Published : 21 Oct 2019, 03:40 PM
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা নিয়ে গল্পের শেষ নেই। সবজেলাকে পেছনে ফেলে ফেনী, নোয়াখালী আর বরিশাল এগিয়ে আছে। যেমন নোয়াখালীর মানুষরা এখনও স্বপ্ন দেখেন মহাত্মা গান্ধীকে। তাদের স্বপ্নে আসেন মহাত্মা গান্ধী। এরপর জানতে চান- আমার পোষা ছাগলটাকে দেখেছেন? আসলে গান্ধীকে নিয়ে যে গল্পটা প্রচলিত তা হচ্ছে গান্ধীজী শেষবারের মতো যখন নোয়াখালীতে এসেছিলেন (নোয়াখালীতে গান্ধীজীর আশ্রম আছে এখনও) তখন কে বা কারা তার পোষা ছাগল ধরে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলেছিল!
ফেনীর গল্পটাও সবার জানা। নেইল আর্মস্টং চাঁদে যেয়ে দেখলেন তিনি চাঁদে নামা প্রথম ব্যক্তি নন। আরও একজন আছে। তিনি জানতে চাইলেন- হু আর ইউ? চাঁদে অলরেডি উপস্থিত ঐ লোক বললো- আই আরি। আর্মস্ট্রং আবারও জানতে চাইলেন- হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার? উপস্থিত লোকটা বললো- হেনীত্থন ইয়ানে আই পাথ্থুর টোয়াই!
আর বরিশালের অদূরে কাশিপুর নামের একটা জায়গা আছে। বহুবছর ধরে এ গল্প প্রচলিত যে, মামলা মোকাদ্দমায় সাক্ষীর দরকার হলেই মানুষ ছুটে যেত বরিশালের কাশিপুরে। টাকার বিনিময়ে সাক্ষী দেয়ার লোকের অভাব নেই সেখানে। একদা এই বাংলাদেশে 'সাক্ষী' নামে একটা বাংলা ছবি হয়েছিল যার গান ছিল এমন- মিথ্যা সাক্ষীর দরকার হলে খবর দিও ভাই!
তবে ইদানিং একজন বিখ্যাত সাক্ষীকে পাওয়া গেছে যিনি গত পঞ্চাশ বছর ধরেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বিখ্যাত এই মানুষটার নাম রাশেদ খান মেনন (রা খা মেনন)। তিনি ভোটের সাক্ষী হয়ে বলেছেন- 'একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (ডিসেম্বর,২০১৮) মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এর বড় সাক্ষী আমি নিজেই। আজ মানুষ তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আমি নিজে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। আজ সেই ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে না। এমনকি উপজেলা নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ভোটের অধিকার হারাচ্ছে মানুষ'। তিনি আরো বলেছেন- যে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না সে দেশের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে!
উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়লে আমাদের সবার জন্যই সেটা দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে তার এই বক্তব্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনার আগে জেনে রাখা ভালো যে, রাশেদ খান মেনন আগে 'বরিশালবাসী' ছিলেন। তিনি জন্মেছেন বরিশালেই। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ থেকে নির্বাচন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে বাবুগঞ্জ-গৌরনদী আসন থেকে এবং ১৯৯১ সালে বাবুগঞ্জ-উজিরপুর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাশেদ খান মেনন ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে (আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলের জোট) হিসেবে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী নিযুক্ত হন তিনি। পরে ২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং সর্বশেষ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের সময়ে রাশেদ খান মেনন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জোট বেধেছিলেন খালেদা জিয়ার সাথে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কাস পার্টি অংশ নেয়নি। মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ, খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সাথে মিলেমিশে বিপ্লবী রাজনীতি করার বিশাল অভিজ্ঞতা আছে মেনন সাহেবের। তারও আগে ছাত্ররাজনীতিতে তার উজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ রাশিয়া ও চীন দুইভাগে বিভক্ত হওয়ার সময়ে মেনন সাহেব পিকিংপন্থী ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন, ১৯৭১ সালে ত্রিপুরার মেলাঘরে গিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে উজ্জ্বলতর ভূমিকা ছিল মেনন সাহেবের।
কিন্তু বরিশালের গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে নির্বাচনী এলাকা পরিবর্তনের পর ভয়াবহ অভিযোগ ওঠে মেনন সাহেবের বিরুদ্ধে। একজীবনে তিনি এমন অভিযোগের মুখোমুখি হননি। এমপি নির্বাচিত হবার পর তাকে তার নির্বাচনী এলাকার ফকিরেরপুল ইয়াংমেন্স ক্লাবের চেয়ারম্যান বানানো হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর জানা যায় সবচেয়ে বেশি ক্যাসিনো রাশেদ খান মেননের নির্বাচনী এলাকায়। বিভিন্ন দৈনিক, অনলাইন দৈনিক ও টেলিভিশনে মেনন সাহেবের ক্যাসিনো কানেকশন নিয়ে রিপোর্ট হয়। একটি জনপ্রিয় দৈনিকের রিপোর্ট হুবহু তুলে দিচ্ছি- 'জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র জানায়, সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূইয়া পরিচালিত ক্যাসিনোর টাকার ভাগ ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও পেতেন। এ ব্যাপারে সম্রাট (বহিষ্কৃত ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ নেতা) রিমান্ডে বলেছেন মেননকে তারা মাসে চার লাখ টাকা করে দিতেন। কোনো কোনো মাসে এর পাশাপাশি বাড়তি টাকার জন্যও চাপ দিতেন তিনি। …অভিযান শুরুর পর অবশ্য সাংবাদিকরা মেননের কাছে জানতে চাইলে তিনি সেদিন বলেছিলেন ওই ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি তিনি জানতেন না'।
তবে ক্যাসিনোকাণ্ডের আগে ভালো কাজ করতে গিয়েও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন রাশেদ খান মেনন। রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু হজ্জে গিয়েছিলেন। এহরাম বাঁধা অবস্থায় এই দুজনের ছবি ভাইরাল হয়েছিল। দুই একজন লিখেছিল ফেসবুকে- কার্ল মার্কস ও ভ্লাদিমির লেনিনের আত্মা কী এতে কষ্ট পায়নি? একজন লিখেছিল– হুজুররা একশত বছর ডাকাডাকি করলেও এই দুই বামপন্থী নেতাকে মনে হয় হজ্বে পাঠাতে পারতেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের মন্ত্রীত্ব দিয়েই হজ্বে পাঠাতে সমর্থ হয়েছেন!
তবে মেনন সাহেব ভোটের সাক্ষী হিসেবে যা বলেছেন তা নিয়ে রুষ্ট হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং খুশি হয়েছেন গণফোরামের নেতা ড.কামাল হোসেন। রাশেদ খান মেনন দীর্ঘদিন পরে বুঝতে পেরেছেন বলেই খুশি হয়েছেন ড.কামাল। অবশ্য মহাখুশি হয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। রিজভীর মতে- রাশেদ খান মেনন মহাসত্য কথা বলেছেন। আর ওবায়দুল কাদের সাহেব মেননকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- উনি এতোদিন পরে এ কথা বলছেন কেন? ওনাকে আবার মন্ত্রী বানানো হলে কী এমন কথা বলতেন? ওবায়দুল কাদের সাহেব এক মহাপ্রশ্ন রেখেছেন জাতির সামনে। তবে ১৪ দলের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা মো. নাসিম বলেছেন- মেনন সাহেব জনগণের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছেন!
সমাজতন্ত্র মানে কী? অনেকে ব্যঙ্গ করে বলে থাকেন- পুঁজিবাদে পৌছানোর দীর্ঘতম পথ। মেনন সাহেব অবশ্য দীর্ঘতম পথ পাড়ি দিয়েই পুঁজিবাদের সাথে মৈত্রী করেছেন। ১৯৯১ সালে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিএনপির সাথে, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে মৈত্রী না করলে ওনার পক্ষে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সম্ভব ছিল না! আবার ২০১৮ এর নির্বাচনে সংসদ সদস্য হবার পরেও দীর্ঘ সময় নিয়েছেন 'ভোটের দুর্বল সাক্ষী' হতে। সবল সাক্ষী হলে অবশ্য উনি অনেক আগেই সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতেন! ভিকারুননিসা নুন স্কুলের ভর্তি বাণিজ্য হারানো, ক্যাসিনোকাণ্ডের সমালোচনা কিংবা নিজের স্ত্রীকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য বানাতে না পারার বেদনা কী তাকে সামান্য সময়ের জন্য আবারও বিপ্লবী করে তুলেছিল?
যে কারণেই হোক মেনন সাহেব অবশ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন- তার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। সম্ভবত উনি বলতে চেয়েছেন- যা ছাপা হয়েছে তা উনি বলেননি বা বলতে চাননি। ওনার ব্যাখ্যা শোনার পরে মনে হচ্ছে ভোটের সাক্ষী হিসেবে উনি আসলেই দুর্বল! আমরা ওনার বক্তব্যের সমালোচনা না করে প্রচলিত দুটো গল্প বলে বিদায় নিচ্ছি।
এক. ক্যাসিনো থেকে এক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাঠগড়ায় বিচারক তাকে বললেন,
– যা বলিবে সত্য বলিবে বলে শপথ করেছ। আশা করি সত্য কথা বলবে।
– অবশ্যই মাননীয় আদালত। সাক্ষী কেনার টাকা আমার আর নেই। আর একজন মাতাল কখনো মিথ্যা বলে না!
– ক্যাসিনোতে গিয়ে তুমি প্রথমে এক লোকের ছবি টানাও। তারপর মদ খাওয়া আর জুয়া খেলা শুরু করো কেন?
– মাননীয় আদালত উনি একজন রাজনীতিবিদ এবং একই সাথে 'মাতাল হওয়া না হওয়ার পরিমাপক'। ওনার ছবি দেখে মদ খেতে খেতে যখন ওনাকে ভালো মনে হওয়া শুরু হয় তখনই আমি বুঝে নেই আমি মাতাল হওয়া শুরু করেছি। এখন আপনিই বলেন মাতাল অবস্থায় কী ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা উচিত? মাতাল হয়ে গেলে আমি ওনার ছবিটা খুলে নিয়ে আর জুয়া না খেলে ফিরে আসি!
দুই. নির্বাচনের পর এক এলাকায় মামলা হয়েছে। সেই মামলায় এক লোক সাক্ষী দিতে এসেছে। বিচারক তার কাছে জানতে চাইলেন-
– আপনি নিজেও তো নির্বাচন করে হেরেছেন। আপনি অভিযোগ করেছেন যে ভোট চুরি-কারচুপি ব্যাপকহারে হয়েছে। আপনি নিজে কেন মামলা করেননি?
– কথায় আছে না কারো ক্ষতি করতে হলে তার বিরুদ্ধে মামলা দেন কিংবা নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেন? জিতলে নির্বাচন সুষ্ঠ আর হারলে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এটাতো কমন অভিযোগ। আমি নির্বাচন করেছিলাম অন্য কারণে। মাননীয় আদালত অভয় দেন তো বলি।
– বলেন। নির্দ্ধিধায় বলেন।
– মাননীয় আদালত আমি নিজেও রাজনীতিবিদ। আমি জানি আমি কতোটা খারাপ। যিনি আমার সাথে নির্বাচন করে জিতেছেন তিনি কমপক্ষে আমার চেয়ে তিনগুণ খারাপ। আমার নিজের আর যিনি জিতেছেন এই দুইজনের ভোট হিসেব করে বুঝলাম যে আমার এলাকায় যারা ভোট দিয়েছেন তাদের অধিকাংশই সরল সোজা এবং বোকা! রাজনীতিবিদরা টিকে থাকেন এমন মানুষদের জন্যই!