Published : 12 Mar 2020, 04:40 PM
প্রায় তিনমাস হতে চলল, পৃথিবীটা লড়ছে কোভিড-১৯ নামের একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে। যা ইতিমধ্যে 'নভেল করোনাভাইরাস' নামে পরিচিতি পেয়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে শুরু হওয়া (এখন পর্যন্ত খবর অন্তত সে রকমই) এ ভাইরাসটি সেখানকার স্থানীয় প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে আক্রান্ত করেছে। যাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিন হাজারের মতো মানুষ প্রাণও হারিয়েছেন। আবার অনেকেই ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। যেকোনো ভাইরাসের সাধারণ যে প্রকৃতি, সেই হিসেবে এই কোভিড-১৯ও মারাত্মক ছোঁয়াচে। আর সে কারণেই কি না ভাইরাসটি ইতিমধ্যে চীনের বাইরে আরও শতাধিক দেশে ছড়িয়েছে। তারমধ্যে ইরান, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশে মৃতের সংখ্যাও অর্ধসহস্র ছাড়িয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট আক্রান্ত দেশ, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মূলধারার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব স্বাভাবিক কারণে করোনাভাইরাস নিয়ে চলছে ধুন্ধুমার ব্যস্ততা আর নানামাত্রিক আলোচনা। এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা বাংলাদেশ আজ দু'মাসের ওপর ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও শেষপর্যন্ত আর পারা গেল না। যেমন আশংকা তেমনই ঠিক ঠিক এসে গেল, গত ৭ মার্চ আমাদের দেশেও তিনজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হলো। ফলে চলমান করোনা আতঙ্ক জনাতঙ্কে পরিণত হলো। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং পাবলিক হেলথ অ্যাক্টিভিস্টগণ সবাই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করে পুনঃপুনঃ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এতকিছুর পরও সর্বসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে বৈ কমছে না।
করোনাভাইরাস কী?
গত কয়েক মাসে এতবেশি আলোচনা চলেছে আর মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে প্রচারিত হয়েছে তাতে ভাইরাসটি সম্পর্কে কেউ অনভিজ্ঞ আছেন বলে আশংকা করি না। যাহোক, করোনা একটি নতুন প্রজাতির ভাইরাস যা সাধারণ আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে দ্রুত আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মূলত বায়ুপ্রবাহী আর যার প্রতিকারে কোনো চিকিৎসা এবং প্রতিষেধক এখনও তৈরি হয়নি। আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে আর দশটি সাধারণ ভাইরাসজনিত ফ্লু'র বিধিমতোই। তবে ইতোমধ্যে সারাবিশ্বে বিশেষ করে চীনসহ উন্নত দেশগুলোতে ভাইরাসটির প্রাদূর্ভাব মোকাবেলায় প্রতিষেধক তৈরির তৎপরতা শুরু হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ভয়াবহতা কেমন?
সাম্প্রতিক অতীতে নানা সময়ে আসা ভাইরাস যেমন– সার্স, মার্স, ইবোলা, জিকা, নিপাহ ইত্যাদির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুহার করোনা'র চেয়ে অনেক বেশি ছিল। পরিসংখ্যান বলছে, সার্স ও ইবোলায় মৃত্যুহার ছিল সবচেয়ে বেশি। সে হিসেবে করোনাভাইরাস মরণঘাতি হলেও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নয়। বরং সচেতন প্রতিরোধই এর থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম উপায়। ইতিমধ্যে চীনে আক্রান্তের হার কমে এসেছে। ইরান, ইতালি ইত্যাদি দেশগুলোতে গৃহীত স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার সুফলও মিলতে শুরু করেছে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ বলছেন– করোনার ছোঁয়াচে বৈশিষ্ট্যের কারণেই চলমান সবরকম তৎপরতা জারি রাখা আবশ্যক।
ষড়যন্ত্রতত্ত্ব কি সঠিক?
চীনের বাণিজ্যিক, ইলেক্ট্রনিক এবং অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান উহান যেখান থেকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। সে রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সংক্রমণ হলে শুরু থেকেই বিষয়টিকে সাধারণ ভাইরাসজনিত প্রাদুর্ভাব হিসেবে না দেখে কেউ কেউ অন্যকিছুর গন্ধ পেতে থাকেন। এ নিয়ে নানা মাধ্যমে নানা ধরনের খবরও পরিবেশিত হতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো চীন-মার্কিন বাণিজ্য দ্বৈরথ! ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ নতুন মাত্রা পায়। পরিমাণের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি (১৯.৩৯ ট্রিলিয়ন ডলার)'র থেকে চীনের জিডিপি (১২.২৪ ট্রিলিয়ন ডলার) এখন কিছু কম থাকলেও সম্ভাবনার দিক থেকে চীন যে আগামী কিছু বছরের মধ্যেই তাদের ছাড়িয়ে যাবে সেটা মার্কিনীরা ভালো করেই জানে। ফলে আর্থিক দিক থেকে চীনের কাছে বিশ্বের শীর্ষস্থানটি হারানোর ভয়ে মার্কিনীরা সারাক্ষণ তটস্থ থাকছে।
এছাড়া চীনের 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রুট' শীর্ষক দীর্ঘমেয়াদী আর উচ্চাভিলাষী আর্থিক কর্মসূচিও মার্কিনীদের মাথাব্যাথার আর একটা কারণ। চীনা নেতা শি জিং পিং এর নেয়া চৈনিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা-২০২৫ এ উহান একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গৃহীত হয়েছে। উহানকে এখন বলা হচ্ছে 'শিকাগো অব দ্য ইস্ট'। গাড়ীর খুচরা যন্ত্রাংশ, হাইটেক শিল্পের যন্ত্রাংশের একটি বড় যোগান এ উহান থেকেই যায়। এছাড়া চীনের দ্রুতবর্ধনশীল স্মার্ট মোবাইল কোম্পানীগুলোর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার এবং চীনের অটো শিল্পের সদর দপ্তরও এই উহানেই। আন্তর্জাতিক আর্থিক সক্ষমতা প্রক্ষেপণও বলছে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে চীনের অর্থনীতি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকবে তৃতীয় স্থানে। আর দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসবে ভারত। আর এতোসব দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করাসহ সারাবিশ্বের সাথে তাকে বিচ্ছিন্ন করার যোগসাজশ থাকতে পারে বলে অনেকেই বিবেচনায় নিচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়ে স্বয়ং চীনের তরফ থেকে তথাকথিত ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টি নিয়ে যতো কথাই চলুক, সেটা অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ধর্তব্যে নেয়া যাচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য হুমকি আর আমাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা!
এদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ লজ্জায় মুখ ঢাকে না। নর্দমা বা ট্যানারীর মতো দুর্গন্ধযুক্ত এলাকা সন্নিকটে বসবাস করেও মুখ ঢাকে না। হাজারটা নিদারুন ব্যর্থতা আর সস্তা চরিত্রে অভিনয় করেও এদের লজ্জা পাওয়ার বালাই থাকে না। এই তারাই, হ্যাঁ তারাই করোনাভাইরাসে যাতে মরতে না হয় সেজন্যে যা কিছু পাচ্ছে তাই দিয়ে মুখ ঢাকছে। সুদূর চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে হাজার মাইল দূরের দেশ বাংলাদেশে মাস্ক পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ সত্বেও একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ মুখ থেকে কাপড় (পড়ুন মাস্ক) সরায়নি। আর চলতি সপ্তাহের শুরুতে যখন তিনজনের (যাদের দু'জন সদ্য ইতালি থেকে প্রত্যাগত, আর একজন তাদের পরিবারের সদস্য) দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত হলো তখন অধিকাংশ মানুষের মুখই ঢাকা পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিখ্যাত সুরকার ও কন্ঠশিল্পী আজাদ রহমানের গানটি মনে পড়ছে। তিনি গেয়েছিলেন– মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কী দেখে চিনবে বলো! চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন-আক্রান্ত না হলে মাস্ক পরার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তি যাতে হাঁচি-কাশির সময় অন্যকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে তাই তাকে মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। একজন সুস্থ মানুষ যদি এ অবস্থায় নিয়মিত মাস্ক পরে আর তা যদি যথাযথভাবে পরিচ্ছন্ন না রাখতে পারে তাহলে সেটা থেকে অন্যান্য জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
শুধু করোনা নয়, বরং যেকোনো ছোঁয়াচে ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার অন্যতম উপায়ই হলো ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করা। যেখাবে সাবান-পানি পাওয়া যাবে না সেক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যনিটাইজার ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ তো ভালো কথা। কিন্তু তাই বলে মাস্ক আর স্যানিটাইজারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে টু-পাইস কামিয়ে নিতে হবে? কী অদ্ভুত! গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যা খবর তাতে কোথাও হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাওয়া না যাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। দশ টাকার মাস্ক বিক্রি হচ্ছে আশি থেকে একশো টাকায় অথবা তারও বেশি দামে, ভাবা যায়! বিষয়টির স্পর্ষকাতরতা এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকায় আতঙ্কিত হয়ে মানুষ মাস্ক বা হ্যান্ড স্যনিটাইজারের খোঁজে ঔষুধের দোকানে ভিড় করবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মানুষের সাময়িক অসুবিধা আর তজ্জনিত কারণে চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় দামের যে অযৌক্তিক উল্লম্ফন সেটা কোনও সুস্থ মানসিকতার পরিচয় নয়। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এমন বেনিয়া আচরণ আসলে গলায় পাড়া দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ আমি কি বলছি, আমি তো বলছি আদর্শবাদী কথা! কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় এভাবে ভাবার সুযোগ আছে কি? আমি কি ভুলে যাচ্ছি যে আমি কোন ঘোর কলিকালে বাস করছি, যেখানে ন্যূনতম নৈতিকতা আর সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে কি কিছু অবশিষ্ট আছে? বুর্জোয়া পুঁজিবাদের কদর্য বটমলাইন হলো মুনাফা। এ ব্যবস্থার (পড়ুন অব্যবস্থা) সারকথা হলো, ইরেস্পেকটিভ অব সারকামসটেনসেস, জাস্ট মেক্সিমাইজ ইওর প্রফিট, দ্যাটস অল! আর ভুক্তভোগী মানুষের স্বার্থের কথা, সে তো বালাইষাট!
করোনায় এখন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ মারা গেছে সে বিষয়ে অনুমেয় দুঃখবোধকে স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় এতে মৃত্যুহার এখনও অনেক কম। কিন্তু ভাবুন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুধু মানুষের প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে যথাক্রমে দেড় আর আট কোটি মানুষ মারা পড়েছিল। নিহতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল আহতদের সংখ্যাও। এরপরে প্লেগ, কলেরা, গুটিবসন্ত, হাম এমনতরো আরও অনেক অনেক মরণঘাতি দুর্যোগ তো এই মানুষই মোকাবেলা করেছে। তাহলে এখন কেন এতো হাহাকার?
দুযোর্গ ঝুঁকিহ্রাস বিষয়ের যে ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্স সেখানে 'বিপদাপন্নতা' বা 'ভারনাবিলিটি' একটি বহুল চর্চিত জার্গন। যেখানে বিপদাপন্নতা হলো, যখন ব্যক্তি বা সমষ্টি স্বীয় সক্ষমতা দিয়ে ঘটমান দুর্যোগ ও পরিপার্শ্বিক আচরণে তার বা তাদের আপেক্ষিক বিপন্নতা। যাতে ভুক্তভোগী অধিকতর আর অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায় নিজেদের আবিষ্কার করে। একের পর এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আর তজ্জনিত বাস্তবতায় বিভিন্ন অ্যাক্টরদের যে হীন আচরণ আর অতলস্পর্ষী ক্ষুধা সেটাই কী মানুষের বিপন্নতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে না?