‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে সচেতন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনো বিবেচনাতেই মন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের জন্য এবং দলের জন্য মর্যাদাহানিকর। একজন পেশাদার কূটনীকের কাছে এমন বক্তব্য আশা করা যায় না।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 26 August 2022, 08:05 AM
Updated : 26 August 2022, 08:05 AM

‘অনন্তর সমুদ্রের জনহীন তীরে, এইরূপে বহুক্ষণ দুইজনে চাহিয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে তরুণীর কণ্ঠস্বর শুনা গেল। তিনি অতি মৃদুস্বরে কহিলেন, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’

এই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নবকুমারের হৃদয়বীণা বাজিয়া উঠিল। —বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কপালকুণ্ডলা

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের এই উক্তিটি আমাদের দেশের জন্য এক সর্বজনীন প্রতীকী বাক্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের রাজনীতি, আমাদের অর্থনীতি, কূটনীতি, সব কিছুই যেন পথভ্রষ্ট। প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে একটি প্রশ্নই উঁকি দেয়, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’

বিশেষত সম্প্রতি আমাদের দেশের কূটনীতির শিরোমণি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে কপালকুণ্ডলার উক্তিটি খুব মনে পড়ছে। এ সংক্রান্ত আলোচনায় যাবার আগে প্রথমেই কূটনীতি সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলে নেওয়া ভালো।

ইংরেজি ‘ডিপ্লোম্যাসি’র বাংলা করা হয়েছে কূটনীতি। কূট শব্দটি বাংলা ভাষায় নেতিবাচক হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। কূট মানে হচ্ছে কুটিল (কূটবুদ্ধি); জটিল, দুর্বোধ্য (কূটপ্রশ্ন); মিথ্যা, কপট, শঠ (কূটচরিত্র); জালিয়াতি, জোচ্চুরি, কারসাজি বা ঘোরপ্যাঁচযুক্ত (কূটকচাল)। অভিধান মতে, কূটনীতি হচ্ছে কুটিল নীতি; কপটতা; কৌশলপূর্ণ রাজনীতি (প্রধানত এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের)। সেই দিক থেকে ‘ডিপ্লোম্যাসি’ শব্দের অর্থ হিসেবে কূটনীতি শব্দটি কিছুটা বেমানান। একজন মানুষ কূট হলেও হতে পারেন। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের নীতি কী করে কূট বা নেতিবাচক হয়?

কূটনীতির মানে যা-ই হোক না কেন, বর্তমান যুগ হচ্ছে কূটনীতির যুগ। সবকিছুতেই ‘কূটনীতি’ কথাটা ব্যবহার করা হয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যেমন কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা বলা হয়, আবার করোনার টিকার জন্যও যথাযথ ‘কূটনৈতিক উদ্যোগের’ কথা বলা হয়। এভাবে তেল কূটনীতি, জল কূটনীতি, সমুদ্র কূটনীতি, টিকা কূটনীতি, অভিবাসন কূটনীতি, জলবায়ু কূটনীতি, বাণিজ্য কূটনীতি, অস্ত্র কূটনীতি ইত্যাদি নানা কূটনীতির কথা শোনা যায়। বর্তমানে কূটনীতির মারপ্যাঁচে যেমন এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে ঘায়েল করছে, আবার কূটনীতির জোরে সুবিধাও আদায় করছে।

কূটনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ডিপ্লোম্যাসি’ শব্দটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘ডিপ্লোন’ থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। ‘ডিপ্লোন’ মানে হচ্ছে ভাঁজ করা। কাপড়চোপড়/ভাঁজ করে রাখার মতো রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভাঁজ করে রাখা থেকেই এ শব্দের উত্পত্তি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই! কূটনীতি ব্যাপারটি অত্যন্ত পুরোনো। রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতির ধারণাও এসেছে। প্রাচীন গ্রিসের বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। প্রয়োজনে সেই সব নগররাষ্ট্রের মধ্যে দূত বিনিময় হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতেও দূত বিনিময়ের রীতি প্রচলিত ছিল। পঞ্চদশ শতক থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রে দূতাবাস স্থাপন শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ফরাসিরা সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় আলোচককে বোঝার জন্য ‘কূটনীতিক’ (কূটনৈতিক) শব্দটি ব্যবহার শুরু করে।

আধুনিক বিশ্বে কূটনীতি বলতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক বোঝায়। কূটনীতির সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক নিবিড়। নিজ নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও অন্যান্য প্রয়োজনে প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে। কূটনীতির মাধ্যমে সেই নীতি রূপায়িত হয়।

কূটনীতি আসলে সহজ নয়। এটা অত্যন্ত জটিল একটা কাজ। ইংরেজি ভাষায় ডিপ্লোম্যাসি শব্দটির একটি বহু প্রচলিত সংজ্ঞা পাওয়া যায়। সংজ্ঞাটি হলো, যখন তুমি লোকজনকে বোঝাতে পারো যে, যে জিনিসটা তুমি পাবে না, সেটা তুমি মোটেই চাও না—সেই কলাকৌশলের নামই ডিপ্লোম্যাসি। এই সংজ্ঞার মতো কূটনীতিও আসলে খুবই জটিল একটি কাজ। এর ভাব আলাদা, ভাষা আলাদা। উদ্দেশ্যও আলাদা। ফ্রান্সে প্রচলিত একটি কথা আছে, একজন নারীর সঙ্গে একজন ডিপ্লোম্যাটের পার্থক্য কী?

যদি কোনো নারী ‘না’ বলেন, তার মানে ‘হয়তো’, তিনি যদি ‘হয়তো’ বলেন, তাহলে তার মানে হচ্ছে ‘হ্যাঁ’, আর তিনি যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে তিনি কোনো নারীই নন।

ডিপ্লোম্যাটের ব্যাপরটা ঠিক বিপরীত। কোনো ডিপ্লোম্যাট যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তার মানে ‘হয়তো’, তিনি যদি ‘হয়তো’ বলেন, তাহলে তার মানে হচ্ছে ‘না’, আর তিনি যদি ‘না’ বলেন, তাহলে তিনি কোনো ডিপ্লোম্যাটই নন।

আসলে কূটনীতি হচ্ছে এক ধরনের আর্ট। একসময়ে কূটনীতি বলতে কেবল একটি দেশের লাভের কথা ভাবা হতো। বর্তমানে কূটনৈতিক সম্পর্ক পারস্পরিক সুবিধার কথা মাথায় রেখে পরিচালনা করা হয়। আধুনিক যুগে বৈদেশিক সম্পর্ক চাট্টিখানি বিষয় নয়। সম্রাট আকবরের সময় অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো-মন্দে বিশেষ কিছু আসত-যেত না। কিন্তু একালে আসে যায়। কূটনীতি একালে এক কঠিন বিষয়। ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কই হোক বা বন্ধুপ্রতিম সম্পর্কই হোক, মনে করার কারণ নেই যে সবাই সব সময় ভাইয়ের মতো মমতা মাখানো বা বন্ধুর মতো অন্তরঙ্গ আচরণ করবে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে। বৈদেশিক সম্পর্ক পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর। আমি তোমাকে দেব, তুমি আমাকে দেবে। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রেম-প্রীতির ব্যাপার নয়; দেওয়া-নেওয়ার বিষয়; মর্যাদা ও স্বার্থরক্ষার বিষয়।

কূটনীতি আসলে কৌশলের খেলা। কূটনীতির ভাষাও তাই আলাদা। কূটনীতির ভাষা সাধারণ ভাষা থেকে খানিকটা ভিন্ন হয়ে থাকে, সেটা সবার জানা। আমরা অনেক সময় ‘কূটনীতির মারপ্যাঁচ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করে থাকি। আপনি কিছুই বললেন না, নীরব থাকলেন—তাতেও কিন্তু আসল কথাটি বলা হয়ে যায়। আবার একটি বা দুটি শব্দ বললেন নিছক কৌতুকের ছলে, তাতেও কাজ হাসিল হয়ে যেতে পারে।

কূটনীতিতে কতগুলো শব্দ বহুল ব্যবহৃত। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় সমার্থক সেই শব্দগুলো (জারগন) কূটনীতিকদের মুখস্থ। এই যেমন, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু, সমঝোতা, কমফোর্ট জোন, ডায়ালগ, উইন-উইন পজিশন ইত্যাদি। এ ধরনের আরও কিছু শব্দ আছে, যার মূল সুর হলো সহযোগিতা। দ্বিপাক্ষিক হোক বা বহুপাক্ষিক, দ্বিরাষ্ট্রীয় হোক বা বহুরাষ্ট্রীয় অথবা জোটকেন্দ্রিক; কূটনীতি শুরু হয় সহযোগিতার নাম নিয়েই।

সহযোগিতার ইস্যু ছাড়াও কূটনীতিতে আরেকটি শব্দের বেশ কদর—‘বন্ধুত্ব’! মোটামুটি সব দেশের কূটনৈতিক পরিভাষায় এই শব্দটির গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ব্যবহার রয়েছে। কূটনৈতিক নীতিমালার বাইবেল হিসেবে পরিচিত ভিয়েনা কনভেনশনেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই বন্ধুত্বের কথাই বারবার বলা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক তো বটেই আঞ্চলিক জোটগুলোও বেশ কায়দা করে এবং নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।

ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্চিল একসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘কূটনীতি হলো এমন একটা আর্ট যে, তুমি কাউকে জাহান্নামে যাও বলবে এমনভাবে, যেন সে তোমার কাছে এসে সেখানে যাওয়ার ঠিকানা খোঁজ করে।’ আর আড়াই হাজার বছর আগে চীনা সমর বিশেষজ্ঞ সান জু পরামর্শ দিয়েছিলেন, যুদ্ধের সর্বোত্তম পথ হলো, একটা গুলি খরচ না করেও শত্রুকে ঘায়েল করা।

আমাদের কূটনীতি গত পঞ্চাশ বছরেও সেই পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনি। আমাদের কূটনীতির যতটুকু যা মান ছিল, তাও যেন দিন দিন কমছে। আমাদের কূটনীতিকরা এখনও এটাই বোঝেন না যে, সব কথা সব সময় বলা যায় না। কূটনীতিকদের অনেক হিসেবে করে কথা বলতে হয়। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলে কথা বলার ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি হিসেবি হতে হয়। কোন কথায়, কোন শব্দে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা তো বলা যায় না। সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। সেজন্য শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্যে সচেতন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেক এই বক্তব্যকে ‘কান্ডজ্ঞানহীন’ বলে উল্লেখ করছেন। যে কোনো বিবেচনাতেই মন্ত্রীর এমন বক্তব্য দেশের জন্য এবং দলের জন্য মর্যাদাহানিকর। একজন পেশাদার কূটনীকের কাছে এমন বক্তব্য আশা করা যায় না।

বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। এই দেশে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে। এই দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করে সরকার। আর সরকার গঠন হয় প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে। এই দেশে কে সরকার গঠন করবে, সরকার কতদিন টিকে থাকবে, তা নিতান্তই শাসতান্ত্রিক ব্যাপার। দেশবাসীর ইচ্ছের ব্যাপার। অন্য কোনো দেশ সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে না। সরকারে কে আসবে, তা নির্ধারণ করা, কোনো সরকারকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কখনই অন্য দেশ গ্রহণ করতে পারে না। সেটা যদি করে, তবে তা হয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হস্তক্ষেপ।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ‘স্বামী-স্ত্রী’ সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল হয়।

আসলে আমাদের সমাজে সব সেক্টরেই এখন অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। সব সেক্টরে নৈরাজ্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পেশাদারী কূটনীতির মান বর্তমানে দেশের অন্য পাঁচটা সেক্টর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ব্যক্তি বিশেষের খামখেয়ালির কারণে এর মানও কেবল নিচেই নামছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না আমাদের কূটনীতি অবশ্যই কৌশলী, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পরিবর্তিত বিশ্বে কূটনীতিই কেবল বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারে। সম্মান ও মর্যযাদার আসনে বসাতে পারে। কাজেই এ ক্ষেত্রে পথ হারানোর কোনো সুযোগ নেই।