ঢালাওভাবে সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুললে অনেক রিয়েল ইস্যু চলে যাবে কার্পেটের তলায়। সিন্ডিকেট আছে বৈকি; তবে সব ক্ষেত্রে এ কারণেই পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ে না, একেক ক্ষেত্রে একেক বা একগুচ্ছ কারণে দাম বাড়ে। সেগুলো চিহ্নিত করা চাই।
Published : 28 Jun 2023, 01:04 PM
সব পণ্য বা সেবার বাজারেই 'সিন্ডিকেট' আছে, এটা বলা যাবে না। এ মুহূর্তে কাঁচামরিচের দাম বেড়ে গিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেখানে কি সিন্ডিকেট আছে? কিংবা পেঁয়াজের দাম বাড়তে বাড়তে যে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা হয়ে গিয়েছিল, সেখানে কি কাজ করেছিল সিন্ডিকেট? তখন কিন্তু এমন খবরও প্রচার হয় যে, কৃষক ভালো দাম পাচ্ছে। তবে কথা থাকে, কত শতাংশ কৃষকের হাতে পেঁয়াজ ছিল তখন? নাকি সেটা ছিল কেবল বড় কৃষক আর ব্যবসায়ীদের হাতে? তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছিল, এটাও কি বলা যাবে? তখন বলা হচ্ছিল, দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে দেখেও কৃষি মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি না দিয়ে ভুল করছে। এসবের দাম স্বাভাবিক রাখতে না পারলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যেহেতু সমালোচিত হতে হয়, তাই তারা কিন্তু জোর দিচ্ছিলেন আমদানির ওপর। যাহোক, দেরিতে হলেও পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় এবং তাতে মিলছে কিছু সুফল। দামের ঊর্ধ্বগতি অন্তত রোধ করা গেছে।
কাঁচামরিচের বেলায় বলব, সরকারের উচিত ছিল এর সংকট দেখা দেওয়ার আগেই আমদানির অনুমতি দেওয়া। এ সময়ে দেশের অনেক নিম্নাঞ্চল দ্রুত ডুবে যায়। যে তাপপ্রবাহ গেল দেশের ওপর দিয়ে, তাতেও মরিচ গাছের ক্ষতি নাকি হয়েছে। ঘটনা সত্য হয়ে থাকলে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের তো সেটা খেয়াল এবং মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করার কথা। এ অবস্থায় দাম 'অস্বাভাবিকভাবে' বেড়ে ওঠার আগেই পাশের দেশ থেকে দ্রুত কাঁচামরিচ আমদানি শুরু করাই ছিল সঙ্গত। আমরা তো সময়ে সময়ে কাঁচামরিচ, এমনকি ধনেপাতা আমদানি করি। টমেটো, গাজরও। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক গোলমেলে হলেও সেখান থেকেও কিছু কৃষিপণ্য আনি। স্থলবন্দর দিয়ে আনা উভয় ক্ষেত্রেই সহজ। তাতে বাজারে দ্রুত কিছুটা প্রভাব ফেলাও যায়।
এবারকার কোরবানির হাটে গরু-ছাগলের দাম নাকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। চাহিদার চেয়ে বেশি গবাদিপশু আছে; তারপরও দাম বেশি। কারণ পশুপালনে খরচ বেশি পড়েছে। এত এত খামারি ও কৃষকের মধ্যে তো সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। এখানে দাম বাড়ছে অন্য কারণে। গরু-ছাগল পরিবহনে খরচও অনেক বেড়েছে—যেহেতু ডিজেলের দাম অনেক বাড়ানো হয়েছিল এবং সুযোগ তৈরি হলেও তা সেভাবে আর কমানো হচ্ছে না। পথে পথে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু করার আছে কি? এক্ষেত্রে বরং বেশি করে জড়িত প্রাণিসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গরু-ছাগলের হাটে অনিয়মের কারণে দাম বেড়ে গিয়ে থাকলে সেটা দেখার কথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।
কোনো কোনো পণ্য ও সেবার দাম কেন অনেক বেশি বা কিছুতেই কমছে না, সেটা বুঝতে হলে বেশি করে তাকাতে হবে সরকারের নীতিকৌশল ও শাসনের দিকে। ভোক্তাস্বার্থ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন দেখি এ সময়ে ভারত থেকে সীমিতভাবে 'গরু আমদানির' ওপরও জোর দিয়েছে। এত কড়াকড়ির মধ্যে কিছু গরু নাকি আসছেও সীমান্তপথে। চাহিদা ও দামের বিস্তর তফাৎ থাকলে কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এগুলো শতভাগ বন্ধ করা তো কঠিন। এটা অনেক ক্ষেত্রে ভোক্তার স্বার্থবিরোধীও হয়ে ওঠে। তাদের স্বার্থ দেখতে গেলে আবার গরু-ছাগল উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের পশুগুলো আরও বেশি অবিক্রিত থাকবে তখন। সেগুলো পরে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করতে হবে কম দামে। এতে তাদের লোকসানও হতে পারে।
সব ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুললে অনেক রিয়েল ইস্যু চলে যাবে কার্পেটের তলায়। তবে সিন্ডিকেট আছে বৈকি; অন্তত থাকা অসম্ভব নয়। এটা আছে ভোজ্যতেল ও চিনির ক্ষেত্রে। এ দুটি নিত্যপণ্যের বাজারে প্রবলভাবে উপস্থিত মাত্র কয়েকটি বিজনেস গ্রুপ। যোগসাজশে এ দুটি পণ্যের দাম তারা বাড়িয়ে দিতে পারে। এ দুটি ক্ষেত্রে আমরা প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভরও। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেলে তাই বিকল্প থাকে না দেশে দাম না বাড়ানোর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্যারিফ কমিশন অবশ্য চেষ্টা করে দাম বেড়ে যাওয়ার সময়টায় একে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের। তাতে সাফল্য মেলে কমই। সাম্প্রতিককালে সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। সরকার শুল্ক ছাড় দিয়েও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। তাতে রাজস্ব আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভোক্তাও সুবিধা পায়নি। হয়তো বলা হবে, ওই পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দাম আরও বাড়তো! যাহোক, একটা পর্যায়ে এসে দেখা গেল, পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো নিজেরাই একটা দাম নির্ধারণ করে দিলো চিনির। সরকারকে উল্টো বলল—এটাই হওয়া উচিত দাম। একে ধৃষ্টতামূলক বলা যেতে পারে; তবে মনে হয় না, তাতে দামের ক্ষেত্রে কোনো সুফল মিলবে। কেননা চিনির বাজারে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং তারা সংঘবদ্ধ। আর রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে কিছু উৎপাদন হয় বটে এবং টিসিবিও চিনি বিক্রি করে ভর্তুকিতে; কিন্তু বাজারে তার প্রভাব নেই বললেই চলে।
ভোজ্যতেলের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। সয়াবিন ও পামঅয়েল এমন পণ্য যে, এটা 'বাল্ক ইমপোর্ট' করতে হয় এবং কাজটা এমনকি মাঝারি ব্যবসায়ীরও নয়। আর দেশে উৎপাদিত অল্প পরিমাণ সরিষার তেল দিয়ে এ বাজারকে প্রভাবিত করা অসম্ভব। এ অবস্থায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে বাড়তে লিটারপ্রতি ২০০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে সামান্যই কমানো গেছে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক বাজারে কতটা বেড়েছে কিংবা সেখানে দাম কমে এলেও দেশীয় বাজার তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। এসব পণ্য থেকে সরকার কী পরিমাণ কর-শুল্ক আদায় করে দাম বাড়ানোয় ভূমিকা রাখছে, সে প্রশ্নও কি তুলতে হবে না? এই যে সরকার অব্যাহতভাবে বড় বাজেট বাস্তবায়ন করছে—অর্থটা আসছে কোত্থেকে? প্রধানত কর-রাজস্ব থেকে। আর এটা আসছে মূলত পরোক্ষ কর থেকে। তাতে আছে চিনি, ভোজ্যতেলের মতো পণ্যে আরোপিত কর-শুল্ক। যারাই বাজার থেকে ওইসব কেনে, তারা অটোমেটিক কর পাঠিয়ে দেয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। যার টিন নম্বর নেই কিংবা থাকলেও নেই করযোগ্য আয়, তাকেও পণ্য বা সেবা কিনতে গিয়ে অব্যাহতভাবে কর-রাজস্ব জুগিয়ে যেতে হচ্ছে সরকারকে।
যেসব ক্ষেত্রে মাত্র একজন বা হাতেগোনা কয়েকজন বিক্রেতা বিদ্যমান, সে বাজারকে অবশ্যই কড়া মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। কেননা তারা চাইবে মুনাফা সর্বোচ্চ শুধু নয়, অস্বাভাবিক মুনাফা করতে। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তারা ভুল করবে, এমনটা না ভাবাই উত্তম। এ চেষ্টাও জারি রাখতে হবে, যেন ওইসব পণ্যের বাজারে আরও বিক্রেতার প্রবেশ ঘটে। তাদের মধ্যে সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা যেন বেড়ে ওঠে। প্রতিযোগিতা বাড়াতে কোনো কোনে ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিকেও বাজারে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। পণ্য আর সেবার মান বাড়তেও দেখা যায়। আমাদের টেলিযোগাযোগ খাতে এটা ঘটেছে। একটা সময় পর্যন্ত তো মাত্র একটি কোম্পানি ব্যবসা করে যাচ্ছিল। সেটা পরে ভেঙে দেওয়া হয় নীতি বদলে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকেও বাজারে আসার সুযোগ করে দেওয়া হয়, যাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। এর সুফল মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা পাচ্ছেন। তারা হয়তো আরও কম খরচে সেবা পেতেন—যদি সরকার কিছুটা কম কর-রাজস্ব এখান থেকে তুলতে সম্মত হতো।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট থাকলেও সব ক্ষেত্রে এ কারণেই পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়ছে, এটা বললে সরলীকরণ হবে। একেক ক্ষেত্রে একেক বা একগুচ্ছ কারণে দাম বাড়ে। সেগুলো চিহ্নিত করা চাই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে এলেও দেখা যাচ্ছে এখানে সেভাবে কমছে না—স্থানীয় অব্যবস্থাপনার কারণে। সেটা আড়াল করতে আবার অব্যাহতভাবে দায়ী করা হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধকে। এমনকি আমাদের সমমানের দেশে ওই যুদ্ধের প্রভাব কিভাবে সামলানো হয়েছে, সেদিকেও কি লক্ষ করব না? বলা হচ্ছে —ডলার সংকটে এর দাম এত বেড়েছে যে, আমদানিকৃত পণ্যের দাম কমছে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা দরকার, সব দেশেই কি ডলারের দাম এতটা বেড়েছে আর তাতে আমদানিতে দেখা দিয়েছে একই সংকট? দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর দামও তো অনেক বেড়েছে। চালের দাম কেন বাড়ছে বা 'উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল'? চালকল মালিকরা কি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে নিয়ন্ত্রণ করছে দাম? নাকি চালের উৎপাদন ব্যয় গেছে বেড়ে? ডিজেল ও সারের দাম বৃদ্ধি অর্থাৎ এ খাত থেকে সরকারের ভর্তুকি হ্রাসটাই কি প্রধানত দায়ী নয়? সরকারকেও কি সেজন্য আরও বেশি দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে না?
এত মূল্যস্ফীতির মধ্যেও আম-কাঁঠাল পাওয়া যাচ্ছে সহনীয় দামে। এর কারণ এখানে সিন্ডিকেশনের সুযোগ নেই, শুধু তা-ই নয়; উৎপাদন পরিস্থিতি ভালো। গরমে আম-কাঁঠাল দ্রুত পেকে বাজারে চলে আসছে, এটাও কারণ। আম-কাঁঠাল প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটলে এবং এর ভালো রপ্তানি নিশ্চিত করা গেলে পরিস্থিতি কিন্তু পাল্টে যাবে। তাতে উৎপাদকদের সুবিধা। সরকারকে আবার দেখতে হবে, পরিস্থিতি যেন ভোক্তার খুব প্রতিকূলে চলে না যায়। সরকারের কাজ ব্যবসায় যোগ দেওয়া নয়। তার কাজ বাজারকে স্বাভাবিক ধারায় রাখা। প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থের যথাসম্ভব সমন্বয় করা। প্রতিবছর দেওয়া বাজেটেও যে কাজটি সরকারকে করতে হয় বা করা উচিত।
সরকারের কাজ কেবল নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখাও নয়; সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেন অটুট থাকে এবং বাড়ে, তা নিশ্চিত করা। ব্যবসায়ীবান্ধব নয়, ব্যবসাবান্ধব থাকা। এক্ষেত্রে বজায় রাখা দলনিরপেক্ষতা। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ যেন বাড়ে, তার জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়া। তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের হাতে কাজ থাকলে এবং আয় বাড়লে নিত্যপণ্যের স্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি কিন্তু সয়ে যায়। সাধারণ মানুষের হাতে যখন অর্থকড়ি কম, সঞ্চয় নেই; তখন সিন্ডিকেশন বা এমন কোনো কারণে যদি জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, সেটা মানুষকে হতাশ আর ক্ষুব্ধ করে তোলে বৈকি। তার প্রকাশ নানাভাবেই ঘটতে পারে।