কোন চিন্তা, দর্শন বা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিংবা জাগতিক কী প্রয়োজনে অথবা কোন বোধ থেকে জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো ধর্মভিত্তিক দলে অমুসলিম মানুষেরা সদস্য হন? তারা কি স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব দলে যোগ দেন?
Published : 07 Nov 2024, 08:07 PM
দুটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক।
১. রংপুরে জামায়াতে ইসলামীর ইউনিয়ন শাখার হিন্দু কমিটি গঠন।
২. দুর্গোৎসবে মুখর চরমোনাই পীরের গ্রাম।
জামায়াতের হিন্দু শাখার কমিটি গঠনের সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে গত ২৬ অক্টোবর। আর চরমোনাই পীরের গ্রামে দুর্গোৎসবের খবরটি প্রকাশিত হয়েছে গত ১২ অক্টোবর। এই খবরটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব একটা আলোচনা না হলেও জামায়াতের হিন্দু শাখার কমিটি-সম্পর্কিত খবরটি নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে।
একটি ইসলামপন্থি বা ধর্মভিত্তিক দলে যে অমুসলিমরা সদস্য হতে পারেন এবং তাদের কমিটিও হয়— বিষয়টা অনেককেই হয়তো বিস্মিত করেছে। তবে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কোনো ধর্মভিত্তিক দলে অমুসলিমদের সদস্য হওয়া বা তাদের জন্য আলাদা কমিটি গঠনের বিষয়টিকে নানাভাবেই দেখার সুযোগ রয়েছে এবং এটির নির্মোহ বিশ্লেষণেরও অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক বা ইসলামপন্থি দলগুলোর জনপ্রিয়তা কমছে না বাড়ছে— সেটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বোঝা কঠিন। তবে জনপরিসরে নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে কিছুটা ধারণা লাভ সম্ভব। আবার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে সবার সাংগঠনিক কাঠামো, জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তাও সমান নয়। ওই বাস্তবতা মেনে নিয়ে এটি বলা যায় যে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যতগুলো ইসলামিক বা ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে পরিচিত, তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কর্মী ও সমর্থকের সংখ্যা অনেক বেশি।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার কারণে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে জামায়াতের ব্যাপারে অন্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল বা এখনও রয়েছে, অন্যান্য ইসলামপন্থি বা ধর্মভিত্তিক দলগুলো সেখানে ব্যতিক্রম। বস্তুত এ কারণে গত ৫ অগাস্টের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম জামায়াতে ইসলামীর সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের ব্যাপারে একধরনের স্বনিয়ন্ত্রণ আরোপ করত। এখানে সবশেষ ক্ষমতাসীন সরকার ও দলেরও যে চাপ ছিল, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরে গণমাধ্যমে জামায়াতের খবর প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে ওই স্বনিয়ন্ত্রণ আর নেই।
সম্প্রতি একটি খবর নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, সেটি হলো: ‘পীরগাছায় জামায়াতের হিন্দু শাখার কমিটি ঘোষণা’ । খবরে বলা হয়, গত ২৫ অক্টোবর রাতে রংপুরের পীরগাছা উপজেলা জামায়াত অফিসে এ কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আব্দুল জব্বার। উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা মোস্তাক আহমেদের বরাতে খবরে বলা হয়, কমিটির সভাপতি হয়েছেন মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ভবেশ চন্দ্র বর্মণ এবং সাধারণ সম্পাদক ওষুধ ব্যবসায়ী বিজন চন্দ্র দাস।
জামায়াতের যেকোনো পর্যায়ে কমিটি প্রধানের পদ ‘আমির’। কিন্তু হিন্দু বা অমুসলিম শাখার কমিটির প্রধান সভাপতি। তাছাড়া জামায়াতের গঠনতন্ত্রে অমুসলিম শাখার কমিটির ধরন কী হবে— ওই বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে গঠনতন্ত্রের শেষদিকে অমুসলিম সদস্যদের একটি শপথনামা উল্লিখিত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামী একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে একসময় এর নাম ছিল ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য দলটিকে তাদের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামকরণ করতে হয় এবং এর গঠনতন্ত্রেও পরিবর্তন আনতে হয় দলটিকে।
জামায়াতের গঠনতন্ত্রে ‘হিন্দু শাখা’ বলে কোনো বিধান নেই। তবে অমুসলিম সদস্যের শপথ রয়েছে। ফলে সম্প্রতি যে খবরটি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, ওই খবরটি জামায়াতের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কিছুটা ভুল। দলটির গঠনতন্ত্রের পরিশিষ্ট ১১-তে ‘অমুসলিম সদস্য/সদস্যার শপথনামা’ নামে একটি অংশে বলা হয়েছে, কোনো অমুসলিম যদি জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হতে চান তাহলে তাকে এই শপথ গ্রহণ করতে হবে।
শপথটি এরকম: ‘আমি.............., পিতা/স্বামী..............পূর্ণ দায়িত্ববোধের সহিত শপথ গ্রহণ করিতেছি যে, ১. আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য/সদস্যা হিসেবে জামায়াতের নিয়ম শৃংখলা ও সিদ্ধান্তসমূহ নিষ্ঠার সাথে মানিয়া চলিব। ২. জামায়াতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নকে গুরুত্ব প্রদান করিব। ৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করিবার জন্য একনিষ্ঠভাবে ভূমিকা পালন করিব। ৪. উপার্জনে অবৈধপন্থা অবলম্বন করিব না।’
জামায়াতের হিন্দু সদস্য কত?
জামায়াতের হিন্দু বা অমুসলিম শাখার কমিটি গঠন-বিষয়ক সংবাদটি নিয়ে জনমনে কৌতূহলের কারণ সম্ভবত এই যে, দলটির গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় যে সকল মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য গঠনতন্ত্রে প্রণীত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে রয়েছে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর বিশ্বাস। এমতাবস্থায় কোনো অমুসলিম, তাতে তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য যেকোনো ধর্মেরই হোন না কেন, তিনি কি এইসব মৌলিক বিষয় মেনে নিতে প্রস্তুত? কেননা তাদের গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত এই মৌলিক বিশ্বাসগুলো কোনো অমুসলিম ব্যক্তির পক্ষে মানা অসম্ভব। আর তিনি যদি মানতে না চান, তাহলে কি তিনি জামায়াতের সদস্য হতে পারবেন, নাকি কোনো অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামের এইসব মৌলিক বিশ্বাস মেনেই জামায়াতের সদস্য হন? সম্প্রতি রংপুরে যাদেরকে নিয়ে জামায়াতের হিন্দু বা অমুসলিম শাখা গঠন করা হলো, তাদেরকে এই প্রশ্নটি করা যেতে পারে।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জামায়াতের বর্তমান আমির শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্য নজরে এসেছে। তিনি বলেছেন: ‘আমাদের এই সংগঠনে অমুসলিমরা কীভাবে কাজ করবেন? তারা নামাজ রোজা হজ জাকাত করবেন না। কিন্তু একজন সৎ মানুষ হিসেবে এবং সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে তারা সকল ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।’
জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে দলের সদস্য (রুকন) হতে গেলে তাকে ব্যক্তিগত জীবনে ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করতে হবে। একজন অমুসলিমের পক্ষে এটা মানা অসম্ভব। কেননা এটা তার ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর কেউ সদস্য বা রুকন হতে না পারলে তার পক্ষে পরবর্তী ধাপে যাওয়া সম্ভব নয় এবং জামায়াতের আমিরের বক্তব্যেও এটি স্পষ্ট যে, অমুসলিমরা জামায়াতের সদস্য হলে কী করবেন? তার মানে একজন অমুসলিম জামায়াতের সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু পদ্ধতিগত কারণেই গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত কোনো পদে তার দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। অর্থাৎ জামায়াতের অমুসলিম সদস্যদের যে স্ট্যাটাস, সেটি সমর্থকের চেয়ে একটু উপরে।
তবে রংপুরে হিন্দু শাখার কমিটি গঠনের সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার দুদিন পরে আরেকটি খবর নিয়েও আলোচনা তৈরি হয় যে, জামায়াতের কেন্দ্রীয় হিন্দু শাখার কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও এই খবরটি সঠিক নয় বলে দাবি করে জামায়াতের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নামে ভুয়া প্যাড তৈরি করে এবং জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের নামে ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
জানার আগ্রহ, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের গত ৫৩ বছরে জামায়াতে ইসলামীতে কতজন অমুসলিম সদস্য হয়েছেন এবং দলে এ মুহূর্তে অমুসলিম সদস্যের সংখ্যা কত? গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত খবরে বলা হয়, শুধু মাগুরা জেলাতেই জামায়াতের অমুসলিম কর্মীর সংখ্যা দেড় হাজার। প্রশ্ন হলো, বাকি জেলাগুলোয় এই সংখ্যা কেমন এবং মোট সংখ্যাটি কত? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা সম্ভব হয়নি। তবে দলের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলায় জামায়াতের অমুসলিম শাখার কমিটি রয়েছে। হিন্দু ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের লোক জামায়াতের সদস্য হয়েছেন কিনা বা এ মুহূর্তে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মের কতজন লোক জামায়াতের সদস্য, সেটিও জানার কৌতূহল অনেকেরই আছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
দেশের অন্যতম প্রধান ইসলপন্থি বা ধর্মভিত্তিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। চরমোনাই পীরের দল নামে পরিচিত এই রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো বেশ শক্তিশালী। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি অনেক আসনে জয়ী না হলেও ভোটপ্রাপ্তির দিক দিয়ে ছিল তৃতীয় অবস্থানে। এরপর, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরে এক সময় যে জাতীয় পার্টিকে তৃতীয় প্রধান দল বলা হতো, সেই জায়গাটি যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দখল করেছে, সেটি বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনে হয়েছে। তবে গত ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশি উচ্চারিত হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর নাম। তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ‘প্রধান অংশীদার’ বলেও অনেকে মনে করেন। সেটি অন্য তর্ক।
জামায়াতের মতো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশেও অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে জামায়াতের মতো এই দলে অমুসলিমদের জন্য আলাদা কোনো শাখা নেই। দলের একজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু বিষয়ক সম্পাদক’ নামে একটি পদও আছে সকল কমিটিতে। তবে তাদের গঠনতন্ত্রে কী আছে, সেটি আপাতত তিনি জানাতে রাজি হননি। কেননা গঠনতন্ত্র সংশোধনের কাজ চলছে। তার দাবি, বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে আনুমানিক ১০ হাজার অমুসলিম সদস্য রয়েছেন।
ইসলামি দলে কেন অমুসলিম সদস্য?
সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন জনমনে উঠতে পারে যে, কোন চিন্তা, দর্শন বা আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিংবা জাগতিক কী প্রয়োজনে অথবা কোন বোধ থেকে জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো ধর্মভিত্তিক দলে অমুসলিম মানুষেরা সদস্য হন? তারা কি স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব দলে যোগ দেন নাকি কোনো সাম্প্রদায়িক ভীতি এখানে কাজ করে?
প্রশ্নটা করেছিলাম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওই নেতাকে। তার ভাষায়, দেশের কল্যাণ ও নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই মূলত অমুসলিমরা ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশকে সমর্থন করেন এবং অনেকে সদস্য হন। কেননা তারা (অমুসলিম) এটা বুঝতে পারেন যে, প্রকৃতপক্ষে যারা ইসলামের অনুসরণ করেন, তাদের কাছে অমুসলিমরা নিরাপদ। তিনি উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার উদাহরণ দিয়ে বলেন, বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চরমোনাই পীরের গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপূজার বিশাল আয়োজন হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও অসংখ্য হিন্দু চরমোনাই মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়ে তাদের জীবন বাঁচিয়েছেন।
জাতীয় রাজনীতির প্রভাব?
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাতীয় পার্টি মূলত সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ হিসেবে কাজ করেছে। সংসদে তারা ছিল অনুগত বিরোধী দল। রসিকতা করে তাদেরকে ‘সরকারি বিরোধী দল’ও বলা হতো। উপরন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে দলের ভেতরে প্রকাশ্য বিভক্তি। সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টি এখন একটি দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে। তার জনপ্রিয়তাও যে দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে— সেটি বোঝার জন্য অনেক বড় গবেষণার প্রয়োজন নেই। এরকম বাস্তবতায়, আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বাইরে গিয়ে অনেকেই ইসলামি দলগুলোর প্রতি, বিশেষ করে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতি ঝুঁকেছে বলে মনে করা হয়।
মুসলিম প্রধান দেশ এবং ধর্মের প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সংবেদনশীলতার কারণে এখানে বিরাট সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন, যেহেতু আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল এবং তাদের কেউই জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সেভাবে সফল হয়নি। ফলে এই তিনটি দলের বাইরে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে, বিশেষ করে ইসলামিক কোনো দল সরকার গঠন করলে দেশ থেকে অন্তত দুর্নীতি কমবে। তাছাড়া পরকালীন শান্তির জন্য ইসলামপন্থি দলকে সমর্থন ও তাদেরকে ভোট দেয়া উচিত বলেও অনেকে মনে করেন। মূলত মানুষের এই অনুভূতি ও বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করেছে। জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে।
জনমনস্তত্ত্বে পরিবর্তন?
ধর্মভিত্তিক দল, বিশেষ করে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জনসমর্থন বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এখন এই প্রশ্নটিও অনেকে করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও মৌলবাদী বা কট্টর নয় বলে যে জনপ্রিয় কথাটি চালু রয়েছে, ওই ধারণায় কি পরিবর্তন এসেছে? মানুষের মনোজগৎ এবং ভোটের রাজনীতিতে কি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে? ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রতি মানুষের যে আগ্রহ বাড়ছে, সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ধর্মভিত্তিক নয় এমন দলগুলোর ব্যর্থতা কতখানি দায়ী?
ষাট বা সত্তর দশকেও এ দেশে ধর্মীয় দলগুলোর তেমন প্রভাব ছিল না। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোও ধর্মকে নিজেদের রাজনীতি ও ভোটের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে খুব একটা উৎসাহী ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম ভিত্তি ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’— যাকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধানেরও অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কারণ ধর্মের নামে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর কী ধরনের আচরণ করেছে, সেটি সবার জানা। অথচ দেখা গেল ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তিতে স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্রের সব প্রধান দলই এখন ধর্মকে তাদের রাজনীতি ও ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কে কতটা ধার্মিক— তা প্রমাণে তাদের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতা চলে। প্রধান দুটি দলই তাদের নীতি বা নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির প্রতিফলন ঘটায়। অতএব, ধর্মভিত্তিক দলগুলো এ সুযোগটিই নিয়েছে কিনা— সেটিও বিরাট প্রশ্ন।
তবে ধর্মভিত্তিক দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ব্যাখ্যা যা-ই হোক না কেন, দুটি প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি।
১. ইসলামপন্থি বা ধর্মভিত্তিক দলে হিন্দু তথা অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার পেছনে আসলেই কী কী কারণ রয়েছে? যেসব কারণ দলগুলোর তরফে বলা হয়, তার বাইরে আরও কোনো কারণ রয়েছে কিনা?
২. মূলধারার দল হিসেবে পরিচিত কিংবা ইসলামপন্থি নয় এমন দলগুলোতে অমুসলিম শাখা যদি না থাকে বা রাখার প্রয়োজন না হয়, তাহলে ইসলামপন্থি দলে অমুসলিম শাখা কিংবা অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার আলাদা বিধান রাখতে হবে কেন?
আরও পড়ুন