প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, ক্রমান্বয়ে সব অঙ্গরাজ্যে শুরু হলো যুদ্ধবিরোধী আহ্বান এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত গঠনের আন্দোলন। ইহুদি ছাত্রদেরও অনেকেই সামিল হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত গঠনে।
Published : 12 Nov 2024, 05:07 PM
ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার রক্ষার সংগ্রামকে গত গত ষাট বছর ধরে নির্মমভাবে দমন করে রেখেছে ইসরায়েল। এই বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরায়েলকে সর্বতোভাবে সমর্থন দিচ্ছে— এটা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। এর প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রের জনমত একচেটিয়াভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে ইসরায়েলকে।
গাজা যুদ্ধের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগণের কোনো ধারণাই ছিল না, কী নিয়ে এত বছর ধরে অশান্তি ও যুদ্ধ চলছে। এদের বেশিরভাগের ধারণা ছিল, ইহুদিরা ভালো লোক, শান্তিতে ইসরায়েলে বসবাস করছে এবং আশপাশের কিছু ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী ইসরায়েলিদের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ইসরায়েলিরা কার জায়গা দখল করছে, কোথায় দখল করছে এবং কেন দখল করছে এগুলো ইতিহাস বা ভূগোল খুলে যাচাই-বাছাই করার সময় আমেরিকানদের নেই। তারা তথ্য পেয়ে থাকে টিভির খবর থেকে, আমেরিকার বড় বড় খবরের কাগজগুলো থেকে এবং রাজনৈতিক টকশো থেকে। এইসব গণমাধ্যমের মালিক থেকে সাংবাদিক ও প্রচারক প্রায় সবাই ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক।
ইহুদিরা এমনিতে খুবই ধনাঢ্য ও বিজ্ঞ এবং বেশ ধুরন্ধর বলেও দুর্নাম রয়েছে তাদের। সেই শেক্সপিয়রের কাল থেকে— তার ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকে ভেনিসীয় ইহুদি মহাজন শাইলককে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তা থেকে এমন ধারণা বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক জগতের অনেক রাজনৈতিক দর্শনই এসেছে তাদের মাথা থেকে, যেমন— গণতন্ত্র, মার্কসিজম, সমাজতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মশাসন ইত্যাদি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদেরকে ধরা হয় উদারনৈতিক আদর্শের অনুসারী হিসেবে। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা খুবই গোড়া এবং উগ্রপন্থী, তা হলো, ইসরায়েল। ইহুদিরা যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সাদা পুলিশেরা যে দারুণ অসহিষ্ণু ব্যবহার করছে কিংবা অবৈধ অধিবাসীদের প্রতি যে রিপাবলিকান দল খুব নির্মম, তার খুব সমালোচনা করবে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলি অত্যাচার নিয়ে তাদের বেশির ভাগ লোকেরই কোনো মাথাব্যথা নেই।
আইবিএম-এ আমার এক ইহুদি সহকর্মী ছিলেন, তার নাম জেফ। তুখোড় কম্পিউটার বিজ্ঞানী। কত জটিল প্রজেক্টের সমাধান যে তিনি তার ছোট্ট মাথাটায় বয়ে বেড়াতেন তার হিসাব নেই। প্রজেক্টের যেকোনো বিষয়ে তিনি অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করতেন। জেফ ও আমি দুপুরে খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম। আমরা দুজনেই রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করতাম এবং দুজনেই উদারনৈতিক রাজনীতির সমর্থক। জেফ দারুণভাবে রিপাবলিকানদের নীতির সমালোচনা করতেন। বোধগম্য কারণেই আমরা সাধারণত ফিলিস্তিন বা ইসরায়েল নিয়ে কোনো আলোচনা করতাম না। একদিন আমি সাহস নিয়ে জেফকে জিজ্ঞাস করলাম, ‘আচ্ছা জেফ, ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনিদের জায়গা জোর করে এভাবে দখল করছে এবং ওদের ওপর এত অত্যাচার করছে, এগুলো কি তুমি সমর্থন করো?’
জেফ একটু হকচকিয়ে গেলেন, কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর হেসে ফেললেন এবং বললেন, ‘সালেহ, এই একটা ব্যাপারে আমি কথা বললে তুমি কোনো যুক্তি খুঁজে পাবে না, সুতরাং কথা না বলাই ভালো।’
আমার কাছে অদ্ভুত লাগল। এই প্রথম শুনলাম একটা বিষয়ে জেফের মাথায় কোনো যুক্তি নেই এবং জেফের মতো একজন সংবেদনশীল মানুষ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কথা শুনে এইভাবে হাসলেন!
বছরের পর বছর জেফের মতো ইহুদিরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মাঝে একতরফাভাবে যুক্তিহীন কাহিনি প্রচার করেছেন যে ফিলিস্তিন ইহুদিদের ভূমি এবং ইহুদিদের পূর্বপুরুষেরা দুই হাজার বছর আগে ওখানে বসবাস করত এবং সৃষ্টিকর্তা এই জায়গা তাদের ধর্মগ্রন্থে তাদের নামে লিখে রেখেছেন ইত্যাদি। বরং ফিলিস্তিনিরাই ইসরায়েলের শান্তি ভাঙছে। যুক্তি ছাড়াই আমেরিকানরা তাদের কথা বিশ্বাস করে আসছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এর বিরুদ্ধে কথা বলার বা পাল্টা যুক্তি দেওয়ার লোক ছিল না। কেউ এগিয়ে আসেনি ইসরায়েলি অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে, মার্কিন জনগণকে জানাতে যে, এই জায়গা ফিলিস্তিনিদের, ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসী নয়— তারা তাদের অধিকারের জন্যই সংগ্রাম করছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলন তীব্রতর হলো, ইসরায়েলও তাদের মার্কিনি বোমা, মিসাইল ও যুদ্ধবিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর। অনবরত হত্যা করতে থাকল বেসামরিক জনগণকে। এইবার যুক্তরাষ্ট্রের আরব ও ফিলিস্তিনি তরুণরা বুঝল, মার্কিন জনগণকে বোঝাতে হবে—তারা ভুল করছে ইসরায়েলকে সমর্থন করে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, ক্রমান্বয়ে সব অঙ্গরাজ্যে শুরু হলো যুদ্ধবিরোধী আহ্বান এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত গঠনের আন্দোলন। ইহুদি ছাত্রদেরও অনেকেই সামিল হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত গঠনে।
মার্কিন জনগণ দারুণভাবে উৎসুক হলো— হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, ইউপেএন, কলম্বিয়া ও এমআইটি-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন বলছে, তাহলে নিশ্চয় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যুক্তি আছে। এবার অনেক মার্কিন নাগরিক ভূগোল ও ইতিহাসের পাতা খুলে দেখল, ঠিকই তো, ফিলিস্তিনিরা তো তাদের মাতৃভূমির জন্যই যুদ্ধ করছে।
এই আন্দোলনের কাহিনি অনেক দীর্ঘ, বিস্তারিত বলতে প্রয়োজন হবে আরেকটা লেখার।
ফিলিস্তিনিদেরকে নির্বিচারে হত্যার বিরুদ্ধে হাজার হাজার বাংলাদেশি আমেরিকান ক্ষোভ প্রকাশ করে এইসব বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। যাদের বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অনেক কর্মজীবী মানুষও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন।
সুয়াফ্রিম্যান একজন বয়সী আমেরিকান বাংলাদেশি। সুয়াফ্রিম্যান তার আসল নাম নয়, ছদ্মনাম। তিনিও দুদিন মিছিলে গেলেন নিউ ইয়র্ক শহরের টাইমস স্কয়ারে— গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানাতে। রাস্তার যানবাহন স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশি হামলা বা প্রতিপক্ষ ইসরায়েলি সমর্থকদের ধাক্কাধাক্কি সামলানো এই বয়সে তার জন্য সহজ ছিল না। তিনি ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন মিছিলে আর যাবেন না, বেছে নিলেন প্রতিবাদের আরেক ক্ষেত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের তিনটা বড় দৈনিক পত্রিকা— উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের প্রিয় ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, আমলা ও রাজনীতির লোকদের প্রিয় ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং রবার্ট মারডকের ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। এই তিনটি পত্রিকা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে অনেকভাবে প্রভাবিত করে। এসব পত্রিকার লেখা যুক্তরাষ্ট্রের টিভি চ্যানেলগুলো থেকে শুরু করে কমেডি টকশো এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবাদমাধ্যমেও সংবাদ যোগায়। এই পত্রিকাগুলোর পরিচালনা কর্মকর্তা থেকে লেখক ও সাংবাদিকের নব্বইভাগই বলতে পারেন ইহুদি সম্প্রদায়ের। বছরের পর বছর এরা ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে প্রচার চালিয়ে আসছে এবং ইসরায়েলিদের হত্যাকাণ্ডকে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ বলে বাহবা দিয়েছে। কেউ এনিয়ে প্রতিবাদ করেনি, কেউ এসব লেখার যুক্তি খণ্ডন করতে এগিয়ে আসেনি।
এই প্রথমবারের মতো এসেছে প্রতিবাদ। নিউ ইয়র্ক টাইমসে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা চাক শুমারের ইহুদিদের পক্ষ নিয়ে লেখার প্রতিবাদ জানিয়ে সুয়াফ্রিম্যান লিখেছেন, “জনাব শুমার, দয়া করে সব আমেরিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হউন, শুধু ইহুদিদের নেতা হবেন না।”
এইবারই প্রথম একদল বিবেকমান লোক এগিয়ে এলেন তাদের কলম নিয়ে, লিখতে শুরু করলেন সংবাদ পরিবেশনার নেতিবাচকতা ও পত্রিকাগুলোর নিয়মিত লেখকদের লেখার যুক্তি খণ্ডন করে। যারা এই কলম যুদ্ধে এগিয়ে এলেন, তাদের পরিচয় জানার উপায় নেই, সকলেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। সকলেই গাজা যুদ্ধবিরোধী এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের লেখার পাণ্ডিত্য বা আনাড়িপনা দেখে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের সবশ্রেণির লোক এগিয়ে এসেছেন তাদের কলম নিয়ে। সুয়াফ্রিম্যানও যোগ দিলেন এই দলে, শুরু করলেন লেখা। বেশিরভাগই এই তিন পত্রিকায় ফিলিস্তিনবিরোধী লেখার যুক্তি খণ্ডন করে।
সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলি সমর্থকরাও এগিয়ে এল তাদের পক্ষে কথা বলতে। প্রথমে তারা ছিল হাতে গোনা দশ-বিশ জন। আস্তে আস্তে তাদের সঙ্গে যোগ দিল ইসরায়েলের বেতনভুক্ত এজেন্টেরা, এরপর তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লাগিয়ে রোবোটিক লেখা ছড়াতে লাগল— যা পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু যুক্তি যেখানে নেই, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও হোঁচট খায়। ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও আস্তে আস্তে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট কিছুটা নিরপেক্ষভাবে লিখতে শুরু করল। তা দেখে ইসরায়েলিদের প্রখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য জেরুজালেম পোস্ট’ অক্টোবর ৬, ২০২৪ তারিখে সংবাদ শিরোনামে দিল, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক ইসরায়েল বিরোধিতা ও সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতি কি বিস্ময়কর নয়’।
সুয়াফ্রিম্যান গত এক বছরে পত্রিকাগুলোতে এত এত মন্তব্য ও যুক্তি-বিতর্কের লেখা লিখেছেন যে তা সংগ্রহ করলে একটা মাঝারি আকারের বই হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জনমত গড়ার যুদ্ধ চলছেই— প্রতিবাদের মিছিলে, পত্রিকার পাতায় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে। রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিবর্তন আসতে আরও সময় নেবে। গত ষাট বছরের মধ্যে এই প্রথম মার্কিনিরা শুনল ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা। এই প্রতিবাদের যুদ্ধ আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, নিশ্চয়ই একসময় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ভাণ্ডার ও অর্থের ঝুলি ইসরায়েলের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে এবং ফিলিস্তিনিদের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে।