Published : 11 Nov 2019, 04:49 PM
[পূর্বকথা: তথাকথিত চরিত্রহীনা এক স্ত্রীর পরকীয়ার যারপরনাই নারাজ হয়ে হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতলের আদেশ দেবেন। কয়েক বৎসরে শত শত যুবতী বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি করুণাপরবশ হয়ে বোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে নিজে থেকেই বাদশা শাহরিয়ারকে নিকাহ করেন। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় সুন্দরী শ্যালিকা দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক দিনারজাদি শেহেরজাদিকে একেকটি সওয়াল পুছেন। শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না করে সওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন, কিন্তু ভোরের আজান হওয়া মাত্র সওয়াল-জওয়াব বন্ধ করে দুই বোন শুয়ে পড়েন। বাদশাহ যেহেতু সওয়াল শুনতে এবং জওয়াব জানতে আগ্রহী, সেহেতু দিনের পর দিন শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড মুলতবি হতে থাকে। আজ সওয়াল-জওয়াবের চতুর্দশ রাত্রি]
প্রতি শেষ রাতে দিনারজাদি ঘুম থেকে জেগে শেহেরজাদির ঘুম ভাঙিয়ে সওয়াল শুরু করে। আজ এক দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে নিজেই বিছানার উপর উঠে বসে দিনারজাদি। কক্ষে হঠাৎ নড়াচড়ার শব্দে বাদশারও ঘুম ভেঙে যায়। বাদশা পানিপূর্ণ একটি স্বর্ণ-সোরাহি এগিয়ে দেয় শ্যালিকা দিনারজাদির মুখের দিকে। বাদশার পানি গ্রহণ করে প্রকৃতিস্থ হয়ে দিনারজাদি বলে: "স্বপ্নে দেখলাম, বাংলাদেশের সব রাস্তা গ্র্যাজুয়েটে ভরে গেছে। সব গ্রাম-থানা-জেলাশহর থেকে গ্র্যাজুয়েটরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবন অবরোধ করতে ছুটে আসছে। তারা চিৎকার করে বলছে: 'দাও ফিরিয়ে দাও আমার জীবনের চার চারটি বছর!' 'আমার ডিগ্রি অবৈধ কেন, প্রশাসন জবাব চাই!' লক্ষ লক্ষ গ্রাজুয়েটের ভীষণ শ্লোগান-চিৎকার! উফ! সে যে কী ভয়ঙ্কর! ঘুম ভাঙার পরেও যেন আমার কানে তালা লেগে আছে।'
'তোমার স্বপ্ন পুরোপুরি অমূলক নয়, দিনারজাদি!'
'এ কথা তুমি কেন বলছো দিদি? আমার দুঃস্বপ্ন কেন সত্যি হতে যাবে? এত সব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিইবা অবৈধ হবে যাবে কেন?'
বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অবৈধ হতে পারে, যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা-প্রক্রিয়া ঠিকঠাকমতো অনুসরণ না করে থাকে। তবে 'বোঝার উপর শাকের আঁটি'-র মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অবৈধ হবার একটি অতিরিক্ত কারণ আছে, যদি সার্টিফিকেটে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি নাম Dhaka বানানে লেখা হয়।
শোনো দিনারজাদি, 'বিশ্ববিদ্যালয়' নামক প্রতিষ্ঠানটির শুরু ইওরোপের ইতালি এবং ফ্রান্সে, মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে, দ্বাদশ শতকে। 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: আদিপর্ব' পুস্তকে শিশির ভট্টাচার্য্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ লোকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত ইতিহাস জানে না, জানার প্রয়োজনবোধও করে না।
মধ্যযুগে সূচনাপর্ব থেকেই সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ইত্যাদি কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু একটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু অন্ততপক্ষে লেখাপড়া কিংবা পরীক্ষার ব্যাপারে আর কোনো কমিটিই একাডেমিক কাউন্সিলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা ক্ষমতাবান নয়। মধ্যযুগ থেকেই একাডেমিক কমিটির সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল পরীক্ষার অনুমোদন দিয়ে আসছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের '৭৩ সালের অধ্যাদেশের ১নং ক্যালেন্ডারের ৩২ পৃষ্ঠায় এবং ২নং ক্যালেন্ডারের ২৩২-৩৩ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার লেখা আছে, বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট তাদের প্রতিটি পরীক্ষা-কমিটি এবং পরীক্ষকের নাম একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠাবে। একাডেমিক কাউন্সিলে পরীক্ষা-কমিটি অনুমোদন ও পরীক্ষক নিয়োগপর্ব সমাপ্ত হবার পর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষা 'কন্ডাক্ট' করতে শুরু করবেন, তার আগে নয়। মনে রাখতে হবে, কন্ট্রোলার অব এক্সাম বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষা সমূহের 'কন্ডাক্টর' বা পরিচালক মাত্র। রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তবে একাডেমিক কাউন্সিল হবে পার্লামেন্ট বা আইন প্রণয়ন বিভাগ এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিস হবে শাসন বিভাগের একটি অংশ। শাসন বিভাগ আইন প্রণয়ন বিভাগকে বলতে পারে না, কীভাবে কী করতে হবে, কোন আইন পাশ করাতে হবে কিংবা হবে না। একইভাবে, বিভিন্ন পরীক্ষা কমিটির অনুমোদন নেবার জন্যে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করার এখতিয়ারও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের নেই।
অথচ বাস্তবে কী হয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কোনো ইনস্টিটিউট বা বিভাগ তাদের পরীক্ষা কমিটি সরাসরি একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠায় বলে মনে হয় না। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সচিবের এই 'সৃষ্টিছাড়া' প্রশাসনিক কার্যক্রমের কারণে একাডেমিক কাউন্সিলের সম্মানিত সদ্যস্যরা ইনস্টিটিউটের পরিচালককে নিয়ে হাসাহাসি করে আসছে গত এক বছর ধরে। সিনিয়র অধ্যাপকেরা তাকে অযাচিত (নাকি 'অজাচিত'?) উপদেশ দিয়ে থাকেন, কীভাবে তার প্রশাসন পরিচালনা করা উচিত। ডিনগণ– বিশেষত বিজ্ঞান অনুষদের বর্তমান ডিন পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, কোনো পরীক্ষা কমিটি একাডেমিক কাউন্সিলে আসতেই পারে না। একাডেমিক কাউন্সিলের সম্মানিত অধ্যাপকেরা প্রায় সবাই ডিনের সঙ্গে নিরঙ্কুশ ঐক্যমত্য পোষণ করেন।
দিনারজাদি, ৭৩-এর অধ্যাদেশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কিংবা পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পদ্ধতি দেখলে তুমি নিশ্চয়ই একমত হবে, যে সব পরীক্ষা কমিটি কিংবা পরীক্ষক পরীক্ষা সংঘঠিত হবার পূর্বে (হ্যাঁ, অবশ্যই পূর্বে) একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন পায়নি, সেই পরীক্ষাগুলো অবৈধ হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। পরীক্ষা অবৈধ হলে ডিগ্রিও অবৈধ। বিবাহ যদি অবৈধ হয়, সন্তান কি বৈধ হবে? আর অবৈধ বিয়ের অনুষ্ঠানে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়াও কি বৈধ আচরণ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা প্রশ্ন করেছেন: পরীক্ষা কমিটির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরীক্ষার জন্যে যে সম্মানী-পারিশ্রমিক নিয়েছেন, গত দশ-বিশ বছরে, তাও কেন অবৈধ হবে না? এই আয় হারাম না হালাল তা অবশ্য ধর্মবিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
'কত দিন ধরে এই আইন-অসঙ্গত, অবৈধ পরীক্ষা-কার্যক্রম চলছে দিদি?'
ঠিক জানি না, দিনারজাদি। বাংলাদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খবর নিয়েছি আমি। প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন, পরীক্ষা কমিটিগুলো একাডেমিক কাউন্সিলেই অনুমোদিত হওয়া উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা কমিটিগুলো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বা কন্ট্রোলার অব এক্সামের কাছে পাঠানোই দস্তুর, কারণ বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কোনো না কোনোভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুলিপি। পরীক্ষা-টরীক্ষা সব চুকে যাবার পর নাকি সুযোগ ও অবসর বুঝে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষা কমিটিগুলো একাডেমিক কাউন্সিলকে দিয়ে সব কিছু অনুমোদন করিয়ে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেছেন, এম.ফিল. এবং পি.এইড.ডি. ছাড়া বাকি পরীক্ষা-কমিটিগুলো একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠানোর নিয়ম যে আছে, সেটা তারা বাপের জন্মে শোনেননি। এর মানে হচ্ছে, কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে '৭৩-এর অধ্যাদেশ কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে স্ব স্ব স্ট্যাটিউট বা ক্যালেন্ডার পড়ে দেখেন না। একাডেমিক কাউন্সিলের সম্মানিত সদস্যরা অধ্যাদেশ না পড়েই সবজান্তার ভাব দেখান।
'এতে সমস্যা কী, দিদি? পরীক্ষা-টরীক্ষা সব চুকে গেলে পরে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক একাডেমিক কাউন্সিলে পুরো ব্যাপারটা রিপোর্ট করে অনুমোদন করিয়ে নিলে সমস্যা কী?'
এখানে কমপক্ষে দুটি সমস্যা আছে। মনে করো, তুমি একজনকে বিচারক নিয়োগ দিলে আদালতে। সেই বিচারক নিজের খেয়ালখুশীমতো কয়েক জনের বিচার-টিচার করে ফাঁসিটাসি দিয়ে দিল। এর বেশ কিছুদিন পর তুমি সেই বিচারকের নিয়োগ বৈধ করে নিতে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে। উচ্চতর কর্তৃপক্ষ বিচার-বিবেচনা করে দেখলো, তোমার বিচারক নিয়োগে মহাভুল হয়েছিল– বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া লোক ছিল মস্তিষ্ক-বিকৃত, ('বদ্ধ' নয়) 'মুক্ত' পাগল। সুতরাং তাকে বিচারক নিয়োগ দেয়া যাবে না। এখন ফাঁসি হওয়া লোকগুলোর আত্মীয়-স্বজন কিংবা রাতের বেলায় অভিযোগ করতে আসা সেই সব অশরীরী (যদি থাকে!) আত্মাকে তুমি কী জবাব দেবে? একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন না নিয়ে নিযুক্ত কমিটিতে যদি তেমন কেউ থাকে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বিরুদ্ধেই আধা কিংবা পুরা পাগল হবার অভিযোগ শিক্ষার্থীরা প্রায়ই করে থাকে। লাউঞ্জে কিংবা ক্লাবে ঢুকলেই এ ধরনের দুই একজন শিক্ষকের দেখা পাবে তুমি।
দ্বিতীয় সমস্যা: পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রক কিংবা কন্ট্রোলার অব এক্সাম হচ্ছে একটা যন্ত্র। ধরা যাক, তুমি ফাইলপত্র নিয়ে রিকশায় উঠে বসেছো। কোথায় তুমি রিকশাওয়ালাকে বলবে, তুমি কোথায় যেতে চাও, তা নয়, উল্টা রিকশাওয়ালা যদি তোমাকে বলে: 'আফা, আফনের ফাইলডা এড্ডু দেহি!' তুমি কি একটুও অবাক হবে না দিনারজাদি? একেকটি পরীক্ষা-কমিটি কিংবা পরীক্ষকদের নাম-পরিচয় কন্ট্রোলার অব এক্সামের পক্ষ থেকে একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠানোর ব্যাপারটা মূলত তাই। একাডেমিক কাউন্সিল পরীক্ষা কমিটি অনুমোদন করার পর কন্ট্রোলার অব এক্সাম পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারে, তার আগে নয়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতা যায় না। নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকতে শুরু করার পর বিয়ে অবশ্যই করা যায়, কিন্তু সেক্ষেত্রে বিয়ের আগে পর্যন্ত একত্রবাসটা বৈধ হয়ে যায় না। বাংলাদেশে ধর্ষণকারীর সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। এতে সমাজের দৃষ্টিতে ধর্ষণ স্বাভাবিক সহবাস হিসেবে বিবেচিত হয় বটে, কিন্তু যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণ ধর্ষণই থেকে যায় না কি?
পরীক্ষা-আইন ভঙ্গের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এক প্রাক্তন 'প্রভোস্টেস' (হোস্ট>হোস্টেস, প্রভোস্ট>প্রভোস্টেস) বলেছেন, আইনের ব্যাখ্যাভেদে একাডেমিক কাউন্সিলে পরীক্ষা কমিটি অনুমোদন না করানোর প্রথা (মূলতঃ কুপ্রথা) সমর্থনযোগ্য হতেও পারে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা লিখেছেন: 'ব্যাখ্যায় করিতে পারি ওলট পালট। সভাশুদ্ধ হেঁকে বলে: হিং টিং ছট।' না, যত ব্যাখ্যাই আপনি দেন ম্যাডাম, একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়া কোনো পরীক্ষা কমিটি বৈধ হতে পারে না। পৃথিবীর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপারটা এ রকম, মধ্যযুগ থেকে এরকটাই হয়ে আসছে এবং এরকমই হওয়া উচিত।
'কিন্তু দিদি, 'প্রথা' কিংবা 'রীতি' বলেওতো একটা কথা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষতো বলতেই পারে যে একাডেমিক কাউন্সিলে পরীক্ষা কমিটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়া আমাদের রীতি নয়। কন্ট্রোলার অব এক্সামকে দিয়ে অনুমোদন নেওয়া আমাদের দীর্ঘদিনের প্রথা। যেহেতু মানুষ আইন শুধু নয়, প্রথা মেনেও কাজ করে, সেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অবশ্যই বৈধ। যে দেশে লাল-সবুজ আলো মেনে গাড়ি চলে না, সেদেশে, যেমন ধরা যাক, বাংলাদেশে, সেটাই আইনে পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে তুমি যদি লাল আলোতে গাড়ি থামিয়ে দাও, তবে তুমি আইন ভাঙছো!'
হ্যাঁ দিনারজাদি, ঠিক এ রকম মন্তব্য করেছেন বটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রায় বয়স্ক, পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত একজন শিক্ষক। সেক্ষেত্রে দিনারজাদি, ক্রসফায়ার, বিনাবিচারে হত্যাও তো বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের প্রথা, সিরাজ সিকদার থেকে যার শুরু এবং এখনও প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ক্রসফায়ারে মরছে। তোমার মতে এই প্রথাও নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আইনে পরিণত হয়েছে! এই পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগেরই আরেক তরুণ শিক্ষক।
দিনারজাদি, যখনি কোনো জাতি আইন প্রণয়ন করে এবং সেই আইন সংসদে পাশ করিয়ে নেয়, তখন আর প্রথার দোহাই দেবার উপায় থাকে না। লাল-সবুজ আলোর সিগন্যাল উপেক্ষা করার প্রথা মানার প্রশ্ন আসবে, যদি লাল-সবুজ সিগন্যাল রাস্তায় না থাকে। এই সিগন্যাল রাস্তায় আছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত সম্প্রতি ট্র্যাফিক লাইট মানার কথা তুলেছেন। '৭৩-এর অধ্যাদেশে যখন পরিষ্কার লেখা আছে, একাডেমিক কাউন্সিলের প্রাথমিক অনুমোদন ছাড়া পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারবে না, তখন প্রথা কিংবা রীতির দোহাই দিয়ে ধানাইপানাই করার অবকাশ নেই।
'এ রকমতো হয় দিদি বাংলাদেশে। যেমন ধরো, ক্যাসিনোর বৈধতা চেয়ে বাংলাদেশের আদালতে অনেকগুলো রিট হয়েছে গত দুই দশকে, সরকার প্রধান পর্যন্ত কোনো একটি দ্বীপ কিংবা চরে পাঁড় জুয়ারিদের জন্যে ক্যাসিনো খোলার প্রস্তাব দিয়েছেন নিজমুখে, যখন কিনা বাংলাদেশের সংবিধানেই পরিষ্কার লেখা আছে: জুয়া অবৈধ।'
প্রিয় দিনারজাদি, কোনো কুতর্কপ্রিয় বাঙালি বলতেই পারে: 'ক্যাসিনো ঠিক জুয়া নয়। অনেক বোতলপাণি মদ্যপায়ী যেমন বলে থাকে: 'ধর্মে মদ নিষিদ্ধ, কিন্তু আমিতো মদ খাই না, বাওয়া, স্কচ হুইস্কি খাই!'
'দিদি, এক অধ্যাপিকা জিগ্যেস করেছেন: 'সেমিস্টার সিস্টেমও তো '৭৩-এর অধ্যাদেশে নেই। সেমিস্টার কি বৈধ? সেমিস্টার সিস্টেমে এত তাড়াতাড়ি পরীক্ষার সময় এসে পড়ে যে একাডেমিক কাউন্সিলে পরীক্ষা-কমিটি অনুমোদন করিয়ে নেবার সময় পাওয়া যায় না।'
প্রিয় দিনারজাদি, লেখাপড়া সেমিস্টার নাকি বছরমেয়াদী হবে– এটা '৭৩-এর অধ্যাদেশের সমস্যা নয়। পরীক্ষা-কমিটি একাডেমিক কাউন্সিলে অনুমোদিত হতে হবে– এটা অধ্যাদেশের শর্ত। এই শর্ত কীভাবে মানা হবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমস্যা। প্রতি তিন মাস অন্তর একাডেমিক কাউন্সিল বসে। প্রতি সেমিস্টারের শুরুতেই পরীক্ষা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে একাডেমিক কাউন্সিলও বসতে বাধা নেই। সদিচ্ছা থাকলে '৭৩-এর অধ্যাদেশ মানা কঠিন কিছু নয় এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট যথাযথভাবে তা মেনেও থাকে।
'দিদি, অধ্যাদেশে নেই এমন অনেক কিছুইতো করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমন ধরো, উপাচার্য মহোদয়েরা কথায় কথায় বলেন: 'ডিনস কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে!' 'ডিনস কমিটি' বলে কি কিছু আছে '৭৩-এর অধ্যাদেশে?'
প্রিয় দিনারজাদি! তোমার কথা সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদে পদে অনিয়ম। উপাচার্যগণ অধ্যাদেশ মেনে নয়, বরং নিজের খেয়ালখুশীমতো প্রশাসন চালান। বেহুদা অপমানিত হবার ভয়ে উপাচার্যদের কাছেই যেতে চায় না অনেকে। কে না জানে, ডিনস কমিটি একটি ভুঁইফোর কমিটি? বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন কমিটি থাকবে তা অধ্যাদেশে পরিষ্কার বলা আছে। এর বাইরে কোনো কমিটি গঠন করার এখতিয়ার প্রশাসনের নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের শাসনবিভাগের প্রধান হিসেবে তুমি এমন কিছুই করতে পারো না, যা করার এখতিয়ার অধ্যাদেশ কিংবা সংবিধান তোমাকে দেয়নি।
একেক উপাচার্য একেক অপকর্ম করে প্রবল সমালোচনার মুখে, ধর্মের কাহিনি যারা শুনে না তাদের মতো, রাতের নীলিম অন্ধকারে কালিমালিপ্ত মুখে বিদায় হন এবং নতুন উপাচার্য প্রাক্তন উপাচার্যের অপকর্মগুলো বিনা প্রশ্নে অনুসরণ করেন। সব উপাচার্যের নবীন-বরণ হয়, প্রথম কর্মদিবসে ফুলে ফুলে ভরে যায় অফিস, কিন্তু কারোই বিদায়-সম্বর্ধনা হয় না। হায়! উপাচার্যের ভাগ্য শিক্ষার্থীদের চেয়েও খারাপ।
ব্রিটিশ আমলের জননিপীড়নমূলক কালো আইন পাকিস্তান আমলে কাজে লেগেছিল। পাকিস্তান আমলের কালো আইন বঙ্গবন্ধুও বাতিল করেননি। পরে স্বৈরাচারী জিয়া এবং এরশাদও এই সকল কালো আইন ব্যবহার করেছেন। এটাই বাংলাদেশের ঐতিহ্য, লিগেসি। 'লিগেসি অব স্টুপিডিটি' যার ফলশ্রুতি 'লিগেসি অব ব্লাড'! এই 'ডিনস কমিটি' ছিল উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের অপকর্মের টুপিতে অন্যতম পালক, যে পালক বর্তমান উপাচার্যও সগর্বে নিজের টুপিতে গুঁজে রেখেছেন।
'৭৩ এর অধ্যাদেশ যাঁরা রচনা করেছিলেন সেই অধ্যাপক কিংবা বিচারপতিগণ আমাদের উপাচার্যদের চেয়ে কম জ্ঞানী ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যলয় কাঠামোতে ডিনস কমিটি না থাকার অন্যতম কারণ কি জানো? বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ আছে, ইনস্টিটিউটও আছে। অনুষদগুলো ডিনের অধীন, ইনস্টিটিউটগুলো পরিচালকের অধীন। ডিন মহোদয়গণ নির্বাচিত হন, ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিয়োজিত হন জ্যেষ্টতার ভিত্তিতে। প্রথমত, তেলে আর জলে মেশার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, ডিনস কমিটি থাকলে ডিরেক্টর্স কমিটি থাকবে না কেন? ডিনস কমিটিতে ইনস্টিটিউটের কাজকর্ম অনুমোদন বা বাতিল করা হয়, যা যে কোনো বিচারে অবৈধ। ডিনস কমিটি যে আইন ও যুক্তির ব্যত্যয় – তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।
'দিদি, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিষিদ্ধ হবার অতিরিক্ত একটি কারণের কথা বলেছিলে তুমি আলোচনার উজানে!'
স্বৈরাচারী লেজেহোমো এরশাদ শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বানান Dacca এর পরিবর্তে Dhaka কে বৈধ করেন। এ কাজটা যে ঠিক হয়নি, সে বিষয়ে শিশির ভট্টাচার্য্য 'যা কিছু ব্যাকরণ নয়' বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। স্বৈরাচার আমলের কিছু আইন, কিছু রায় নিষিদ্ধ হয়েছে, কারণ তা না হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যায় না। 'ঢাকা' শব্দের পরিবর্তিত ইংরেজি বানান Dhaka সম্ভবত বৈধ থেকে গেছে। বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন, রায় প্রদান কিংবা বাতিল করাতে যুক্তি যতটা থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে রাজনীতি।
ঢাকা শব্দের পুরনো ইংরেজি বানান বাতিল হওয়ার মানে এই নয় যে ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা শব্দবন্ধেও Dacca বানান বদলে যাবে। প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের বানান উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে বদলে নিতে হয়। তা যদি না করা হয়, তবে পুরনো বানান বহাল থাকে। বহাল থাকতে হয়, কারণ নামের বানানেরও একটা বাণিজ্যিক মূল্য থাকতে পারে। সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে যদি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়, তবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের সাহায্যপ্রার্থী হতেই পারে। কলিকাতা শহরের নামের ইংরেজি বানান বদলে Kolkata হয়েছে, কিন্তু 'কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়' শব্দবন্ধে 'কলিকাতা' শব্দের ইংরেজি বানান Calcutta বহাল আছে, যদিও ঠিকানার জায়গায় Kolkata লেখা হয়। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা হবে: University of Dacca, Nilkhet road, Dhaka 1000। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি নিজের নামের ইংরেজি বানান বদলানোর জন্যে আবেদন না করে থাকে, তবে এই প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি নামে পুরনো Dacca বানান বহাল আছে। তাই যদি হয়, University of Dhaka নামাঙ্কিত যে সব সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে আশির দশক থেকে, সেগুলো অবৈধ হবার আইনগত ও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বানান-যুক্ত নামের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আপাতত বাংলাদেশে নেই।
'প্রিয় দিদি আমার, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত কেন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও বলবৎ হবে না? প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কি রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী? তাছাড়া, দিদি, ভারত আর বাংলাদেশ আলাদা দুটি দেশ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ইংরেজি বানান অটুট আছে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ইংরেজি বানানও যে বদলাবে না– এমন কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে?'
বাদশার শয়নকক্ষের এক প্রান্তে একটি মোটা স্তম্ভ কিংবা থাম ছিল। শেহেরজাদি ছোটো বোনের উপর রেগে গিয়ে সেই থামটি দেখিয়ে বললো: 'ঐ যে থামটি দেখছো, তোমার বুদ্ধি, দিনারজাদি, ঐ থামের মতো মোটা। তোমাকে আর কী বলবো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকও আমাকে এই একই প্রশ্ন করেছেন।' ইংরেজিতে 'কমনসেন্স' বলে একটা কথা আছে। লেখাপড়া বেশি করতে গিয়ে তোমাদের কমনসেন্সের সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। গাছের জন্য তোমরা আর বন দেখতে পাও না। তুমি কি জানো না, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান– উপমহাদেশের সব দেশের আইনের ভিত্তি ব্রিটিশ আইন? বাংলাদেশের আইনপ্রণেতাদের যদি ঠিকঠাকমতো চিনে থাকো, তবে তুমি নিশ্চয়ই তাদের ক্ষমতা ও বিদ্যার দৌঁড় জানো। খুব বেশি আইন বদলানোর যোগ্যতা কিংবা অবসর কোনোটাই বাংলাদেশের সাংসদদের নেই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আর ভারতের আইনের মধ্যে খুব বেশি ফারাক হবার কোনো কারণ নেই।
'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিতরের একেকটি হাঁড়ি কি এভাবে সামাজিক গণমাধ্যমের হাটে ভেঙে দেওয়া তোমার কি উচিত হচ্ছে দিদি?
হাঁড়ি থাকলে ভাঙতে হবে, দিনারজাদি। পুরনো হাঁড়ি না ভাঙলে নতুন হাঁড়ি আসবে না। বাংলা অঞ্চলে এই কিছুদিন আগেও পহেলা বৈশাখে মাটির পুরনো হাঁড়ি ভেঙে নতুন হাঁড়ি নেবার প্রথা ছিল। এখন হাঁড়ি তৈরির উপাদান বদলে যাওয়াতে হাঁড়ি আর ভাঙা হয় না। একই হাঁড়িতে যুগের পর যুগ রান্না করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। এতে সুবিধা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু একঘেয়েমিও আসছে না কি?
তিনটি কারণে হাটে হাঁড়ি ভাঙা উচিত। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সেনাবাহিনী কিংবা আমলাতন্ত্রের তফাৎ এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মসমালোচনার সুযোগ আছে। আত্মসমালোচনা ছাড়া কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান অগ্রসর হতে পারে না। মধ্যযুগ থেকে আত্মসমালোচনার আগুনে পুড়ে খাঁটি হচ্ছে বলেই বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানটি মানব সমাজে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে পেরেছে। সেনাবাহিনী আজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেনাবাহিনী গঠন করছে না। আত্মসমালোচনা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ হতো না, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ না হলে রেনেসাঁ সংঘঠিত হতো না। আজকের প্রযুক্তিগত ও দৃষ্টিভঙ্গীগত উন্নয়ন শতভাগ ইওরোপীয় রেনেসাঁর অবদান।
দ্বিতীয়ত, পাবলিকের টাকায় চলে বলেইতো ঢাকা কিংবা রাজশাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিকের টাকায় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়। এর মানে হচ্ছে, পাবলিক মহোদয় হচ্ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাবলিকের তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাকর মাত্র। চাকর তার কাজ ঠিকঠাকমতো করবে না, আবার মালিকের কাছে সেই কামচুরির ঘটনা লুকাবে– এমন অনাচার কি মেনে নেওয়া যায়? তুমি নিজেই কি তোমার কাজের বুয়ার এমন ধারা আচরণ মেনে নেবেন?
তৃতীয়ত, আজ থেকে বছর দশেক পরে রাষ্ট্রের প্রধান কাণ্ডারী যখন জিগ্যেস করবেন (যেমনটা তিনি ক্যাসিনো কাণ্ডের ক্ষেত্রে করেছেন!): 'এত শত অনাচার চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ কিছু বলেনি কেন?" তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা বিজ্ঞ অধ্যাপকেরা কী উত্তর দেবেন?
'দিদি, তুমি বলেছো, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবেদন না করলে বাণিজ্যিক আইন অনুসারে কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিনামের বানান বদলাতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান?' ভূপাতিত হতে হতে দিনারজাদি যুক্তি-কুস্তির শেষ মোচড়টি দেবার চেষ্টা করে।
'ঘরের কোণে ঐ থামটির দিকে তাকাতে বলেছিলাম না তোমাকে, দিনারজাদি? তোমার প্রশ্নের উত্তর ঐ মোটা থামের মধ্যেই আছে, কারণ বোধ-বুদ্ধি তোমার ঐ থামের মতোই নিরেট কিংবা মোটা!'
দিনারজাদি নতুন কোনো প্রশ্ন করার সাহস করে না। বাদশা বরাবরের মতোই নিশ্চুপ।
স্বগতোক্তি করে নীরবতা ভাঙলেন শেহেরজাদিই। নিজেদের অধ্যাদেশ নিজেরা না মানা, এই সব কাণ্ডজ্ঞানহীন শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল যে বিশ্ববিদ্যালয় সেটি কি আদৌ র্যাংকিং-এ আসা উচিত? অঙ্কের নিয়মই যে জানে না এবং মানে না, তার উত্তর যদি মিলেও যায়, তাকে পাশনম্বর দেয়া কি উচিৎ হবে?
[ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলো এবং ভোরের আযানও শোনা গেল। শেহেরজাদি প্রতি রাতের মতোই কথা থামিয়ে দিলেন। ফজরের নামাজ পড়ে নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন দুই বোন। বাদশা শাহরিয়ারও ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়ে গেলেন। প্রতিরাতের আলোচনায় ঋদ্ধ হচ্ছিলেন বলে শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড পরের সকাল পর্যন্ত স্থগিত করলেন বাদশা নামদার শাহরিয়ার।]