Published : 26 Mar 2025, 01:17 PM
সঙ্গীত ছিল সন্জীদা খাতুনের প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। গানের ভেতর দিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন ভুবনখানি। গান অনেকে গাইতে পারেন, সবাই না হলেও শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন কেউ কেউ, কিন্তু সন্জীদা খাতুনের মতো গানকে নিবিড়ভাবে আর কেই-বা বরণ করতে পেরেছেন! গানের এই আত্মীকরণ তো এক বিশাল প্রাপ্তি, তবে সন্জীদা খাতুন তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার মধ্য দিয়ে অন্তরে সঙ্গীত ধারণ করবার পাশাপাশি বিশাল এক ভুবনের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন সর্বজনের জন্য। গান বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের গান তিনি নিয়ে গেলেন মানুষের কাছে, সমাজের কাছে এবং বাঙালির চিত্তশক্তির বিকাশ ও জাতিসত্তায় হদিশ খুঁজে পেতে গান হয়ে উঠল তাঁর অবলম্বন, সাধনমন্ত্র, জিয়নকাঠি। দ্বিজাতি-তত্ত্বের ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক কলুষ দ্বারা সমাজ আছন্ন করতে পাকিস্তানি শাসকেরা যখন নানা ফাঁদ পেতেছিল, তখন বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত হয়েছিল জাগরণের ধারা। বাঙালির গান, সাঙ্গীতিক উদ্যোগ এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় জাগরণ শুরু হয়েছিল তা ষাটের দশকে প্রতিবাদী চেতনায় উদ্ভাসিত হলো রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপন ঘিরে, আনুষ্ঠানিক রূপ পেল ছায়ানটে, আরো অনেক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাঙালি সত্তায় প্রাণচাঞ্চল্য বয়ে আনলো বাংলা নববর্ষের প্রভাতী সঙ্গীতায়োজন।
জাতির জাগরণের এই অভিযাত্রা ব্যাখ্যাকারী তাঁর এক গ্রন্থের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত ধরে’। এই-অভিযাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং মুক্তির সেই যুদ্ধেও সন্জীদা খাতুন ঝাঁপ দিয়েছিলেন গান অবলম্বন করেই, তাঁর ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার্থী এবং লোকগানের শিল্পীদের নিয়ে গঠন করেছিলেন ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীসংস্থা’। এই গানের দল কলকাতা কিংবা দিল্লিতে নিবেদিত অনুষ্ঠানে সঞ্জীবীত করেছিল দর্শকদের, তেমনি শরণার্থী শিবিরে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গান গেয়ে দৃঢ়চিত্ত করেছিল তরুণ মানস, নিজেরাও হয়েছিল আকুল। স্বাধীন বাংলাদেশে তিলে তিলে বিকশিত হলো ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তন, গোটা উপমহাদেশে সঙ্গীতের পাঠদানের এমন আর কোনো সাধনপীঠ পাওয়া যাবে না, যা সঙ্গীত ও সংস্কৃতির চর্চাকে সমাজ ও জীবনের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে দেয়। সন্জীদা খাতুনের সাথে আরো একদল শিল্পসাধক ও সমাজব্রতী এই আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিলেন নিবিড়ভাবে। সুফিয়া কামাল ছিলেন ছায়ানটের আজীবনের সভাপতি, আর সন্জীদা খাতুন বলতে গেলে ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের আজীবন অধ্যক্ষ। তবে অধ্যক্ষের পোশাকি দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তাঁকে চেনা যাবে না, তিনি ছিলেন সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক, রবীন্দ্রনাথের গানের অসাধারণ ব্যাখাদাতা। ছেলেমেয়েদের গানের তালিম দিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতেন এবং এই কাজে তাঁর কোনো ক্লান্তি ছিল না। তাঁর বাড়ির দরজা আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সবসময়ে ছিল খোলা। শ্রেণিকক্ষে আনুষ্ঠানিক শিক্ষণের পাশাপাশি নিজের ঘরে শিল্পী, শিক্ষক ও শিক্ষানবিশদের গানের তালিম দিয়েছেন দিনের পর দিন, ধরে ধরে শিখিয়েছেন সুরের বিস্তার, স্বরলিপি অনুসরণে গাইবার মধ্য দিয়ে কবির অভিপ্রায় উপলব্ধির চেষ্টা নেয়া, সুর ও বাণীর সম্মিলনে গানের অর্থময়তায় পৌঁছবার দিশা যুগিয়েছেন তিনি। কেবল ছায়ানট নয়, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সুবাদে, সেই আশির দশকের সূচনাকাল থেকে তিনি জেলা-উপজেলা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে নবীন-নবীনাদের কণ্ঠে তুলে দিয়েছেন গান, অন্তরে যুগিয়েছেন অর্থময়তা।
এর পাশাপাশি আমরা দেখি তাঁর ব্যক্তিসত্তার নানা দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি ছিলেন একইভাবে যত্নবান, সেইসাথে অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন দায়িত্ব নির্বাহে পরম নিষ্ঠাবান। সাহিত্য ও সমাজের নানা দিক নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন জার্নালে। পিএইচ.ডি-র পরও করেছেন ডি-লিটের কাজ, সুরশিল্পীর নিরিখে কাব্যবিচার করে লিখেছেন নতুন চিন্তা-উদ্রেককারী গ্রন্থ “ধ্বনি থেকে কবিতা”। পাশাপাশি লিখেছেন সঙ্গীতবিষয়ক জনবোধ্য নিবন্ধ, দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিকে, যা বহন করে স্থায়ী মূল্য।
এমন ধীমান তাত্ত্বিক ও চিন্তাশীল যিনি তিনিই আবার সামাজিক দায়মোচনে সদা রয়েছেন অঙ্গীকারাবদ্ধ ও নিষ্ঠাবান, সাম্প্রদায়িক ভেদচিন্তার বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রামী ও আপোষহীন। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে কতরকম প্রয়াসেই না তিনি যুক্ত। ব্রতচারী চর্চা আবার ফিরিয়ে আনার সাধনায় তিনি কাণ্ডারী হয়েছেন। আবৃত্তি চর্চা বিকাশের সাংগঠনিক প্রয়াসে তিনি প্রণোদনা যোগান। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন্বিত শিক্ষণ কার্যক্রম প্রসারে উদাহরণ তৈরির জন্য গড়ে তোলেন নালন্দা বিদ্যালয়। সংস্কৃতির আলোয় সমাজ উদ্ভাসিত হোক, এই ছিল তাঁর কামনা। এই আকাঙ্ক্ষা অন্তরে ধারণ করে নিরলস ও নিষ্পৃহভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। খ্যাতি স্বীকৃতি সাফল্য কোনো কিছুর মোহ তাঁকে কখনো বিচলিত করতে পারেনি। সঙ্গীত সুধারস অন্তরে যে শুদ্ধতা সঞ্চার করে সেটা ছিল তাঁর শক্তি, আর তাই জীবনভর এমন একাগ্র একনিষ্ঠ বলিষ্ঠ শিল্পসাধনা তিনি করতে পেরেছেন এবং সেই সাধনার সুফল সর্বজনে ব্যাপ্ত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর কাছে জাতির অশেষ ঋণ, তাঁর দ্বারা ঋদ্ধ সমাজ সেই দায় পরিশোধে উদ্যোগী হলে ঘটবে যথার্থ ঋণস্বীকার।