিনিসটাকে স্থায়ী রূপ দিতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতির জন্য একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করে গেছেন। আজ থেকে একশ বছর পরে পশ্চিম বাংলায় বাংলা সংস্কৃতির চর্চা কতটুকু থাকবে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। হিন্দির দাপটে সেখানকার বাংলা ভাষা কোণঠাসা হচ্ছে। বিজেপি সেখানে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশ এখনো বাংলা ভাষার নামে যেরকম ঐক্যবদ্ধ, অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে এরকম ঐক্যবদ্ধ হয় বলে আমার মনে হয় না। বাংলার গান, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক, সাহিত্যের যত শাখা আছে প্রত্যেকটি শাখায় আজকে হাজার হাজার বই বের হয় বাংলাদেশ থেকে; যেটা পশ্চিম বাংলায় আমরা কল্পনা করতে পারি না।
বাংলা সাহিত্যের জন্য এমন একটা ভিত্তিভূমি দিয়ে যাওয়া, চিরন্তনভাবে যেখানে বাংলাভাষার চর্চা হবে, যাদের একমাত্র পরিচয় হবে বাঙালি- এরকম একটা দেশ কারো পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হতো না বলে আমার ধারণা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে এ জাতি যুদ্ধ করেছিল। তাঁর কারণেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চলেছিল। তিনি যদি সেপ্টেম্বর মাসেও পাকিস্তানের সাথে আপস করে বলতেন, ঠিক আছে, আমি একটা কনফেডারেশন চাই, তাহলে হয়তো যুদ্ধটা থেমে যেত। কারণ, তাঁর নামেই যুদ্ধটা হয়েছে। কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তিনি আপসে বিশ্বাস করতেন না। এটা ইতিহাসের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত, মূল নেতা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত নেই, অথচ তার নামে ন মাসের অমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়ে গেল। এবং সেই যুদ্ধে স্বাধীনতা এল। এটা বিরল ঘটনা, এর কোনো উদাহরণই নেই।
এই হলো তার একটা দিক। আরেকটা দিক হলো অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে হিন্দু মুসলমান সবাইকে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তিনি ভাষাভিত্তিক একটা দেশ নির্মাণ করেছিলেন। যে দেশের সংস্কৃতি হবে ভাষাভিত্তিক। যে দেশের সংস্কৃতিতে ধর্ম এবং অন্যান্য জিনিস থাকতে পারে বটে, কিন্তু সে দেশের সবচেয়ে বড় পরিচয় হবে তাদের ভাষা। তাদের সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতি। এইগুলো, আমার ধারণা, তার সব থেকে বড় অবদান। এবং তিনি বাঙালি সংস্কৃতির ভবিষ্যৎও নির্মাণ করে দিয়েছেন। যেটার এখনো আমরা পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখিনি। যেটাতে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে বাঙালিয়ানা। এবং বাঙালি সংস্কৃতির পূর্ণরূপ বিকাশ লাভ করবে এই দেশকে অবলম্বন করে, যে দেশের স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতি উভয়ই ভাষাভিত্তিক।