আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে নতুন সংকটে পড়েছে ভারত। এতে ঘনিষ্ঠ মিত্র বাংলাদেশের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে এবং এর ফলে এ অঞ্চলে ভারত কার্যত ‘একা’ হয়ে পড়তে যাচ্ছে ।
Published : 14 Aug 2024, 10:58 AM
আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাগে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলের চিরবৈরী দুটি দেশ ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব ও বাংলাদেশের অনাগ্রহের কারণে সার্ক বহুবছর ধরে নিষ্ক্রিয়। পাকিস্তান ব্যতীত এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বৈরিতা ছিল না। কিন্তু, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কারণে সব দেশের সঙ্গেই এখন ভারতের কূটনীতিক সম্পর্ক নাজুক। ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির এই আপ্তবাক্যে আস্থা হারাচ্ছে দেশটির প্রতিবেশীরা। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ক্রমশ ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে নতুন সংকটে পড়েছে ভারত। এতে ঘনিষ্ঠ মিত্র বাংলাদেশের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে এবং এর ফলে এ অঞ্চলে ভারত কার্যত ‘একা’ হয়ে পড়তে যাচ্ছে ।
দুই বৃহৎ শক্তি চীন ও ভারতের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত নেপাল ও ভুটান ‘ভারতঘেষা’ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে গত এক দশক ধরে ক্রমশ চীনের দিকে ঝুঁকেছে। রাজতন্ত্রের বিলোপ ও গণতান্ত্রিক সরকারে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের উত্থানে ভারত-নেপালের বহু বছরের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ২০১৫ সালের শেষ দিকে ভারত সরকারের অবরোধে নেপালের জনগণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে (নেপালের সংবিধান প্রণয়ন) কেন্দ্র করে ভারতের অমানবিক অবরোধে সমগ্র নেপালজুড়ে ভারতবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। অনেকটা বাধ্য হয়ে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে নেপাল এবং ভারতকে মোকাবেলায় চীন এটাকে সুযোগ হিসাবে নিয়েছে। নেপালের সঙ্গে এ দূরত্ব এখনও ভারত কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে ভুটানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি রয়েছে। তন্মধ্যে ১৯৪৯ সালের বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি অন্যতম, যা ২০০৭ সালে সংশোধিত হয়েছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও আনুষ্ঠানিক কূটনীতিক সম্পর্ক বেশি দিনের নয়। কিন্তু, ভারতের আগ্রাসী মনোভাবে ভুটানও চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক খুবই খারাপ। ভারতের সেনাসদস্যদের দেশ থেকে বিতাড়ন করবেন— এ ম্যান্ডেট নিয়ে এ বছরের শুরুতে ক্ষমতায় আসেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মইজ্জু। তিনি ক্ষমতায় এসেই তা বাস্তবায়ন করেছেন। উপরন্তু, চীনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছেন, ফলে মালদ্বীপ সংলগ্ন ভারত মহাসাগরে চীনা জাহাজের উপস্থিতি বেড়েছে। ভারতের উদ্বেগের কারণ হলো, এলাকাটি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারত। গত সপ্তাহেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মালদ্বীপ সফর করেছেন।
শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ মানুষ মনে করে, দেশটিতে তিন দশকের প্রাণঘাতী গৃহযুদ্ধে ভারতের ইন্ধন ছিল। দু-দেশের সম্পর্কে এ অবিশ্বাসের কারণে চীনকে সমুদ্র উপকূল ব্যবহারের সুযোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন সামরিক চুক্তি করেছে শ্রীলঙ্কা। এতে, শ্রীলঙ্কায় চীনের উপস্থিতি বেড়েছে, যা ভারতকে শঙ্কায় ফেলেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সহায়তার মাধ্যমে এ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারত।
পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধিতা কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক করার লক্ষ্যে সেখানে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল ভারত। কিন্তু সশস্ত্র অভ্যুথানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসলে চীনের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। চীন তাদের যোগাযোগ পরিধি বাড়ানোর জন্য বড় ধরনের উন্নয়ন কাজ করছে, ফলে এ অঞ্চলে নাজকু অর্থনীতির আফগানিস্তান চীনমুখী হয়ে উঠেছে, যা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।
এ অঞ্চলের একমাত্র পাকিস্তানের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে খারাপ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর একাধিকবার দু-দেশের যুদ্ধ হয়েছে। চীন এসব যুদ্ধে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছে। পাকিস্তান ও ভারতের বিরোধিতার কারণে সার্ক সক্রিয় করা যায়নি। বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয়তাও এতে প্রভাব রেখেছে। সার্কের বাইরে হলেও এ অঞ্চলের আরেকটি দেশ মিয়ানমারের সম্পর্কও চীনের সঙ্গে গভীর।
ফলে এ অঞ্চলে একমাত্র বাংলাদেশই ছিল ভারতের সর্বশেষ অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র। কিন্তু, এ সম্পর্কও খারাপ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে ভারত সরকার। একপাক্ষিক এ সম্পর্কে ভারত শুধু সুবিধাই নিয়েছে বলে অধিকাংশ মানুষ মনে করে। সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ৭টি রাজ্যের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য নামমাত্র শুল্কে ট্রানজিট সুবিধা, বহুল আলোচিত হিন্ডেনবার্গ কেলেঙ্কারির হোতা দুর্নীতিগ্রস্ত আদানি গ্রুপসহ বাংলাদেশে ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ব্যবসার সম্প্রসারণ, পরিবেশবাদীদের তুমুল বিরোধিতা সত্ত্বেও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ অসংখ্য অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে ভারত। বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রায় কিছুই পায়নি, বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না, সীমান্তে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। অথচ চোরাই পণ্য বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এজন্য নতুন সরকারের দায়িত্ব, গত ১৫ বছরে ভারত কী কী সুবিধা নিয়েছে তার বিনিময়ে কতটুকু সুবিধা দিয়েছে তা জনসম্মুখে উন্মুক্ত করা।
বাংলাদেশের তিন দিকে পরিবেষ্টিত প্রতিবেশী ভারত আয়তনে পৃথিবীর ৭ম বৃহৎ রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের প্রায় ২৩ গুণ বড়। জনসংখ্যায় পৃথিবীর শীর্ষ দেশ। পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটার্সের ১২ অগাস্ট ২০২৪-এর তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর ৮১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১৭.৭৮ ভাগ বা ১৪৫ কোটি ভারতীয়। যা ১৭.৩ কোটি বাংলাদেশির থেকে প্রায় ৮ গুণের বেশি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার দৈর্ঘ্য ৪,১৫৬.৫৬ কিলোমিটার (প্রায় ২৬০০ মাইল)।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনমত তৈরি এবং প্রায় ১ কোটি মানুষকে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় প্রদানের জন্য ভারতের সরকার ও জনগণের (বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্য) প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারতের সহযোগিতার অভাবে এ সম্পর্ক সমান্তরাল থাকেনি।
মুজিব-ইন্দিরার কল্যাণে দু-দেশের সম্পর্ক সুগভীর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সম্পর্কের গভীরতা কমলেও জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার অতীতে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রেখেছে। তবে, খালেদা জিয়া সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। ভারতের দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়ে সরকারের নীরবতার কারণে এ সম্পর্ক শীতল হয়। তবে, ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক আবার দৃঢ় হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা একপাক্ষিক হয়ে যায়। ফলে, গত ১৫ বছরে দু-দেশের কূটনীতিতে ভারত উপকৃত হয়েছে। মূলত, আগ্রাসী কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারত সরকারের ওপর বিরক্ত।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মধ্যে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা অন্যতম। বাংলাদেশের সব বড় নদী ভারত হয়ে এসেছে। বছরের পর বছর, ভারত অন্যায়ভাবে শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখায় উত্তরাঞ্চলে খরা এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছাড়ায় বন্যা হচ্ছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব কিংবা বর্ষাকালে বন্যায় ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
ভারত থেকে বৈধ উপায়ে চাল-ডাল, পেয়াজ-রসুন, চিনি থেকে শুরু করে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নানা পণ্যও আসে। অবৈধ পন্থায় ফেন্সিডিলসহ নানারকম মাদক ও নিত্যপণ্য আসে। বর্ডার এলাকায় নিরাপরাধ ফেলানী ভারতের সীমান্ত রক্ষীদের দৃষ্টি না এড়ালেও চোরাচালান বন্ধ হয়নি। সীমান্তে বাংলাদেশীদের গুলি করে মারাটা প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
ট্রানজিট খুবই আলোচ্য বিষয়। ভারতের ৭টি অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট পেয়েছে। এ ট্রানজিট চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। ভারতকে প্রদত্ত ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ কী সুবিধা পাবে— এটাও দেখতে হবে। সড়ক পথে কোনো ট্রানজিট রাখা ঠিক হবে কিনা ভেবে দেখতে হবে। নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ ও প্রতিবছর মেরামত করার ঝক্কিঝামেলার কথা ভাবতে হবে। ভারী যান্ত্রিক যান চলাচলে রোড ক্র্যাশের ঝুঁকি বাড়বে। এগুলোর না হয় আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা যাবে। কিন্তু অত্যধিক যান্ত্রিক যান যে পরিবেশ দূষণ ঘটাবে, সেই পরিবেশগত বিপর্যয়ের আর্থিক মূল্য কীভাবে নিরূপণ হবে? তাছাড়া ভারতের সুবিধার জন্য দেশকে কেন পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাব আমরা? ট্রানজিটের সুবিধা নিয়ে কী পণ্য, কত পরিমাণ বহন করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে হবে।
বাংলাদেশের চ্যানেলেগুলো ভারতে দেখানো হয় না অথচ ভারতের সব চ্যানেল আমরা দেখতে পাই। এটা একটা আগ্রাসন। এ আগ্রাসনে আমাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
‘ছিটমহল’ ছিল ভারত ও বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। আওয়ামী লীগের সময়ে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। তার মানে এমন না, যে এতে ভারত ছাড় দিয়েছে। বরং দু-পক্ষের জন্যই একটি সমস্যা সমাধান করতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে ভারতের পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলোর নাড়ির সম্পর্ক। এ সম্পর্ক আশাজাগানিয়া হতে পারে তখনই, যখন দু-দেশের কূটনীতিক সম্পর্ক সুস্থির হবে, ভালো হবে। এজন্য আগ্রাসন ও চাপ প্রয়োগের কূটনীতি থেকে সরে আসতে হবে ভারতকে। ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে দু-দেশের জনগণই উপকৃত হবে। আশা করি, দু-দেশের সরকার এ বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় হবে।