Published : 19 May 2019, 06:35 PM
"গনি মিয়া একজন গরিব কৃষক। তার নিজের কোনো জমি নাই। অন্যের জমি বর্গা চাষ করেই কষ্টে-সৃষ্টে গনি মিয়ার দিন কাটত।" ছোটবেলায় পড়া গল্পের অতি পরিচিত চরিত্র গনি মিয়াদের যে ছবি আমাদের মানসপটে আঁকা হয়ে গিয়েছিল আজ এত বছর পরেও তার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমরা ধরেই নিয়েছি গনি মিয়াদের জন্মই হয়েছে গরিব থাকার জন্য। জন্মই যার আজন্ম পাপ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে যারা আমাদের অন্ন জোগানোর এক পবিত্র ও মহান দায়িত্ব পালন করে নিঃস্বার্থভাবে, তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর ভাবনাটা কেবল ভাবনাই থেকে যায়।
১৯৭১ সালের এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাঙালি যখন প্রিয় লাল সবুজ পতাকা নিজের করে নেয় তখন বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার "তলাবিহীন ঝুড়ি" বলে উপহাস করেছিলেন এই নবীন রাষ্ট্রটিকে। ১৯৭৬ সালে দুই স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং পার্কিনসন 'বাংলাদেশ: এ টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট' নামক এক গবেষণাগ্রন্থে বলেন, যদি বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়, তাহলে বিশ্বের কোথাও উন্নয়ন কোনো সমস্যা হবে না। তারপর অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায়। তলাবিহীন ঝুড়ি ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। অনেক অর্জন বাংলাদেশের। সম্প্রতি স্বীকৃতি মিলেছে উন্নয়নশীল দেশের। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছি আমরা। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অগ্রযাত্রায় কৃষি তথা কৃষককুল রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যেকোনও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা বিধান। যে কাজটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করে চলেছে এ দেশের অজেয় কৃষক। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের উন্নয়নের নেপথ্যের এই নায়কদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে খুব সামান্যই।
১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন এ জনপদের লোকসংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৫ কোটি আর ধান উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন। বিগত ৪৮ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ দেশের চাষিরা ধান উৎপাদন বাড়িয়েছে তিন গুনেরও বেশি। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন চাল। শুনতে সহজ শোনালেও এ কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন, শিল্পায়ন ইত্যাদি নানা কারণে কৃষি জমির হ্রাস, সেচের পানির স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিভিন্ন অভিঘাত যেমন বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততার মতো বৈরী প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগুতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধান উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে শীর্ষে। ২০১৮ সালে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী দেশে সমূহে এই হার ছিল অনেক কম – চীনে দশমিক ৭৮ শতাংশ, ভারতের ২ শতাংশ। মার্কিন কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস অনুসারে ২০১৯-২০ সালেও এই প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে।
এতসব সাফল্যে আমরা যখন উৎফুল্ল তখন এর নেপথ্যের কারিগর কৃষকের হৃদয়ে হাহাকার! উৎপাদন খরচের অর্ধেক মূল্যেও যে বিকোচ্ছেনা তার সোনার ফসল। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এক কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ২৪ টাকা। বর্তমান বাজার দরে এই ধান বিক্রি হচ্ছে ১২-১৩ টাকা কেজি দরে! অথচ সরকার নির্ধারিত ধানের ক্রয় মূল্য কেজি প্রতি ২৬ টাকা। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে সরকার নির্ধারিত মূল্যে কেন বিক্রি হচ্ছে না ধান? উত্তর সকলেরই জানা! সরকার যে পরিমাণ ধান বা চাল ক্রয় করে তা উৎপাদনের তুলনায় একেবারেই নগন্য। এই বোরো মৌসুমে উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। অথচ সরকার ক্রয় করবে মাত্র দেড় লাখ টন ধান আর নয় লাখ টন চাল! স্বভাবিকভাবে সিংহভাগ ধান কৃষককে বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ীদের কাছে যেখানে মুনাফাই মুখ্য এবং দাম নির্ধারণ হয় চাহিদা ও জোগানের চুল-চেরা হিসেবের উপর! কিছু প্রশ্ন অবধারিতভাবে মনের মধ্যে জাগে – তবে কেন সরকার আরও অধিক পরিমাণে ধান চাল কেনেন না? সোজা সাপ্টা উত্তর: শস্য মজুদ করার স্থানের অভাব! সরকারের আনুমানিক ১৬ লাখ ২০ হাজার টন খাদ্য শস্য মজুদ করার মতো স্থান রয়েছে। এ সমস্যাগুলোর মধ্যেই আসলে নিহিত আছে সমাধান।
ধানের দাম গত ডিসেম্বর মাসেও এত কম ছিল না। হঠাৎ করে এ অবস্থার সৃষ্টি হলো কীভাবে? একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ২০১৬ সালে বোরো মৌসুমে ধানের দামের ব্যাপক পতন ঘটে। এরই প্রেক্ষিতে বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার প্রত্যয়ে সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়। চাল আমদানির উপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে বোরো মৌসুমে হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকারি হিসেবে এই ক্ষতির পরিমান প্রাক্কলিত হয় ১০ লাখ টন। সম্ভাব্য ঘাটতি মোকাবেলায় চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং পূর্বে আরোপিত ২৮ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় অবাধ চাল আমদানি। গত দেড় বছরে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন চাল আমদানি হয়! যদিও সরকার গত নভেম্বর মাসে ২৮% আমদানি শুল্ক পুনর্বহাল করে তারপরেও এখনো দেশে চাল আমদানির অপেক্ষায় আছে প্রায় ০৪ লক্ষ টন।
গত তিন মৌসুমে দেশে ধানের বাম্পার ফলন অব্যাহত থাকায় সরবারহ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। চাহিদার তুলনায় দেশে মজুদ বৃদ্ধি পায় অনেকাংশে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে আমন মৌসুমে বাম্পার ফলনের পর মজুদ ও বাজারে চালের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ চালকলে বর্তমানে তাদের ক্রয়কৃত পূর্বের মজুদ রয়ে গেছে। যে কারণে বেশিরভাগ চালকল ব্যবসায়ী এখন অব্দি ধান কেনা সংগ্রহ করেন নি। এক হিসেবে দেখা যায়, সাধারণত: বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার এই সময় কালে ১৬ হাজার চালকলের প্রায় সবগুলি চালু থাকে। কিন্তু বর্তমানে চালু রয়েছে মাত্র হাজার খানেক। আগামী দুই সপ্তাহে ধান কাটা পুরোপুরি সম্পন্ন হলে সরবরাহ পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। এর মধ্যে ধান ক্রয় কার্যক্রম যদি জোরদার না হয় ধানের মূল্য আরও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
কোটি টাকার প্রশ্ন: এই দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার উপায় তাহলে কি? এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিতে পারি। কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার তাদের প্রধান ফসল গম, ধানসহ মোট ২৫ টি ফসলের জন্য ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এই কাজটি করে কমিশন ফর এগ্রিকালচার কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেস (সিএসিপি)। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষকের উৎপাদন খরচ, ঝুঁকি ইত্যাদি সব কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে, এ বছরে গমের জন্য সরকার নির্ধারিত ক্রয় মূল্য প্রতি কুইন্টাল এক হাজার ৪৪০ রুপি। কৃষকের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে প্রতি কুইন্টাল ৮৬৬ রুপি। অর্থাৎ একজন কৃষক তার খরচের উপর ১১২ দশমিক ৫ শতাংশ মুলাফা অর্জন করতে পারবে। বাজারে যাতে নির্ধারিত মূল্যে ফসল বিক্রি হয় সে লক্ষ্যে সরকার মোট উৎপাদনের অন্তত এক তৃতীয়াংশ ক্রয় করে। ২০১৭-১৮ সালে ভারতে মোট গম উৎপাদন হয় ৯৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন টন, এ থেকে সরকার ক্রয় করে ৩৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন যা শতকরা হিসাবে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা ইতোমধ্যে সমাধানের কিছু ইঙ্গিত পেয়ে গেছি। ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে নিন্মোক্ত ব্যবস্থা সমূহ কার্যকরী ভূমিকা রাখবে:
– মৌসুমের শুরুতে নিম্নতম ক্রয় মূল্য ঘোষণা
– সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়
– মোট উৎপাদনের অন্তত: এক তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক ক্রয়
– সরকারের মজুদ ব্যবস্থা উন্নয়ন কল্পে অবিলম্বে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ
– স্বল্প মেয়াদে বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ের গুদাম ভাড়া করা
– নিয়মিত বাজারের সরবরাহ পরিস্থিতি মনিটর এবং তার ভিত্তিতে আমদানির উপর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ
– দেশের আপৎকালীন মজুদ নিশ্চিত করে চাহিদার অতিরিক্ত চাল রপ্তানির সম্ভাব্যতা যাচাই
কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অভাবনীয় সাফল্য তা টেকসই করতে কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোনও বিকল্প নাই। কৃষক বাচঁলেই তবে বাঁচবে দেশ।