Published : 18 Dec 2019, 12:15 PM
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটির প্রকাশ্য তৎপরতা দেখা না গেলেও জামায়াত সক্রিয় আছে এবং সম্ভবত অন্য যেকোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে জামায়াত বেশিমাত্রায় সাংগঠনিক কাজকর্ম করছে। সময়টা জামায়াতের জন্য ভালো না। নানামুখী চাপের মধ্যে আছে দলটি। সরকার জামায়াতকে চাপে রাখলেও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিটি নিষ্পত্তির জন্য আদালতের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কথা আমাদের জানা। রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা জামায়াত সংগঠনকে গুছিয়ে নেওয়ার কাজ বাদ দেয়নি। সম্প্রতি জামায়াতের আমির নির্বাচিত হয়েছেন ডা. শফিকুর রহমান। রোকন বলে পরিচিত দলের ৪৫ হাজার শপথগ্রহণকারী সদস্যের ভোটে নতুন আমির নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে তিনি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ন পালন করেছেন।
ডা. শফিক আমির নির্বাচিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের হাতে জামায়াতের নেতৃত্ব অর্পিত হলো বলে মনে করা হচ্ছে। শফিকুর রহমানের জন্ম ১৯৫৮ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স কম ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে ভূমিকা পালনের সুযোগ তার ছিল না। তিনি জামায়াতে যোগ দিন ১৯৮৫ সালে। তিনি এমবিবিএস পাস করেন ১৯৮৩ সালে। জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি নেতৃত্বের ওপর দিকে স্থান পেতে থাকেন। শফিকুর রহমানের আগে জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাক্রমে অধ্যাপক গোলাম আজম, মতিউর রহমান নিজামী এবং মকবুল আহমাদ। নতুন নেতার হাত ধরে জামায়াতের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে করার কারণ নেই।
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিও করার কথা নয়। এই দলটি বাংলাদেশ চায়নি। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ঘাতক, এরা দালাল। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এরাও গর্তে লুকিয়েছিল। ছিল সময়ের, সুযোগের অপেক্ষায়। তারা সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার পর। জামায়াত নেতা গোলাম আজম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগ-মুহূর্তে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। জিয়া গোলাম আজমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আওয়ামী লীগকে জব্দ করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই জিয়া গো. আ. -জামায়াত নিয়ে কৌশলের রাজনীতি করেছিলেন। কিন্তু তার কৌশল ফাল হয়ে উঠেছে দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালরা এখন অনেক শক্তিশালী। তারা দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্ত। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। তারা রাজনীতিতে আছে, তাদের নিয়ে রাজনীতি আছে। বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষনেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন তারাও প্রেপ্তার আতঙ্কেই আছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এতো কিছুর পরও জামায়াত আছে। জামায়াত আছে, কারণ তাদের পেছনে বিএনপি আছে। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে সেহেতু তারা পরস্পর ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ– কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমাদের গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে খবর বের হয়। কদিন নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারপর সব ঠিক। বিএনপি-জামায়াত কেউ কাউকে ছাড়ে না, ছাড়ার কথা ভাবে না। বরং বাইরের সমালোচনা তাদের আরো কাছে আনে, কাছে টানে। ভাইয়ে ভাইয়ে শরিকানা বিরোধের মতো কিছু বিরোধ তাদের হয়তো হয় কিন্তু সেটা নিষ্পত্তি হয় নীরবে, সবার চোখের আড়ালে। আমার ধারণা, এই বিরোধের খবর জামায়াতের পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে দেওয়া হয়। মানুষকে, বিশেষ করে যারা জামায়াতবিরোধী তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এটা করা হয়। এ রকম খবর প্রচার হলে তাদের দিকে মনোযোগ কম থাকবে। তারা ঘর গোছানোয় অধিক তৎপর হতে পারবে। সব সময় প্রচারণায় থাকাও জামায়াতের একটি লক্ষ্য। নেগেটিভ-পজিটিভ যাই হোক না কেন জামায়াত আলোচনায় থাকতে চায়। এতে জামায়াতের ব্যাপারে মানুষের কৌতুহল বাড়ে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত অনেক এগিয়ে, অন্তত বিএনপির তুলনায় তো বটেই। তাই বিএনপিকে জামায়াতিকরণ করার কাজ তারা এগিয়ে নিতে পেরেছে।
সম্প্রতি খবর বের হয়েছে যে, জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। ২০-দলীয় জোটেও তারা সক্রিয় থাকবে না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জামায়াত বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করেছে। ভোটে ভরাডুবির পর তাদের উপলব্ধি হয়েছে যে, 'ওই জোট এখন প্রাসঙ্গিক নয়'। জামায়াত মনে করছে, 'বিএনপি যেহেতু আরেকটা ফ্রন্টে এখন সক্রিয়, সেদিক থেকে ২০-দলীয় জোটকে অনেকটাই অকার্যকর দেখছে। এ রকম একটা অকার্যকর জোটে থাকা না থাকার ব্যাপরে আগ্রহ নেই জামায়াতের। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এটা জামায়াতের নীতিগত অবস্থান নয়, কৌশলগত। সমালোচকদের চোখে ধূলা দেওয়ার কৌশল নিয়েছে জামায়াত এবং বিএনপি। দুই দলই কিছু দিন সম্পর্কের সুতা আলগা করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। তাদের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকারকে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে চায় এই দুই দল। এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই সরকার চায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ। সরকার বিএনপি এবং জামায়াত– দুই দলকেই শত্রু মনে করে। দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতোটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততোটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়। তবে সরকার জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই আশু বড় বিপদ বলে মনে করে। এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতোটা বিএনপি, ততোটা জামায়াত নয়। তাই সরকার বিএনপিকে যতোটা চাপে রাখতে চায়, জামায়াতকে হয়তো ততোটা নয়। কিন্তু গত সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সরকাকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ করে দিয়েছে। ভোটে জামায়াত জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একটি আসনেও তারা জয় পায়নি। জামায়াতের জনসমর্থন নিয়ে যে মিথ তৈরি করা হচ্ছিল সরকার তা সফলভাবে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জনপ্রিয় দাবিটি সরকার এতোদিন সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই গা করেনি। এবার নির্বাচনের মাঠে এদের ধরাশায়ী করার পর সরকার হয়তো জামায়াতকে আর ছাড় দেবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি মামলা আদালতে আছে। মামলাটি এবার সচল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জামায়াতও সেটা বুঝতে পারছে। জামায়াত বুঝতে পারছে যে, এবার তারা রেহাই পাবে না। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা নিষিদ্ধ হলে কোন কৌশলে আগাবে সেটাই এখন তাদের ভাবনার বিষয়। সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা দূরত্ব তৈরির গল্প বানাচ্ছে। জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে, তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফনা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে একই কৌশল বারবার ভালো ফল দেয় না।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন কৌশলে অগ্রসর হবে তা নিয়ে দলটির ভেতর আলোচনা, বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক পক্ষ 'রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বেশি করে সক্রিয় হওয়া'র দিকে, অন্যপক্ষ নাম পাল্টিয়ে নতুনভাবে রাজনীতির মাঠে নামাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছে। অন্য দলের ভেতরে ঢুকে কাজ করার চিন্তাও আছে। এখনও বিভিন্ন দলে জামায়াতের 'অনুপ্রবেশকারী' আছে। জামায়াত যদি নতুন নামে পুনর্গঠিত হওয়ার কথা ভাবে তাহলে হয়তো জামায়াতের একটি বড় অংশ বিএনপিতে বিলীন হবে। কারণ বিএনপি হলো জামায়াতের স্বাভাবিক মিত্র। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসও কাছাকাছি। 'মুক্তিযুদ্ধ' প্রশ্নে দুই দলের অবস্থানে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এখন তা এখন কমে এসেছে। জামায়াত যদি বিএনপিতে লীন হতে চায় তাহলে বিএনপি অখুশি হবে বলে মনে হয় না। বরং বিএনপি হয়তো তেমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে। অবশ্য জামায়াতের কারো কারো টার্গেট আওয়ামী লীগের দিকে থাকবে না তাও বলা যায় না। দলে জামায়াতে ঢোকানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উদারতাও দেখা গেছে।
তবে এগুলো অনুমাননির্ভর আলোচনা। জামায়াত সত্যি নিষিদ্ধ হবে কিনা, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কী কৌশল নেবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক না কেন, জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি এবং জামায়াতের রাজনীতি সহজে শেষ হচ্ছে না। জামায়াত রাজনীতির মাঠও ছাড়বে না। তাদের আর্থিক বুনিয়াদ যতোদিন দুর্বল না হবে, যতোদিন অন্য রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থে জামায়াতকে ব্যবহার করতে চাইবে এবং সর্বোপরি কিছু মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা যতোদিন দূর না হবে ততোদিন জামায়াত তাদের কৌশলের খেলা অব্যাহত রাখবে। নেতৃত্ব বদল হলেও জামায়াতের নীতি বদলের কোনো সম্ভাবনা নেই। সময়ের প্রয়োজনে কিছু কৌশল বদল করতে পারে।