দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় চীনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। যা ভারতকে চিন্তায় রাখছে চীনের বিআরআই প্রজেক্ট মোকাবেলায়। তাই কী এই দু-দেশকে বাড়তি খাতির?
Published : 09 Jun 2024, 12:57 PM
ভারতে ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করছে এনডিএ জোট। ফলাফল ঘোষণার মাত্র চার দিনের মাথায় অনেকটা তড়িঘড়ি করেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছেন মোদী। এত কম সময়ে শপথ নেওয়ার আয়োজনে জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, বিগত ২০১৪ সালে ১০ দিন ও ২০১৯ সালে ৭ দিনের মাথায় শপথ গ্রহণ করেছিলেন মোদী। আসলে কি তিনি এবার কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না, নাকি জোট শরিকদের হারানোর ভয়ে এত তাড়াহুড়ো করে শপথ?
ভারতে সরকার গঠনের জন্য ম্যাজিক ফিগার ২৭২টি আসন প্রয়োজন। যদিও এবার বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ওই আসন পায়নি। জোটের ভরসায় ক্ষমতায় থাকতে হবে এবারের বিজেপিকে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যদিও ৪০০ পার আসনের ডাক দিয়েছিল তবে ফলাফলে তার উল্টো চিত্র ফুটে উঠেছে। এবার মোদী ৩.০ সরকার এনডিএ জোট শরিকদেরকে নিয়ে দুর্বল সরকারে পরিণত হবে দাবি বিরোধীদের। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় মোদী কতটুকু বলয় সৃষ্টি করতে পারবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদানকে ভারত- বাংলাদেশের বহুদিনের সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পারস্পরিক কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছেন অনেকে। এবারই প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। এই সফর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভারত-বাংলাদেশের গভীর সম্পর্কের প্রতিফলন বলে ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাকতালীয়ভাবে দুবারই মোদীর শপথ অনুষ্ঠানের সময় তার পূর্বনির্ধারিত জাপান সফর ছিল।
তাই প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বাংলাদেশের জন্য নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই বিদেশি নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম নরেন্দ্র মোদীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় নরেন্দ্র মোদী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক বার্তায় লিখেছেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। গত দশকে এই সম্পর্ক নজিরবিহীনভাবে বিস্তৃত হয়েছে। আমাদের জনগণকেন্দ্রিক অংশীদারত্ব আরও শক্তিশালী করার অপেক্ষায় আছি।’
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় চীনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। যা ভারতকে চিন্তায় রাখছে চীনের বিআরআই প্রজেক্ট মোকাবেলায়। তাই কী এই দু-দেশকে বাড়তি খাতির? উঠছে প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই আমন্ত্রণ দেশটির ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ভারত-বাংলাদেশের এই দুই শীর্ষ নেতার উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্কে যে বহুমাত্রিকতা রয়েছে তার প্রতিফলন এটি বলেই ভাবছে রাজনৈতিক মহল।
২০১৪ সাল থেকেই সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে যথেষ্ট তৎপর ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এবার প্রতিবেশী দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতাদের নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ করা যেন সেই পুরানো ইঙ্গিতেরই পুনরাবৃত্তি। তবে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানকে ডাকা হয়নি বলে সূত্রের যে খবর প্রকাশ হয়েছে তাতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। সবচেয়ে চমকপ্রদভাবে নজর কেড়েছে মালদ্বীপের আমন্ত্রণ। যাদের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক গত কয়েক মাসে তলানিতে ছিল সেই মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুকে আমন্ত্রণ জানানোকে একটি বিশেষ ঘটনা হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকরা। তবে আরও নজর কেড়েছে আমন্ত্রিতদের তালিকায় বিশেষ একটি দিক দেখে। তা হলো, নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সাফাইকর্মী, রূপান্তরকামী, শ্রমিকসহ সমাজের বহুক্ষেত্রের ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিকশিত ভারতের দূত হিসাবে দ্রুততম ট্রেন বন্দে ভারত এবং মেট্রো রেলে কর্মরত রেলওয়ে কর্মীরা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে বলে দাবি ভারতীয় গণমাধ্যমসমূহের।
ভারতে এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির অপ্রত্যাশিত ফলাফলের নেপথ্যের কারণ হিসাবে ভোট কুশলীরা অনেকটাই দায়ী করছেন ইউটিউবারদের। এর আগের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল জোয়ার প্রদর্শন করলেও এবার কিন্তু কোনো কাজ হলো না, কারণ আজকাল মানুষ যেখানে বেশি সময় কাটায় সেই সোশ্যাল মিডিয়াই দখলে নিয়েছিল ইউটিউবাররা। যারা অনেকেই লাগাতার মোদীবিরোধী কনটেন্ট পোস্ট করেছিল, ফলে মনে করা হচ্ছে সেটাই কোথাও গিয়ে মোদীর গেরুয়া দলকে বিপদে ফেলে রাহুল গান্ধীর ইন্ডিয়া জোটকে সুবিধা করে দিয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে এই নির্মোহ তথ্য উঠে এসেছে যে, মোদীবিরোধী ইউটিউবাররা জনমত তৈরি করতে অনেকটাই সফল হয়েছে। স্ট্যাটাসটা ডটকমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ৪৭৬ মিলিয়ন ইউটিউব কনটেন্ট ভিউজ রয়েছে এবং নির্বাচন চলাকালীন সময়ে ধ্রুব রাঠির ভিডিও অধিকাংশ মানুষ দেখেছেন। ধ্রুবর করা ভিডিও দ্য রিয়েল স্টোরি ২৭ মিলিয়ন ভিউজ পেয়েছে। এটা ঠিক যে, সাধারণ মিডিয়া যেটা করে উঠতে পারেনি, ধ্রুব রাঠির মতো ইউটিউবাররা এসব জনমত গঠনে বড় ভূমিকা পালন করেন। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই ধ্রুবসহ অন্যরা যেভাবে কথা বলেন, গল্প বলেন বা বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেন সেগুলো শুনতে মানুষ পছন্দ করে ও ভালোবাসে। ইউটিউবারদের এসব ভিডিও জনমত গঠনে অনেকটাই সাহায্য করেছে যা বিশেষ করে শিক্ষিত যুব এবং মধ্যবিত্তদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।
মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করে বাংলাদেশে কী পেল বা না পেল, এর চেয়ে বড় সত্য হলো বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি যা সবার নজর কাড়ছে। আগামীতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশ যে একটি বড় ফ্যাক্টর হবে এটি এখন প্রায় ধ্রুব সত্যের মতো। ভবিষ্যতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটুকু সুসংহত হবে সেটিই এখন দেখার বিষয়।