কিছু লোককে অল্প সময়ের জন্যে বোকা বানিয়ে, ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে সাময়িক বাধা সৃষ্টি করে সমাজের অগ্রগতি কৃত্রিমভাবে থামিয়ে রাখা যায় বটে, কিন্তু সবাইকে চিরদিনের মতো বোকা বানানো যে অসম্ভব, রাজনীতি ও ধর্মের ইতিহাসেই তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।
Published : 17 Apr 2023, 02:25 PM
সর্বশেষ বরফ যুগের পর বর্তমান ‘হোলোসেন যুগ শুরু হয়েছে হাজার চৌদ্দ বছর আগে। মিশরীয়, গ্রীক, রোমান, মায়া, আরব, ভারত, চীন ইত্যাদি হোলোসেন যুগের বিভিন্ন সভ্যতা-পর্যায় শেষ হয়ে আমরা এখন আছি আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক যুগে। মানব সভ্যতা বিবর্তিত হয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে কিংবা বর্তমান সভ্যতা গড়ে উঠেছে একাধিক সামাজিক যন্ত্র বা সোস্যাল ডিভাইসের বদৌলতে: ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, টাকা, রাষ্ট্র ইত্যাদি।
প্রথম তিনটি, অর্থাৎ ভাষা, ধর্ম আর সংস্কৃতি সম্ভবত হোলোসেন যুগের আগেই ছিল। টাকা বা অর্থব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে বর্তমান সভ্যতায় আবিষ্কৃত দুই সামাজিক যন্ত্র। অবচেতন এবং সম্মিলিতভাবে এই সব যন্ত্র মানুষ উদ্ভাবন করেছে নিজেদের প্রয়োজনে, জীবন ধারণ ও যাপনে সুবিধা হবে বলে। ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম, টাকা বিনিময়ের মাধ্যম। দুর্বিপাকে ধর্ম মানুষকে সাহস-সান্ত্বনা দেয়। রাষ্ট্র মানুষকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেয়।
ধর্ম, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র ... এই প্রত্যেকটি যন্ত্র বা প্রপঞ্চ দলভুক্তির প্রমাণ, টোটেম। প্রতিটি যন্ত্র একাধারে জীবন-সহায়ক এবং গোষ্ঠীর পরিচায়ক। বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষা, দেবতার সামনে ঢাক-ঢোল বাজানো, বিশেষ ভঙ্গিতে প্রার্থনা, শোভাযাত্রা, উপবাস, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ... সবই বিশেষ গোষ্ঠীভুক্তির অভিজ্ঞান। যত উন্নতিই মানুষ করুক না কেন, তার মস্তিষ্ক রয়ে গেছে আদিম পূর্বপুরুষের মতো, যারা কিনা ভিন্ন গোত্র বা জাতির লোক দেখামাত্র আক্রমণ করে বসতো। এই হোলোসেন যুগে কত তুচ্ছ কারণে মানুষ কত শত বার একে অপরকে কচুকাটা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশের ধর্মবাদী এবং সংস্কৃতিবাদী জনগোষ্ঠীও একে অপরকে সহ্য করতে পারে না, নিজের অস্তিত্বের জন্য পরস্পরকে বিপজ্জনক ভাবে। বাংলা নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রার পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন এবং বল্লম হাতে ভিন্ন টোটেমের দুই দল যুধ্যমান আদিম মানুষের মধ্যে তফাৎ কী?
ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, টাকা, রাষ্ট্র... এগুলোর প্রত্যেকটি ‘টেলিওলজিক্যাল’ সত্তা, একটিও ‘অন্টোলজিক্যাল সত্তা নয়। যে সত্তাগুলো মানুষ নিজের সুবিধার জন্য বানায়, সেগুলোকে বলে ‘টেলিওলজিক্যাল’ সত্তা আর যে সত্তাগুলোর অস্তিত্ব আসলেই আছে, সেগুলোকে বলে ‘অন্টোলজিক্যাল’ সত্তা! বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রং অন্য রকম, যেমন ধরুন জাপানের পতাকার মতো হতেই পারত। মঙ্গল শোভাযাত্রায় পেঁচার মূর্তির বদলে দুম্বার মূর্তি থাকতেই পারত। কাগজের যে ফালিটিকে আমরা ১০০ টাকা বলে চিনি, সেটি ৫০০ টাকা দামের হতেই পারত। যে বস্তুটিকে আমরা ‘কলম’ বলে ডাকি, তাকে ‘কমল’ বলা যেতেই পারত। উপবাস সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না হয়ে উল্টোটা হলেই বা এমন কি অশুদ্ধ হতো মহাভারত? ফরাসি বিপ্লবের আগে জাতিরাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না– মানুষ যখন সাম্রাজ্যে বাস করত, তখনইবা কী এমন অসুবিধা হচ্ছিল?
উপরের প্রশ্নগুলোর একটিও অযৌক্তিক নয়। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, টাকা, রাষ্ট্র... এই যন্ত্রগুলোর যৌক্তিক ভিত্তি থাক বা না থাক, উপযোগিতা আছে নিঃসন্দেহে। সত্যি বলতে কী, মনুষ্য জীবনটাই আগাপাশতলা অযৌক্তিক। কয়েক বছর পরেই মৃত্যুর মাধ্যমে চিরসমাপ্তি হবে যে জীবনের, সেই নশ্বর জীবনখানা লেখাপড়া, ব্যবসাপাতি, চাকরি-বাকরি, আর্টফার্ট... দিয়ে ফালতু সাজিয়ে কী লাভ? মানুষও জানে, জীবজগতে একটাই সত্য আছে: ‘মৃত্যু।’ কিন্তু মৃত্যুর পর আর কিছু নেই, সেটা মানুষ মানতে নারাজ। মাছ, গরু কিংবা তেলাপোকার মৃত্যুর পর কিছু নেই, কিন্তু ‘মানুষ’ নামক বায়োবটগুলোর নিজেকে, নিজেদের নিয়ে অনেক অহঙ্কার। বিবর্তনের কোনো এক পর্যায়ে মানুষের মস্তিষ্কের প্রোগ্রামে কোনোভাবে এই অহঙ্কার জন্মগতভাবে ইনবিল্ট বা গ্রন্থিত হয়ে গেছে।
‘মৃত্যুর পর কী হবে?’– হোলোসেন যুগে কৃষিকাজ শুরু হবার আগে থেকেই এই প্রশ্ন মানুষকে তাড়িত করে আসছে। জানার চাহিদা থাকলে উত্তরের সরবরাহ থাকবেই। যে উত্তর যত চটকদার, তার কাটতি তত বেশি। সব ধর্মে বলা হয়েছে, দুনিয়া দুই দিনের এবং মৃত্যুর পরেই রয়েছে অনন্ত জীবন। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলো বলে: মরার পর বিচার আছে, স্বর্গ-নরক আছে, স্বর্গে সুন্দরী হুর ও সুদর্শন গেলেমান আছে। পৃথিবীতে বিশেষ নিয়মমতো চললে স্বর্গে গিয়ে শুধু পুরুষেরা এইসব পাবে। দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দু ধর্মে বলা হয়, বর্তমান জন্মের কর্মের ভিত্তিতে মৃত্যুর পর উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট পুনর্জন্ম হবে।
উত্তরের চমৎকারিত্ব অবশ্য সত্যের নিশ্চয়তা দেয় না। একবার মরে সেরে পুনরুজ্জীবিত হয়ে কেউ জানাতে পারেনি, মৃত্যুর পর কী আছে। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, টাকা, রাষ্ট্র... প্রত্যেকটি একেকটি বিশ্বাস, বিশ্বাস মাত্রই অন্ধ। মিশরীয়, গ্রেকো-রোমান, মায়া ইত্যাদি ধর্ম হাজার হাজার বছর টিকেছিল। আমরা এখন জানি, সেই সব ধর্ম এবং তাদের দেবদেবীর অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে।
আশার কথা এই যে, মানুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যে কোনো সমাজে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি চলে সমন্বয়। পুরো মধ্যযুগ জুড়ে হিন্দুর ইটের মন্দির বানাত মুসলমান কারিগর। মুসলমানের মাটির মসজিদ বানাতো হিন্দু ঘরামি। মুসলমান তার বিয়েতে ‘গায়ে হলুদ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যা কিছু দিন আগেও ছিল এক হিন্দুয়ানি আচার। হিন্দু বিয়ের কনে হাতে মেহেদীর অলঙ্করণ করে, যা একান্তভাবে একটি মুসলমানি রীতি। পূজার ফুলের জন্য হিন্দু বাড়িতে বাগান থাকে, সেলাই করা জামা-কাপড় পরে হিন্দু পূজায় বসে, হিন্দু দোকান দেয় (‘দোকান’ নয়, সপ্তাহে দুই দিন ‘হাট’ ভারতীয় সংস্কৃতি)– এই সবইতো বহিরাগত আরব-মুসলমান সংস্কৃতি। মুসলমান তার ইফতারে হিন্দুকেও আমন্ত্রণ জানায়। রোজা রেখেও কেউ কেউ বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায় সামিল হয়। সংস্কৃতি ও ধর্মের এই আদান-প্রদান থামানো যেহেতু ব্যক্তি ও সমাজের সাধ্যাতীত, সেহেতু ব্যর্থ চেষ্টা করে লাভ নেই।
টেকসই উন্নয়নশীল সমাজ গঠনের উপায় কী? ধরা যাক, (স-)হ্য, (মা-)ন্য এবং (জ)ঙ্গম - এই তিনে মিলে হয় স-মা-জ। অন্যকে ‘সহ্য’ করতে হবে; প্রথমত আইন এবং দ্বিতীয়ত বুজুর্গ, পিতা-মাতা-বড় ভাই-অভিভাবকের কথা, সামাজিক প্রথা যথাসাধ্য ‘মান্য’ করতে হবে; তৃতীয়ত, ইতিবাচক দ্রোহ আর পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে সমাজকে ‘জঙ্গম’, চলমান হতে হবে, স্থাবর-স্থবির হয়ে পড়লে চলবে না। অনেকেই মনে করে, বাঙালি সমাজ দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। আইনতো কখনই সে মানতে চায়নি, এখনও লাল আলোতে বাংলাদেশে গাড়ি থামে না। সহ্যশক্তি আর মান্যতার এই অভাবের কারণে বাঙালি সমাজ দিনকে দিন তার জঙ্গমতা হারিয়ে ফেলছে।
প্রতিটি রাষ্ট্র, প্রতিটি সমাজ বারো ভূতের আড্ডা। এক দল ভূত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, অন্য এক দল তারস্বরে চিৎকার করে, আরেক দল তীব্র আওয়াজে ঘণ্টা বাজিয়ে নিজের বিশ্বাসের জানান দেয়। প্রতিটি বিশ্বাসই ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত। যদিও রামকৃষ্ণ বলেছিলেন: ‘যত মত, তত পথ’, তবুও একের বিশ্বাস অন্যের বিচারে সত্য নয়। অন্যের বিশ্বাসকে সত্যই যদি সে ভাববে, তবে ভিন্ন বিশ্বাস সহজে, প্রাণ থাকতে সে গ্রহণ করে না কেন?
গ্রহণ না করলেও সমাজের সব ভূতকে অন্য সব ভূতের যাবতীয় কর্মকাণ্ড মেনে নিতে হয় এক সমাজে বসবাসের প্রয়োজনে। তোমার ধর্ম তুমি যত খুশি মান, কিন্তু শ্রেফ তোমার পছন্দ হচ্ছে না বলে আমার উৎসব কেন আমি করতে পারবো না? আমার ধর্মের শোকদিবসে তোমার উৎসব পড়লে তুমি কি আনন্দ না করে শোক করবে?
এক ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্মের কিছু উৎসব-আচার পালনের মাধ্যমেই সমন্বয় শুরু হয়। রাষ্ট্র কেন তার উৎসব পালনে বাধ্য করবে নাগরিকদের– এই প্রশ্নও উঠেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে এই রাষ্ট্রের আচার-উৎসবগুলো আপনাকে পালন করতেই হবে, ঠিক যেভাবে বিশেষ ধর্মের অনুসারী হলে সেই ধর্মের উৎসবগুলো পালন করবেন আপনি, স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে, স্বগোষ্ঠীর সদস্যদের চাপ বা পিয়ারগ্রুপ প্রেসারে।
যে কুর্দিরা ইরানে বসবাস করে, তাদের (রাষ্ট্রীয়) জাতীয়তা ‘ইরানি।’ যে কুর্দিরা তুরষ্কে বসবাস করে, তাদের (রাষ্ট্রীয়) জাতীয়তা ‘তুর্কি।’ ‘ওয়েলশ’, ‘স্কট’, ‘আইরিশ’, ‘ব্রিটন’– এই চারটি জাতির সম্মিলিত (রাষ্ট্রীয়) জাতীয়তা ‘ব্রিটিশ।’ ফরাসী বিপ্লবের অব্যবহিত পরে জাতিরাষ্ট্রের সূত্রপাত থেকে ‘জাতি’ বা ‘নেশন’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক, ‘রাষ্ট্রীয়তা’ এবং ‘জাতীয়তা’ উভয় অর্থে শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ‘বাঙালি’ শব্দটিও যুগপৎ জাতীয়তা এবং রাষ্ট্রীয়তাবোধক হতে বাধা কোথায়? জাতিরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, বিচিত্র ভাষা-ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সে এক রাষ্ট্রজাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করে।
সহ্য-মান্য-জঙ্গমতার ইতিবাচক সমীকরণের নিয়ম অনুসরণ করে চললে বিচিত্র ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয় সাধিত হয়ে কালক্রমে গড়ে উঠবে ‘বাঙালি’ (বা ‘বাংলাদেশি’, নামে কিছু যায় আসে না) রাষ্ট্র-জাতি বা নেশন স্টেট। এই প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে ব্যাহত হলেও হতাশ হবার কিছু নেই। মহাসমন্বয়বাদী নজরুলের মতো ব্যক্তির জন্ম কীভাবে ঠেকিয়ে রাখবেন আপনি, যিনি কিনা ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি’ বলে খোদার আরশ ভেদ করে উঠে ভগবানের বুকে আপন পদচিহ্ন এঁকে দিতে চাইবেন? কিছু লোককে অল্প সময়ের জন্যে বোকা বানিয়ে, ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে সাময়িক বাধা সৃষ্টি করে সমাজের অগ্রগতি কৃত্রিমভাবে থামিয়ে রাখা যায় বটে, কিন্তু সবাইকে চিরদিনের মতো বোকা বানানো যে অসম্ভব, রাজনীতি ও ধর্মের ইতিহাসেই তার ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।