Published : 14 Sep 2019, 04:27 PM
সঠিক তথ্য নির্ভর ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ জাতিগোষ্ঠীই পারে তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ ও দেশের মানুষকে আধুনিক বিশ্বের মর্যাদাশীল জাতির অংশীদার করতে। অঙ্কুর থেকেই প্রতিটি শিশুকে দেশ ও দেশের মুক্তির সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জানাতে পারলে, দায়িত্ববান করে গড়ে তোলা সম্ভব হলে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা যেমন সহজ, তেমনি বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি একদিন তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আর এই জায়গায় আমাদের পরিকল্পনা কী? কতটুকু কাজ করেছি বা করবো-এটি আলোচনার বিষয়। কারণ, ১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর দুই সামরিক শাসক পরিকল্পনা করে গভীর থেকে এ জাতিকে ঘুনে খাওয়া নড়বড়ে করে গড়ে তুলতে প্রথমেই তারা সংবিধানে হাত দিয়ে আমাদের 'মৌলিক' ও 'চেতনার' জায়গাটি ক্ষত-বিক্ষত করেছে। পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রথমেই রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করতে ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে আটককৃত ১১ হাজার ৭৫২ জন মানবতাবিরোধী অপরাধী ও সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারদের মুক্ত করতে মেজর জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশের ৬৩টি ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করা হয়। ফলে ওই সকল ব্যক্তির পক্ষে আপিল করে জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করেই মেজর জিয়াউর রহমান বসে থাকেনি, চিহ্নিত রাজাকারদের আড়াল করতে ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে করা মামলার নথিপত্র এবং রাজাকার ও দালালদের শনাক্তকরণের সকল দলিল ধ্বংস করেছে। তথাকথিত বহুদলীয় গণতেন্ত্রর নামে ৭২'র সংবিধানে নিষিদ্ধ স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের সংগঠন জামায়াত ইসলামকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের তকমা লাগিয়ে যা যা করার প্রয়োজন ছিল, মেজর জিয়াউর রহমান তার সব কিছুই করেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুরস্কৃত করেছে।
পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেজর জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীরমাধ্যমে "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম" যুক্ত করে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্ল্যাকমেইল করেরাজনীতিকে ধর্মের আদলে পরিচালিত করা শুরু করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবেগকেপুঁজি করে পাকিস্তানী ভাবধারায় রাষ্ট্রপরিচালনা করতে থাকে।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আরেক জেনারেল এরশাদও মেজর জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে। পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এরশাদও পাকিস্তানকে খুশী করাতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশের মাটি থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর ক্ষমতার অংশীদার করে। জিয়ার মত জেনারেল এরশাদও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার অনুভূতিকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম অন্তর্ভূক্তি করার মাধ্যমে মুসলিম জনসংখ্যার সমর্থন পাওয়ার এক নীল নকশা তৈরি করে।
এমনি করে পরবর্তীতে খালেদা জিয়া একই নীতি শুধু অনুসরণই করেনি, বরং আরও একটু আগ বাড়িয়ে পাকিস্তানকে খুশী করাই যেন খালেদা জিয়া সরকারের মূলনীতি হয়ে পড়ে। আর রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভঙ্গ করে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুতে খালেদা জিয়ার শোকবার্তা (!) কূটনীতিক ও রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে খালেদার পাকিস্তান-জানজুয়া প্রীতির এক উদাহরণ যা বাঙালি জাতিকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করে আসছে।
মেজর জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলের ২৬ বছরের জেনারেশনকে মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের সংগ্রামের গৌরব গল্পকথা, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস না জানানোর জন্য সর্বপ্রথম পরিকল্পিতভাবে পাঠ্যপুস্তকে তাদের নোংরা হস্তক্ষেপ শুরু করে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ইতিহাসকে তার সঠিক জায়গায় না রেখে নিজেদের মতন করে ওই জেনারেশনের সামনে তুলে ধরে। তারা জানত, সঠিক ইতিহাস জেনে গেলে বাঙালি জাতি মেজর জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়াকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের সংগঠন জামায়াত ইসলামকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করে জঙ্গিরাষ্ট্র পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবে। তাই সুকৌশলে নিজেদের ক্ষমতা আর পাকিস্তানের ভাবধারা বজায় রাখতে ইসলামকে পুঁজি করে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' থেকে 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' পর্যন্ত অন্তর্ভূক্ত করে। নব্বই ভাগ মুসলমানের আবেগকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের মত জঙ্গি-তালেবান রাষ্ট্র করার জন্য ভিতর থেকে ঘুনে খাওয়া জাতি গঠন করতে সকল ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত করেছিল তারা।
তার প্রতিফলও আমরা দেখেছি। কোটা সংস্কার আন্দোলনে 'আমি রাজাকার' লিখে রাজাকারেরবংশধর এবং কতিপয় বিভ্রান্ত হওয়া তরুণ-তরুণীর আন্দোলন আজ গবেষণার দাবি রাখে। আর সর্বশেষপদ্মাসেতুতে ছেলেদের মাথা লাগবে বলে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে হত্যারবিষয়গুলোও আলোচনার বিষয়বস্তুতে রূপ নিয়েছে।
পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানিররাহিম' আর 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' এতোটাই প্রভাব রেখেছে, বলা যেতে পারে জাতির কয়েকটা জেনারেশনকেঘুনে খাওয়া জাতির অংশ করে আজও বিভ্রান্ত করে রেখেছে। তার উদাহরণ, একাদশ জাতীয় সংসদনির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছে। আমরা স্যোশাল মিডিয়াতে 'নৌকায় ভরসা রাখুন' ক্যাম্পেইনশুরু করলে তখন একটি মহল 'আল্লাহ'র উপর ভরসা রাখুন' বলে পাল্টা ক্যাম্পেইন শুরু করে।ব্যক্তি ধরে ধরে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, এরা শুধু বিএনপি কিংবা জামায়াত-শিবিরের লোকবলনয়, আওয়ামী লীগ থেকে ছাত্রলীগের উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দরাও 'আল্লাহ'র উপর ভরসা রাখুন'ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান দাঁড় করিয়েছে। আর ছাত্রলীগ করাকতিপয় তরুণ-তরুণীও আমাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা করেছে।
মেজর জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়া-রাজাকার গোলাম আযমদের শাসনামলে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের যে ক্ষতিসাধন করেছে, খুব সহসাই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। আর এই ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তকর মনোজগৎ থেকে বেরিয়ে আসার সে রকম মহাপরিকল্পনাও যে আছে-এটিও আমার কাছে দৃশ্যমান নয়।
এখানে পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন কিংবা এই কথাগুলো উঠলে সব জায়গায় একটি আলোচনা-সমালোচনা দেখা যায়, জেনারেল এরশাদ এতো ক্ষতি সাধন করার পরেও, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশ থেকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পৃষ্ঠপোষক করার পরেও শেখ হাসিনা কেন তার সাথে রাজনৈতিক জোট-ভোট করেছিলেন?
ধরুন, আপনি দশম তলায়। কোনও কারণে আপনার বিল্ডিং এর লিফট চলাচল করে না। তখন আপনি বাধ্য হয়েই পেশিশক্তি ব্যবহার করে পায়ে হেঁটে উঠানামা করবেন। এটাই বাস্তবতা। শেখ হাসিনা বাস্তবতা অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে লেখাপড়া করা রাজাকার গোলাম আযমকে ইসলামী পণ্ডিত মনে করে আজও কতিপয় মানুষ। বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে জেনারেল এরশাদের শুক্রবারের ছুটি ঘোষণাকে এদেশের একটা শ্রেণি যখন সাধুবাদ জানায় তখন শেখ হাসিনা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারে না। আবার আদালত মেজর জিয়া ও জেনারেল এরশাদকে অবৈধ রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করার পরেও এদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী, মিডিয়াসহ স্বয়ং জাতীয় সংসদের কতিপয় সংসদ সদস্য অবৈধ রাষ্ট্রপতির নামের আগে অবৈধ শব্দটা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। অবৈধ সামরিক শাসকদের বৈধতা দিতে কবিতা থেকে গদ্য-পদ্য কোনোটাই লেখা বাদ রাখেনি।
আর আমাদের অজ্ঞতা, ব্যক্তিস্বার্থ, লোভ-লালসার সুযোগে, আমাদের সরলতার মনোভাবকে পুঁজি করে মেজর জিয়া ও জেনারেল এরশাদের পরে খালেদা জিয়াও বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করতে মিথ্যাচার, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ও বিকৃত ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরে এই জাতিগোষ্ঠীর কয়েকটা জেনারেশনকে বিভ্রান্ত করে গড়ে তুলেছে।
আমাদের এই জায়গায় মনোযোগী হতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সঠিক তথ্য নির্ভর জাতি গঠনে কাজ করতে হবে। একটা স্লোগান দেখা যায়, উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। ভালো কথা। সব সরকারই গতানুগতিক উন্নয়ন করেছে, করবে। আর মেজর জিয়া ও জেনারেল এরশাদও উন্নয়নের স্লোগান দৃশ্যমান করে অদৃশ্যভাবে বাঙালি জাতির ক্ষতি সাধন করেছে। বাংলাদেশকে ভিতর থেকে নড়বড়ে করে গড়ে তুলতে কাজ করেছে।
আজ পদ্মা সেতু বিশ্বের বুকে এক চ্যালেঞ্জ। খুব শীঘ্রই পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের মানুষ চলাচল করবে। কিন্তু পদ্মা সেতু যে পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে পিলারকে শক্ত-মজবুত করতে না পারলে পদ্মা সেতুও একদিন হুমকির মুখে পড়বে। আর এই পিলার হচ্ছে বাঙালি। বাঙালি জাতিকে ভিতর থেকে মজবুত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমি অঙ্কুর থেকে জানাতে হবে। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নয়, সরাসরি তুলে ধরতে হবে ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার নেপথ্যকারীদের নাম ও পরিচয়। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলাকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নাম সরাসরি উল্লেখ করতে হবে। বুদ্ধিজীবীসহ দেশের সকল দায়িত্ববান ব্যক্তিদের উচিত হবে, সকল অঘটন-ঘটনাগুলোর বিষয়বস্তু স্পষ্ট ভাষায় জাতির সামনে তুলে ধরা।
চার দেয়ালের একটি ঘর যেমন মজবুত হয় তার খুঁটি বা পিলারের কারণে, ঠিক তেমনিভাবে একটি দেশের জনগণের মাঝেও দেশপ্রেম বিরাজ করে তার দেশের সঠিক ইতিহাস জানার মাধ্যমে। আর এই জায়গায় আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করতে হবে। অঙ্কুর থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি দেশবিরোধী রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রতিটি কর্মকাণ্ড জানাতে হবে। তাহলেই প্রতিটি নাগরিকের ভিতর দায়িত্ববোধ কাজ করবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালিকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে আন্তরিক হয়ে কাজ করবে। আর তাই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক উন্নয়ন ও তথ্য নির্ভর জাতি গঠনে আমাদের সবাইকে মনোযোগী হতে হবে।