বাংলাদেশে আর কয়েকমাস পর জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার এথিক্যাল ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
Published : 26 May 2023, 04:01 PM
ডিজইনফরমেশন বা কুতথ্য, প্রোপাগান্ডা, ফেইক নিউজ, গুজব— সমাজ-সভ্যতা-স্বদেশের জন্য কতখানি ক্ষতিকর সচেতন মানুষমাত্রই তা অনুমান করতে পারেন। গুজবের প্রধান বাহন এখন সোশ্যাল মিডিয়া। সেই আরব-বসন্ত থেকে গোটা বিশ্বের সমাজ ও রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক সোশ্যাল মিডিয়া। সারা পৃথিবী সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের অবস্থান অষ্টম। সর্বোচ্চ ফেইসবুক ইউজারের হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে আর কয়েকমাস পর জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার এথিক্যাল ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
২০১৮ সালের নির্বাচনের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে ৮ সদস্যের একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করেছিল ইসি, যার প্রধান ছিলেন এনআইডির তৎকালীন ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম। সদস্য ছিলেন পুলিশ, এসবি, র্যাব, বিসিসি, বিটিআরসি, এনটিএমসির একজন করে প্রতিনিধি এবং কমিশনের সিনিয়র মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার। গঠিত টিম হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং করার কথা ছিল, কিন্তু এই কমিটি ঠিক কতটা সক্রিয় হয়েছিল তা বলা কঠিন।
রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক কুতথ্য দ্বারা সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চা, যা সত্য প্রতিষ্ঠাকে কঠিন করে তোলে। গুজবের গতি, ফ্যাক্ট বা সত্যের চেয়ে হাজারগুণ শক্তিশালী কেন না ফ্যাক্ট বা সত্যতা উপলব্ধি করতে যে প্রজ্ঞা লাগে গুজবে তা লাগে না এবং সত্যের চেয়ে গুজবকে নিখুঁত মনে হয়। মুখরোচকও। তাই বলা হয়ে থাকে স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়, ব্যাধি সংক্রামক! জাতিগতভাবে হুজুগে বাঙালি খুব উপহাসপ্রিয় ও বঞ্চনাবাদী, তাই কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতে চায় না। ফলে পশ্চাৎপদ বঙ্গদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে গুজবের উর্বর ভূমিতে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান উচ্চ নয়— এমন সমাজে, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক গুজবগুলো দিয়ে ধর্মের নামে, জাতের নামে হিংসা ও হানাহানির ক্ষেত্র তৈরি খুব সহজ। বিগত কয়েক বছরে ফেইসবুককেন্দ্রিক গুজবে শতাধিক সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
একাত্তর ও পঁচাত্তরের পরাজিত শক্তি বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় রাজনীতির ময়দান তথা রিয়েল ওয়ার্ল্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা এখন ভর করেছে সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে। ফলে বিলিয়ন ডলারের লবিস্টমানিতে তৈরি হয়েছে ‘বাঁশের কেল্লা’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’র মতো গুজব ফ্যাক্টরি, একই সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে দেশ থেকে বিতাড়িত একপাল জ্ঞানপাপী অ্যাক্টিভিস্ট। যারা প্রবাসে রাজনৈতিক অ্যাসাইলাম নিয়ে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিদিন অজস্র গুজব রটিয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিসমূহ একজোট হয়েও আন্দোলনের সক্ষমতা হারিয়েছে, গত ১৪ বছরের রাজনৈতিক দিনলিপি তার প্রমাণ। সোশ্যাল মিডিয়া পেনিট্রেশনের মাধ্যমে জনমত স্পিন ডকট্রিন করে বিদেশী প্রভুদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ষড়যন্ত্রের নীলনকশাই এখন তাদের একমাত্র ভরসা। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা নির্বাচন কমিশন বা রাষ্ট্রের জন্য বেশ বড় চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচনকালীন সময়ে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড এথিক্যাল ইউজ অব সোশ্যাল মিডিয়া নিশ্চিত করা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক, নয়তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে নির্বাচনকালীন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিধিমালা বা এমসিসি (Model Code of Conduct) প্রণয়ন জরুরি। সেই সঙ্গে এমসিসি বাস্তবায়নে যথাযথ মেকানিজম তৈরি করতে হবে।
নির্বাচনকালীন সময় সোশ্যাল মিডিয়ার এথিক্যাল ইউজ নিশ্চিত করতে ভারত, নেপাল, ভুটানের নির্বাচন কমিশন যুগোপযোগী এমসিসি প্রণয়ন ও নানা প্রকারের উদ্যোগ নিয়েছে, যা গুগলে সার্চ করলেই পাওয়া যায়। গত ১০ মে কর্ণাটক বিধানসভার যে নির্বাচন হয়ে গেল, সেখানে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন (ইসিই) সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের জন্য শক্তিশালী গাইডলাইন ইস্যু করেছে। মনে রাখতে হবে ভারতের নির্বাচনে মিলিয়ন ডলার দিয়ে প্রশান্ত কিশোরসহ (পিকে) বিভিন্ন ভোটকুশলীকে নিয়োগ দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। ইনডেপথ গবেষণা করে তারা যে ক্যাম্পেইন প্ল্যান তৈরি করে সেই স্ট্রাটেজিক কৌশলই বিজয় এনে দেয় বলে মনে করেন ভারতীয় ভোট বিশেষজ্ঞরা। আর এই স্ট্রাটেজিক কৌশল বাস্তবায়নের প্রধান প্লাটফর্ম সোশ্যাল মিডিয়া।
কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিজয়ের প্রধান কারিগর ধরা হয়ে থাকে সুনীল কানুগলু (এসকে) নামের একজন ভোটকুশলীকে। সুতরাং পিকে, এসকের মতো ভোট কুশলীরা যেন সোশ্যাল মিডিয়ার আনএথিক্যাল ইউজ করতে না পারে, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই কর্ণাটক বিধানসভার প্রার্থীদের সবাইকে সোশ্যাল মিডিয়ার সকল আইডি লিংক ইসিইকে দিতে হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডভার্টাইজিংয়ের জন্য এমসিএমসি (Media Certification and Monitoring Committees) থেকে প্রি সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করেছে। এই সার্টিফিকেশন ছাড়া কোনো প্রার্থী পোস্ট বুস্টিং বা ই-অ্যাডভার্টাইজিং করতে পারবে না। এমসিএম মনিটরিং করার জন্য প্রতি জেলা নির্বাচন অফিসে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত বছর ইসিই C-Vigil নামে একটি অ্যাপ চালু করেছে যেখানে যে কোনো ভোটার নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘনের ব্যাপারে রিপোর্ট করতে পারবে।
আমাদের পাশের দেশগুলো থেকে গোটা উন্নত বিশ্ব নির্বাচনকালীন ডিজিটাল মার্কেটিং বাবদ দল ও প্রার্থীদের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা নির্বাচনকালীন খরচের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ফেইসবুক ইউজার দেশ হয়েও আমরা নির্বিকার। আরও ভয়াবহ তথ্য সিপিডি জানাচ্ছে— গুগল, ফেইসবুক, অ্যামাজানের মতো প্রতিষ্ঠান বছরে দুই হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে এই বাজার থেকে। এর বিপরীতে এনবিআর রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৫৮ কোটি টাকা। অথচ ১৫% ভ্যাট হিসেবেই ৩০০ কোটি আসার কথা। বিটিআরসি জানাচ্ছে ২০১৯ পূর্ববর্তী পাঁচ বছরে দেশের পাঁচটি মোবাইল অপারেটর গুগল, ফেইসবুক গংকে আট হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ই-বিজ্ঞাপন দিয়েছে, যা থেকে এনবিআরের রাজস্ব আহরিত হওয়ার কথা ছিল এক হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। অথচ এনবিআর বলছে মোট বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে মাত্র ৩৮৫ কোটি টাকা। এই টেক জায়ান্টরা কোম্পানি হিসেবে বাংলাদেশে কোনো নিবন্ধনই নেয়নি। এনবিআর শুধু নিধিরাম সর্দার। তাই আগামী নির্বাচনে সব দল ও প্রার্থীকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার গাইডলাইন ও ই-বিজ্ঞাপন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনতে জরুরি বিধিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন।
নির্বাচনকালীন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণকল্পে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনের উচিত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ডায়ালগ শুরু করা। শীর্ষ সাংবাদিক, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজ ও মনোবিজ্ঞানী, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, একাডেমিশিয়ান, সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি যুগোপযোগী নির্বাচনকালীন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিধিমালা প্রণয়ন করা উচিত, যা রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০১৮-এর অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যথাদ্রুত এই বিধিমালা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সিস্টেম ও মেকানিজম তৈরি করতে হবে।