বিগত সরকারের ওপর সংখ্যালঘুদের যে আস্থা ছিল, নতুন সরকারের প্রতি তারা এখনই ওই আস্থা স্থাপন করতে পারছে না। কারণ, সংখ্যালঘুদের প্রতি এই সরকারের অবস্থা, অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম সম্পর্কে তারা এখনও কিছুই জানে না। এই অনিশ্চয়তা তাদের অনাস্থা, অনিরাপত্তাবোধ ও আতঙ্কের একটা বড় কারণ।
Published : 12 Aug 2024, 09:57 AM
এমন একটা সময় এসেছে পৃথিবীতে আজ, যখন সংখ্যালঘুকে সংখ্যালঘু বললে রাগ করে, নারীকে নারী বললে রাগ করে। তারা ধরে নেয় যে এইসব বিশেষণ আসলে তাদের আলাদা করে রাখার একটা কৌশল, করুণা করার অপচেষ্টা। তারা ধরে নেয়, এই ধরনের পরিভাষার প্যাচে ফেলেই তাদের সঙ্গে বঞ্চনার ভাষিক রাজনীতি করা হচ্ছে।
এমন সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর লোকজন রাজধানী ঢাকার আন্দোলনের ময়দান শাহবাগে কয়েকদিন ধরে সমাবেশ ও মিছিল করছে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবিতে। গত ৫ অগাস্ট গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শূন্যতার কারণে সারা দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি দেখা দেয়, তাতে লুটপাট, ডাকাতি, হামলা, হত্যা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার বেশিরভাগ হয়েছে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের ওপর। কারা চালিয়েছে এই হামলা?
স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজনের এসব হামলায় জড়িত থাকার কিছু খবর সংবাদপত্রে যেমন এসেছে, তেমনই আবার স্থানীয় বিএনপির লোকজনও এসব হামলায় যুক্ত ছিল বলে খবর বেরিয়েছে। বিএনপির লোকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগের দখলমুক্ত নানা কিছু দখলে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠার বাস্তবতা ছিল বলেই কেন্দ্রীয় নেতারা সারাদেশের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সতর্কও করেছেন এবং দিকনির্দেশেনা দিয়েছেন। স্থানীয় থানা পুলিশ ও প্রশাসন অকার্যকর থাকায় পেশাদার চোর, ডাকাত ও নেশাখোররা দলবেঁধে এসব হামলা ও লুটপাটে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতির মধ্যে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর বেশকিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা মোটের ওপর দুই ধরনের। একদল সুযোগসন্ধানী আর আরেকদল ষড়যন্ত্রকারী।
ষড়যন্ত্রকারীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেশ ও বিদেশের ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে বাংলাদেশের সবসময় ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা সংখ্যালঘু ইস্যুকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সুযোগে ভারতের একশ্রেণির পত্রপত্রিকা ও অনলাইন এবং সেখানকার নাগরিকদের একাংশ ভিডিও কনটেন্ট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়ে গুজব ও নিন্দাও ছড়িয়েছে বেশুমার।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বিবৃতি বা শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েছেন সেটি যতটা না অভিনন্দন তারচেয়ে বেশি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কমিটি করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। গত ১০ বছরের মধ্যে এমন কমিটি করতে তাদের দেখা যায়নি বলে পত্রিকায় লিখেছেন সেখানকার সাংবাদিকরাও। এসব পদক্ষেপে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নতুন সরকারকে নিয়ে ভীষণ অস্বস্তিতে আছে ভারত।
বাংলাদেশের অনেকেই, এমনকি সাধারণ জনগণও মনে করছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু সমস্যাকে আরও উসকে দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা চলছে। এসব কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন, স্থানীয় জনসাধারণ এবং এমনকি ইসলামপন্থি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরাও মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জা রক্ষায় পাহারায় বসে গেছেন একেবারে শুরু থেকেই।
গত কয়েকদিনে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর এবং বাড়িঘরে যে হামলা হয়েছে সেগুলোর অনেক ঘটনাই আওয়ামী লীগের শোষণ ও নির্যাতনের পরিণামে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও যে কিছু ঘটনা যে ঘটছে না সেটিও আবার সত্য নয়। তবে কম হোক বা বেশি হোক, আমরা সংখ্যালঘুদের ওপর একটিও হামলার ঘটনা দেখতে চাই না। এবং প্রত্যেকটি হামলার বিচার চাই। আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর এবং তাদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনারও বিচার চাই। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীর কোনো অন্যায় থাকলে সেটির বিচার আদালতে হবে। সংক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমরা কোনো ধরনের হামলার পক্ষে নই। আমরা যেকোনো বিষয়ে ন্যায়বিচারের পক্ষে। আশা করি নতুন সরকার সেই বিচারের ব্যবস্থা শিগগিরই করবে। কেননা, এই বিচার আসলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি।
বাংলাদেশে গত কয়েকদিনের ঘটনায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের যে দাবি ও বাস্তবতা তাতে বেশকিছু বিষয় নতুন সরকারের দ্রুত বিবেচনায় নেওয়ার আছে। প্রকৃতই এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে এবং সেসব ঘটনার কারণে সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনিরাপত্তাবোধ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর সংখ্যালঘুদের যে আস্থা ছিল, নতুন সরকারের প্রতি ওই আস্থা তাদের নেই। কারণ, সংখ্যালঘুদের প্রতি এই সরকারের অবস্থা, অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম সম্পর্কে তারা এখনও কিছুই জানেন না। এই অনিশ্চয়তা তাদের অনাস্থা, অনিরাপত্তাবোধ ও আতঙ্কের একটা বড় কারণ। সংখ্যালঘুরা ধরেই নিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো এই সরকারের সময়ে সক্রিয় ও তৎপর থাকবে এবং সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। আওয়ামী লীগবিরোধী এই রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে তাদের অনাস্থা আছে এবং এই অনাস্থাই তাদের মনে এই সরকারের ব্যাপারে অনিরাপত্তাবোধের জন্ম দিয়েছে। যেটিকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শক্তি কাজে লাগানোর অপচেষ্টা চালাবে।
এসব কারণে আমরা মনে করি শুরুতেই নতুন সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সংখ্যালঘুদের জন্য আস্থা ও নিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শাহবাগে সংখ্যালঘুদের একটি অংশ জড়ো হয়ে যে দাবিগুলো তুলছে, সেগুলোর কোনোটিই অযৌক্তিক নয়। তাদের দাবি হচ্ছে: সংখ্যালঘুদের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয়, সংসদে ১০ শতাংশ আসন, সংখ্যলঘু সুরক্ষা কমিশন গঠন, সব ধরনের হামলা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামো ও আইনি ব্যবস্থার নিরিখে তাদের এই দাবিগুলোর যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা নতুন সরকার একটু খতিয়ে দেখতে পারে। ধর্ম মন্ত্রণালয় নামে আমাদের যে মন্ত্রণালয়টি আছে সেখানে সবসময়ই ইসলাম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টতা বিবেচনায় একজনকে মন্ত্রী করা হয়। নতুন সরকারেও তাই করা হয়েছে। এই ধরনের ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্য প্রথম দর্শনেই আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেন না, গুণবিচার তো পরের কথা। বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে সংখ্যালঘু ইস্যুটি একটি অমীমাংসিত সমস্যা। পার্বত্য অঞ্চলের যেমন আলাদা মন্ত্রণালয় আছে তেমনই তাদের জন্য একটি মন্ত্রণালয় অবশ্যই জরুরি।
জাতীয় সংসদে যে ১০ শতাংশ আসন বরাদ্দের দাবি এসেছে সেটিকে সংরক্ষিত নারী আসনের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পারি। সংসদীয় আসনে অনেক নারীই সরাসরি নির্বাচিত হন। তারপরও তাদের জন্য সংরক্ষিত নারী আসনের যে ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল সেটি যত না বৃহত্তর স্বার্থে তারচেয়ে বেশি আসলে দলের নেতাকর্মীদের পদায়ন এবং সুবিধা দেওয়ার জন্য। সংরক্ষিত এই নারী আসন ৫০ থেকে কমিয়ে এনে সংখ্যালঘুদের জন্য ১৫টি আসন বরাদ্দ করা যেতেই পারে। কিংবা আগামী নির্বাচনে যে দলগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাদের সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখতে পারে আগামী নির্বাচন কমিশন।
সংখ্যালঘুরা যে চারটি দাবিতে আন্দোলন করছে তার মধ্যে ওপরের দুটি দাবিই মুখ্য বলা যেতে পারে। এই মুখ্য দুই দাবি বাস্তবায়ন হলে বাকি দুটি দাবি অনেকটা এমনিতেই বাস্তবায়ন হয়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু গণদাবি ও গণ-আন্দোলনের পথ ধরে আসা সরকার সেহেতু আমরা আশা করি যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের মতো সময়ক্ষেপণ করবে না বরং দ্রুত এই দাবি মেনে নিয়ে শুরুতেই একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জন এবং তাদের মনে নিরাপত্তাবোধের জন্ম দিয়ে শুরুতেই উসকানি ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের সুযোগ নস্যাৎ করে দিক।