চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি কর আহরণের লক্ষ্য ঠিক হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আদায়ের যে চিত্র সেটির চেয়ে যা ৩০ শতাংশ বেশি হবে; এমন প্রাক্কলন করে একজন অর্থনীবিদের শঙ্কা, তা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব না।
Published : 24 May 2024, 01:46 AM
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য ঠিক করতে যাচ্ছে তাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেশি টাকা জোগাড় করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআরকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি ধরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সাজানো হচ্ছে। এর সিংহভাগই ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করার লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হতে পারে দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী সংস্থা এনবিআরকে।
এমনটি হলে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা বেশি, তবে সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অবশ্য সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে আদায় এখন পর্যন্ত ৮ শতাংশ কম। যদি শেষ পর্যন্ত আদায় না বাড়ে, তাহলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় এক লাখ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় করতে হবে আগামী অর্থবছর।
চলতি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত ও অন্যান্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভোক্তাদের জেরবার এবং সংকোচনমূলক নীতির কারণে ব্যবসা-বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে ধীর গতির মধ্যে রাজস্ব আদায়ের বিশাল এ লক্ষ্যমাত্রা পরে সরকার কিছুটা কমিয়েছে। এনবিআরের জন্য সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বলে খবরে এসেছে।
এ হিসাবে অর্থবছরের ৯ মাসে যত টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা ছিল, আদায় হয়েছে তার ৯২ শতাংশের কিছু বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা থেকে আদায় ৮ শতাংশের মত কম হয়েছে। অবশ্য শেষ তিন মাসে আদায় কিছুটা বাড়ে প্রতিবছরই।
চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি।
বাজেট পেশের আগে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণত কেউ কথা বলেন না। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের একটি লক্ষ্য ধরে আমরা এগোচ্ছি। আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে যে বাজেট উত্থাপন করা হবে সেখানে হয়ত অঙ্ক কিছুটা কমবেশি হতে পারে।”
আট লাখ কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব আহরণের প্রধান দুই উৎসের মধ্যে কোন খাত থেকে কত আয়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেই তথ্যও জানালেন তিনি। বললেন, “এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা এবং কর বহির্ভূত অন্যান্য খাত থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব অর্জনের কথা বলা হয়েছে।”
এ হিসাবে সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে এনবিআরকে আদায় বাড়াতে হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশ বেশি।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার-২০২৪ এর অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়নের প্রথম বাজেট এবার। এ বাজেটে রাজস্ব আদায়ে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম এ বিষয়ক এক প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রত্যেক বছরই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে নতুন নতুন কিছু কৌশলও থাকে। এবার কী কৌশল নেওয়া হয়েছে তা দেখতে বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাজেটেই সেই কৌশল বলা থাকবে।”
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ শুনে বলেন, এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় কঠিন হয়ে যাবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “লক্ষ্য যদি ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ধরে থাকে তাহলে আমি বলব, এটা বাস্তবতা ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সঠিক নীতি কৌশল অবলম্বন করা হলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা গেলে এটা যে অর্জন সম্ভব না তাও বলা যাবে না। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি যে, রাজস্ব আহরণের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা কখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি।”
চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে দেওয়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা শেষ পর্যন্ত অর্জিত হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন এক সময় আইএমএফে কাজ করে আসা এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, “বছর শেষে সেটা হয়ত ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি যাবে। তাহলে এক বছরের মধ্যে রাজস্ব আয় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বাড়ানো কীভাবে সম্ভব?”
চলতি অর্থবছরের চিত্র এবং আগের বছরগুলোর তুলনা হিসাব করলে বলতে হয়, আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এনবিআরকে তাদের অতীতের সাফল্যকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।
প্রতি বছরই সংস্থাটি আগের বছরের চেয়ে উচ্চ হারে রাজস্ব আদায় করলেও তুলনামূলক বিচারে প্রবৃদ্ধির হার কমছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা নেমে আসে ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আগামীকে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে; এই জায়গাটাই উচ্চাভিলাসী, এত প্রবৃদ্ধি কোনোদিনও সম্ভব না।”
আওয়ামী লীগের পরিকল্পনাই ‘উচ্চাভিলাষী’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে বাজেটের আকার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। বিরোধী দল ও অর্থনীতিবিদরা এসব পরিকল্পনাকে প্রতিবার বলেছেন ‘উচ্চাভিলাষী’।
জবাবে ১০টি বাজেট দেওয়া প্রয়াত অর্থনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, সরকার দেশের উন্নয়নে উচ্চালিভাষীই।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট পেশের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেছিলেন, “ইয়েস, আমি নিজেই বলেছি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী।”
ওই অর্থবছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ৭১ শতাংশের বেশি অর্থ রাজস্ব খাত থেকে আদায়ের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন মুহিত। ওই বছর তিনি ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব প্রস্তাব করেছিলেন।
কোনো বছরেই বাংলাদেশে বাজেটের ঘোষণা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা যায়নি। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৪ বছরের মেয়াদে তা ব্যাপক হারে বেড়েছে।
২০০৯-২০১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পর অর্থমন্ত্রী মুহিত এক লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন। সেখানে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে ৬১ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর ছাড়া কর রাজস্বের পরিকল্পনা ছিল দুই হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা ছিল ১৫ হাজার ৫০৬ কোটি।
এক দশক পর ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে মুহিত শেষ যে বাজেট দিয়ে যান সেটির আকার ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। মোট আহরণের লক্ষ্য স্থির হয় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, এনবিআর বহির্ভূত কর ছিল ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং কর বহির্ভূত অর্জন ছিল ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
মুহিতের উত্তরসূরী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন। সেখানে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এনবিআরেরে কর ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, এনবিআর বহির্ভূত কর ছিল ১৪ হাজার ৫০০ কোটি এবং কর বহির্ভূত অর্জন ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা ছিল।
চলতি অর্থবছরের জন্য কামালের শেষ বাজেটের আকার ঘোষণা করা হয় ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৫ লাখ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রার শেষ পর্যন্ত কত আদায় হয়, তা জানতে জানতে অন্তত সেপ্টেম্বর মাস লেগে যাবে।
এনবিআরের সাফল্য কেমন?
কোভিড মহামারীর আগে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ১৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কোভিডের কারণে তা কিছুটা কমে গিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকায় নামে।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, পরের অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থ বছর এনবিআর আদায় করেছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। এই বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
পরের অর্থবছরে এনবিআরের আহরণ বেড়ে হয় ২ লাখ ৯২ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। তবে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে হয় ১১ শতাংশ।
গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। প্রবৃদ্ধি আরও কমে হয় ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
কর ছাড়া অন্য রাজস্ব কী
বাজেটে এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে যে রাজস্ব আদায়ের কথা বলা হয়, তা আসে মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রয় ও সারচার্জ খাত থেকে।
লভ্যাংশ-মুনাফা, সুদ, প্রশাসনিক ফি, জরিমানা, দণ্ড, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, সেবা বাবদপ্রাপ্তি, ভাড়া-ইজারা, টোল, অবাণিজ্যিক বিক্রয়, কর ব্যতীত অন্যান্য রাজস্ব ও মূলধন রাজস্ব খাত থেকে অর্জিত সম্পদকে ধরা কর ব্যতীত প্রাপ্তি হিসাবে।
চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআর বহির্ভূত কর খাত থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা, আগামী অর্থবছরে এখানে ৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে কর বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার কোটি টাকা থাকলেও আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে তা ৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে, বলছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সেই কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন:
অগ্রিম করের আওতায় আসছেন হাইব্রিড গাড়ির মালিকরাও