অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে নতুন সরকারকে। তিনটি বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক বোঝাপড়া এবং আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল।
Published : 17 Jan 2024, 07:09 PM
নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা কৌশলে আরও ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট নিয়ে নিলেন। নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ নির্বাচনকে বলা হয়েছে বিতর্কিত, একতরফা। নির্বাচন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও ক্ষমতাসীনদের ওপর বিশ্ব পরাশক্তির প্রবল আগ্রহ ও চাপ ছিল। সেগুলো উপেক্ষা করেই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
এই নির্বাচন দেশের ভেতরে যেমন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমর্থিত হয়নি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে পরাশক্তিসমূহ স্পটত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের পরপরই ভারত, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তানসহ বেশকিছু দেশ টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং নির্বাচন নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনের সমালোচনা করেছে এবং এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্বাচন-পরবর্তী বিবৃতিতে তিনটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলের হাজার হাজার কর্মী গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনি অনিয়মে তারা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, নির্বাচনটি অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় ওয়াশিংটন ‘দুঃখিত’। পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানায় তারা।
তৃতীয়ত, মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি এগিয়ে নিতে এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। (মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইট, ৮ জানুয়ারি ২০২৪)
৬টি আন্তর্জাতিক সংগঠন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (এএনএফআরইএল), ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন (সিআইভিআইসিইউএস), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ), এশিয়ান ডেমোক্রেসি নেটওয়ার্ক (এডিএন), ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রোজেক্ট (অস্ট্রেলিয়া) ও অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএএন) এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করছে।তারা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, এই নির্বাচন যথাযথ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক— কোনোটিই হয়নি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহ ও আন্তর্জাতিক নির্বাচনি মানদণ্ড মেনে এই নির্বাচন হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। সংগঠনগুলো বলেছে, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ফলাফলে কারচুপির গুরুতর অভিযোগ আছে যা গণতন্ত্রের মূল নীতিকে ক্ষুণ্ন করে।
নির্বাচনি আলোচনা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পশ্চিমা শক্তি নানাভাবে সরকারকে চাপের মধ্যে রেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি অনুযায়ী নির্বাচন করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি বিরোধীদের হলেও পশ্চিমাদের স্বার্থের বিষয়টি এতটা নীরিহ ছিল না। তাদের ছিল আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির নানা স্বার্থ ও সমীকরণ। একটা বিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলগুলোর কাছে তাদের স্বার্থ-সুবিধা আদায় করা সম্ভব হলেও কোনো এককেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকারের কাছ থেকে হয়তো সেটা সম্ভব হতো না। অথবা তেমন পরিবেশে থাকলে সেই বিরোধ-অবস্থাকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানো যায় সেটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের আগ্রহের কারণ ছিল এখানেই। কেননা গণতন্ত্র, মানবাধিকার বিশ্বের অনেক দেশেই নেই বা সীমিত। সেখানে তাদের এমন প্রকল্প নিয়ে হাজির হতে দেখা যায় না। কারণ ওইসব দেশের শাসক-শাসন তাদের স্বার্থের অনুকূল, বৈরী নয়।
নির্বাচন কমিশন ৪১ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির কথা বললেও দেশের বিরোধী দলগুলা কমিশনের এই দাবিকে প্রত্যাখান করেছে। পাশাপাশি নির্বাচন বাতিল করে নতুন করে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা এই সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নতুন শাসকের জন্য সরকার পরিচালনার কাজটি সহজ হবে না। ইতোমধ্যে শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, তাদের সামনে প্রধানত তিনটি চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো হচ্ছে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক। তাদের সরকার এই তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করবে।
এই তিনটি বিষয়ই অভ্যন্তরীণ আস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক বোঝাপড়া ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য এই কাজগুলো করা কি সহজ হবে?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও নির্বাচন ঘিরে গতবছর যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, যা ক্ষমতাসীনদের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাবেরই প্রকাশ। ইউরোপ-আমেরিকা হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার। ইতোমধ্যে সেখানকার বায়াররা বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যে কোনো পরিস্থিতিতে বিনা ক্ষতিপূরণে তাদের কার্যাদেশ বাতিলের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে বলে খবর এসেছে। ভূরাজনৈতিক সমীকরণে চীন-ভারত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে থাকলেও তারা আমাদের পণ্যের ক্রেতা নয় বরং বাংলাদেশ হচ্ছে তাদের পণ্যের বাজার। উপরন্তু চীন-ভারতের থাকবে বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ-সুবিধায় তীক্ষ্ণ নজর।
গণতন্ত্র-মানবাধিকার মার্কিন সরকারের কেতাবি ইস্যু হলেও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য খর্ব করতে চায় তারা। আকাশ ও স্থল ও সমুদ্রপথে চীনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ও বাধা প্রদান করা তাদের এই পরিকল্পনার অংশ। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর— যুক্তরাষ্ট্র উভয় করিডোরই বন্ধ করতে চায়। এ জন্য তারা সামারিক চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে বলে শোনা যায়। এ সংক্রান্ত সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর, গুরুত্বপূর্ণ, জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তারও বিষয়।
মহামারী পার হতে না হতেই রাশিয়ার ইউক্রেইন অভিযান বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা ও পরাশক্তির নতুন সমীকরণ স্পষ্ট করে। একইসঙ্গে বিশ্ব মূল্যস্ফীতি ও তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়, যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গাজা আক্রমণ করে বসে ইসরায়েল। চলমান সংকট আরও ঘনীভূত হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমা শক্তির প্রত্যাশাকে পাত্তা না দিয়েই।
এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ ও ডলার সংকট মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা নাজুক সময় পার করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এমনিতেই যুদ্ধ ও সংঘাতময় বিশ্ব রাজনীতির কারণে দেশের আর্থিক খাত চাপের মধ্যে আছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন প্রবাহ কমতির দিকে। এ রকম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সরকার কোন উৎস থেকে উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহ করবে? সর্বশেষ তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে ১২৪ কোটি ডলার কমেছে রপ্তানি আয়। ওই হিসেবে দেশের রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশ। দেশের এই সংকট ঘনীভূত হলে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে অর্থনীতি আরও চাপের মধ্যে পড়বে। তারাও দেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগবে— এমন আশঙ্কাই সমূহ।
বিতর্কিত এ নির্বাচনের কারণে ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেটা হলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। বাংলাদেশ এমনিতেই ডলার সংকট ও বৈদেশিক ঋণের চাপের মধ্যে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন থেকে নেমে ১৭ বিলিয়ন ডলারে চলে এসেছে। এমন অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার যা অর্জন করতে চায় তা কি সম্ভব? সেটা নির্ভর করছে নতুন মন্ত্রিসভার ওপর। কিন্তু সরকার শুরুতে পশ্চিমা শক্তির কাছ থেকে যে কঠোর বার্তা পেল তাকে শুভ সূচনা বলা যায় না। এ অবস্থা ও বাস্তবতায় যে তিনটি সংকটের কথা নতুন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন তা অর্জন সহজ হবে না। সেটা না করতে পারলে চলমান সংকট আরও জটিল ও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।