তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৌলিক নিরপেক্ষতার ধারনাকে যিনি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন পরিচালিত সরকারের মাধ্যমে সমূলে ধ্বংস করেছেন তিনি অন্য কেউ নন; তিনি হলেন আজকের জোর গলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিদার বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং এবং তাঁর দল।
Published : 25 Oct 2023, 04:37 PM
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের বিরোধী রাজনীতিকদের পাশাপাশি অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বিগত কয়েকটি নির্বাচনে কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিবর্তিত এবং প্রয়োগ হয়েছিল সে ব্যাপারে স্মৃতিভ্রমে ভুগছেন। তাদের বক্তব্য বা পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল হঠাৎ করেই বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে সরিয়ে ফেলেছে। এ বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, আমি এ পরিবর্তনকে সমর্থন করছি। আসলে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী যখন আনা হয় তখন ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় ‘একটি আত্মঘাতী সংশোধন’ শিরোনামে আমার লেখা নিবন্ধে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী সংবিধান থেকে ছেটে ফেলার সমালোচনা করেছিলাম। অবশ্য এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের বাইরেও সরকারের সিদ্ধান্তকে বিচার করার সময় কী কী কারণে সরকার এ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।
স্মৃতির পাতা কিছুটা সতেজ করলে দেখা যাবে মাগুরা উপনির্বাচনে চরম কারচুপির কারণে আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে এ ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় সেটার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তাঁকে একজন দলীয় রাষ্ট্রপতির অধীনে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সে অভিযাত্রা খুব একটা মসৃণ ছিল না। তাঁর বিজ্ঞতা সেসময় জাতিকে এক রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছিল। তিনি মোটামুটিভাবে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পেরেছিলেন।
ঠিক একইভাবে ১৯৯১ সালে তার পূর্বসূরি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ, যিনি এক ভিন্ন সাংবিধানিক ব্যবস্থার মাঝে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, বিচারপতি আব্দুর রউফ নামে একজন চরম দলীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও একই ধরনের একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। এই রউফ সাহেব গুরত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার তথাকথিত জন্মদিন পালনের ধিকৃত অনুষ্ঠানে কোনো বছরই অনুপস্থিত থাকেননি।
আগের দুটো তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়ে সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা অর্জন করতে পেরেছিলেন, তেমনটি বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্জন করতে পারেননি। প্রথম থেকেই বিতর্কে পতিত লতিফুর রহমান নিজেও ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার শেষ অবধি ওই বিতর্ক থেকে মুক্ত হতে পারেননি। যদিও ওই নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে কিন্তু লতিফুর রহমানের কার্যাবলী বিএনপি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং সে আলোকে তারা পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর না করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিএনপি সে লক্ষ্য অর্জনে সংবিধান সংশোধন করে যা তাদের দলীয় এক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে। অতএব বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী যখন বলেন, “আপনি বিচারপতি হাসানকে মানেননি, আমরাও আপনাকে মানব না”– এটা যুক্তিপূর্ণ নয়, যেহেতু বিচারপতি হাসান স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রার্থীই ছিলেন না। তাঁকে এক অসৎ উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই অবস্থানে নিয়ে আসা হয়েছিল।
এরপর যা কিছ ঘটল তাকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বললে কম বলা হয়। সংবিধানের একটি নয় তিনটি ধারা লংঘন করে তাঁর বশংবদ রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অসাংবিধানিকভাবে বঙ্গভবন থেকে বিতাড়িত করার পর তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। সেদিনের রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ ইয়াজউদ্দিনকে সরাসরি প্রত্যাখান না করে তাদের রাষ্ট্রনায়কসুলভ আচরণের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণের সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশাকে পূরণ করার পরিবর্তে তিনি কুখ্যাত ‘হাওয়া ভবনের’ নীলনকশা বাস্তবায়নে একের পর এক যড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
ক্ষুব্ধ রাজনৈতিক নেতারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশের উচ্চ আদালতে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের সংবিধান ভঙ্গ করে নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ঘোষণার বিরুদ্ধে রিট করেন। বিধিমাফিক শুনানির পর উচ্চ আদালত রায় দেয়ার জন্য প্রস্তুত। ঠিক সেই মুহূর্তে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আজকের বিএনপিপন্থী আইনজীবী সাদা কাগজের চিরকুটে প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্ত নিজে বহন করে নিয়ে আসেন। এদেশের আইন প্রক্রিয়ার ঘটনাপঞ্জিতে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। অতএব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৌলিক নিরপেক্ষতার ধারনাকে যিনি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন পরিচালিত সরকারের মাধ্যমে সমূলে ধ্বংস করেছেন তিনি অন্য কেউ নন; তিনি হলেন আজকের জোর গলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিদার বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং এবং তাঁর দল। পরিশেষে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই সময়ে ‘দেশনেত্রীর’ ক্ষমতায় ফিরে আসার সমস্ত ষড়যন্ত্রকে বিকল করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয় এবং যার মাধ্যমে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। বর্তমানে যে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য দেশকে অচল করে দেয়ার ব্রতে ব্রতী হয়েছে, সেই ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে উপরোক্ত তথ্যগুলো জাগ্রত করা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
বর্তমান অবস্থায় মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ নিয়োজিত কোনো সিইসি এখন পর্যন্ত অসম্মানজনকভাবে বিদায় নেননি এবং বর্তমান সিইসি যে তার ব্যতিক্রম হবেন না সে আশা না করার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে প্রত্যেক ভোটারেরই আইডি কার্ড রয়েছে এবং ভোটার লিস্টে ১ কোটি ২০ লাখ বা সে ধরনের কোনো ভুয়া ভোটার নেই। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম যথেষ্ট সক্রিয় এবং এই সব সংবাদমাধ্যমের বড় একটা অংশ সরকারের প্রতি সহানূভূতিশীল নয়, কাজেই এখন আর মাগুরা বা ঢাকা-১০ আসনের মতো নির্বাচন করা কল্পনাতীত। ঐতিহাসিকভাবে এটা হয়তো সত্য যে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।