বাংলাদেশের রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্বে তিনি অলোকসামান্য আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে পথ হেঁটেছেন, আরেকটি পর্বে তাঁর পথপরিক্রমা অন্ধকারের মতোই অস্বচ্ছ, কূল-কিনারাহীন।
Published : 11 Jun 2023, 06:19 PM
কীর্তি ও কৃতিতে তো অবশ্যই তুলনীয় নন। কিন্তু, রাজনৈতিক পরিণতির প্রশ্নে কোথাও কি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলেন সিরাজুল আলম খান? সচেতনে বা অবচেতন মনে? অন্তত দু'জনই যে রহস্যাবৃত রাজনৈতিক পরিণতি ভোগ করেছেন, তাতে এই ধাঁধাটা উত্তরপ্রজন্মের কারও মধ্যে শৃঙ্খলিত হওয়াটা অস্বাভাবিক বা অভ্রান্ত কিছু নয়।
সুভাষ বসু নরমপন্থায় বিশ্বাস করতেন না। তাই গান্ধীর পথ পরিহার করেছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে যুদ্ধকেই একমাত্র পন্থা মনে করেছেন। সিরাজুল আলম খানও নরমপন্থী ছিলেন না। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনিও যুদ্ধকেই শ্রেষ্ঠ ফয়সালা মান্য করেছিলেন। অসহযোগ বা স্বায়ত্তশাসন নয়, উভয়েই চেয়েছিলেন স্বাধীনতা।
সুভাষ বসু, এক অর্থে, যুদ্ধরত থেকেই, বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। বীরের বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তাঁর হলো না। তাঁর একাকী মহানিষ্ক্রমণ এবং স্বদেশত্যাগ তাই আজও অনেকের কাছেই একটা বিহ্বল অধ্যায়। সিরাজুল আলম খান দেশ ছেড়েছিলেন আরও অনেকের সঙ্গে, যুদ্ধে যাবেন তাই। যুদ্ধে লড়েছেন। বীরবেশেই ফিরেছেন যুদ্ধের ময়দান থেকে। তারপর, এক ঘটনঅঘটনপটিয়সী অস্থির ও উত্থিত-পতিত সময়ের সাক্ষী হয়েছেন।
সুভাষ বসু কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গড়ে তুললেন লেফট-সেন্ট্রিক পার্টি ফরোয়ার্ড ব্লক। সিরাজুল আলম খান আওয়ামী বৃত্তের বাইরে গিয়ে কুশীলব হয়ে উঠলেন দেশ স্বাধীনের মাত্র দশ মাসের মধ্যে গঠিত লেফট-সেন্ট্রিক আপাত 'লিবারেল ডেমোক্রেটিক' এক পার্টির— জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। ফলে, উভয়ের পলিটিক্যাল জার্নির মধ্যে একটা কাকতালীয় মিল লক্ষ করা যাবে বৈকি!
তবে, বৈঠকের বাহাসে এ কথাও প্রাসঙ্গিক যে, ঠিক সুভাষ বসুর পরিণত সিরাজুল আলম খানের হয়নি। সুভাষের শেষযাত্রা আদতে বিতর্কিত রহস্যাবৃত হলেও, তা অন্তর্ধান হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে বহু বছর ধরেই। সিরাজের শেষযাত্রা নয়, বরং রাজনীতির উত্তুঙ্গ অবস্থান থেকে তাঁর রাজনৈতিক সন্ন্যাস গ্রহণের প্রক্রিয়াটিই মুখ্যত রহস্যাবৃত। তবে, দিন শেষে এ কথাটিও সত্য যে, উভয়েই রাজনৈতিক জীবনের চরম সক্রিয়তার কালে একটা প্রজন্মকে বিপ্লব অন্তঃপ্রাণ ও আগুয়ান করার আইডলে পরিণত হয়েছিলেন।
এ বাবদ, সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে আসলেই কোন রহস্য বা জটিল সমীকরণ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস লিখতে হলে, ষাটের দশক থেকে শুরু করে, অন্তত পরবর্তী পনের বছরের (১৯৬১-১৯৭৫) ছাত্র রাজনীতি তথা রাজনীতিতে সিরাজের অবিশ্বাস্য সাংগঠনিক দক্ষতা ও সেই অনুপাতে দক্ষ-দাপুটে কর্মী বাহিনী তৈরির তুল্য কিছু সম্ভবত বাংলাদেশে বিরল। সিরাজুল আলম খান একজন 'কিং মেকার' ছিলেন, এ সত্যটি মেনে নিয়েই তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতি-রণনীতির নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে।
২.
ইতিহাসের বিচার সদাসর্বদা বিলকুল নির্মোহ হবে, এই কমিটমেন্ট অন্তত ইতিহাসের নেই। ইতিহাস অনিবার্যভাবেই তার গতিতে চলবে, কিন্তু নিরপেক্ষ হবে এ সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বরং তাতে জলপ্রবাহের ধারায় নুড়ি-পাথরের মতো এসে যোগ হবে কতকটা মিথ বা পুরাণ, কতকটাবা লিজেন্ডস বা কিংবদন্তি। তাতে কারও বিশ্লেষণে কেউ হয়ে উঠবেন কাল্ট, কারও বিশ্লেষণে কেউ হয়ে উঠবেন হিরো, কেউবা ট্র্যাজিক হিরো, কেউবা এন্টি-হিরো, কেউবা ভিলেন। কিন্তু, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় 'বাধার বিন্ধ্যাচল'টির নাম রাজনৈতিক পন্থা বা মতাদর্শিক অবস্থান।
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দোসর রাজনীতি। রাজনৈতিক পন্থার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক অবস্থান ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে বরাবরই ভূমিকা পালন করে বিধায় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির কলমে ইতিহাস কখনও নির্মোহ-নির্মেদ ফ্যাক্টচুয়াল, কখনওবা অতিরঞ্জিত রোমান্টিক কিংবা অতিআবেগ।
রাজনীতিতে সক্রিয় কাউকে তার সমকাল নায়ক বানায়। নিষ্ক্রিয় কাউকে ইতিহাস ও উত্তর সময় বানিয়ে ফেলে প্রতিনায়ক। এই যে এক ধাঁধার জগৎ সৃষ্টি করতে পারা এবং আমৃত্যু নিষ্ক্রিয় থেকেও প্রাসঙ্গিক রয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে একজনকে ঘিরেই, তিনিই সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশের রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্বে তিনি অলোকসামান্য আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে পথ হেঁটেছেন, আরেকটি পর্বে তাঁর পথপরিক্রমা অন্ধকারের মতোই অস্বচ্ছ, কূল-কিনারাহীন।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁকে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন, বলেছেন 'প্রতিনায়ক'; যিনি অনিবার্যভাবেই নায়ক, কিন্তু, খলনায়ক কদাপি নন। আরও বড় নায়ক হওয়ার সমূহ সকল সম্ভাবনাই তাঁর ছিল, কিন্তু তিনি বড় নায়ক হতে পারলেন না, তাঁর চেয়েও বড় নায়ক বা নায়করা ততোধিক শক্তিশালী উপায়ে তাঁকে মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন বিধায়। অতঃপর তিনি প্রস্থান করলেন প্রথাগত রাজনীতির ব্যাটলফিল্ড, চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরাল ও গণপরিসর থেকে আর রেখে গেলেন অজস্র-অসংখ্য না-জানা ইতিহাসের খতিয়ান। এমন অদ্ভুতুরে কেমোফ্লেজিং চরিত্রগুলোর প্রতি সহজ-স্বাভাবিক এক মোহ আছে রাজনৈতিক জনজীবনে। সুভাষের মতো তা-ই, সিরাজও ইতিহাসের নির্মোহ বিচারে হয়ে গেছেন একজন 'লোকনায়ক', ফোকহিরো!
৩.
একাডেমিকভাবে ছিলেন গণিতের শিক্ষার্থী। কিন্তু প্রখ্যাত হয়ে গেলেন রাজনীতির নানা জটিল সমীকরণ আপাত সরলভাবে (নাকি ততোধিক জটিলতায়?) মেলানোর অভ্যস্ততায়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বহুর্বিদ্যক বা আন্তর্বিদ্যক ভূমিকা একাডেমিকভাবেই পালন করার কথা, সেটা তিনি করলেন ব্যক্তিক পর্যায়ে কিংবা বলা যেতে পারে রাজনীতির আঙ্গিনায়। ফলে, গণিতের সনদধারী স্নাতক হয়েও, তাঁর জ্ঞানের জগৎ বিস্তৃত হলো সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পরিবেশ বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত প্রভৃতি জ্ঞানের নানান শাখায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এমন বহুর্বিদ্যক বা মাল্টিডিসিপ্লিনারিই তো হওয়া দরকার।
লব্ধ এই জ্ঞানের প্রজ্ঞা ও প্রাজ্ঞতাতেই তিনি তাঁর সমসাময়িক তরুণদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন গন্তব্যপুরুষ, আইডল এবং সেই আলো, যেখানে সমস্ত অনুসারীরা 'পতঙ্গে'র মতো এসে মিলেছেন মহাসমারোহে। কেন মিলেছেন? কোন জাদুর কাঠির পরশে? কোন মোহে? ঠিক কী বিদ্যায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন এমন 'হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'? আর হলেইবা কেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠগ্রহণকারী প্রজন্মকে এতো উন্মাতাল হয়ে ছুটতে হবে তাঁর দিকে?
মনে রাখতে হবে, আমরা সেই সময়ের কথা বলছি, যে সময়টায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত তার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রথিতযশা প্রজ্ঞাবান, শিক্ষার্থীরা পরিপক্কতায় প্রাচুর্যময়। এই শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাস-পরীক্ষায় দুর্দান্ত নয়, সহপাঠ্যসূচি (কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি) সংশ্লিষ্টতাতে দুর্দমনীয়। তাদের বদান্যেই রাজনীতিই হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় কো-কারিকুরাল কর্মসূচি। এর কারণ, সময় এবং ইতিহাসের নতুন দিকবলয়কে আলিঙ্গন করার আহবান।
সময় তার ছাত্রনায়কদের তৈরি করতে লাগল একের পর। একদিকে ছাত্রলীগ, আরেকদিকে ছাত্র ইউনিয়ন। একপক্ষ জাতীয় মুক্তির স্বপ্নে বিভোর, আরেকপক্ষ শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নে জাগ্রত। ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে যাচ্ছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি— মেনন ও মতিয়া গ্রুপ— উভয় গ্রুপেরই স্বপ্নে অটুট সমাজতন্ত্র। অন্যদিকে, ছাত্রলীগের মধ্যেও সমাজতন্ত্র-মনষ্ক একটি অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশ বিকশিত হতে লাগল, যাদের আলটিমেট লক্ষ্য হিসেবে পরে প্রকাশিত হবে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র'। এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ২০-২২ বছর বয়সী স্বপ্নালু তরুণদেরই শিরোমণির নাম— সিরাজুল আলম খান, তাদের প্রিয় দাদাভাই।
বেঙ্গল ইন্টিলিজেন্সিয়ার একটি সংক্ষুব্ধ সম্মোহনী ক্ষমতা আছে, সেটা আমরা ঊনিশ শতকে দেখেছি। জ্ঞানজগতে আলো ছড়ানো যে কারও পক্ষেই কোনো এক মোহনমন্ত্রের চালিকাশক্তিতে তার সময় ও সমরকে যূধবদ্ধ করে একটা প্রজন্মকে সেই আলোতে আলোকিত করার অপূর্ব ক্ষমতা ঊনিশ শতকে অনেকেরই ছিল, বিশেষত কলকাতা-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিতায় এবং সেটাও ছিল এক সাংগঠনিক বলয়কে কেন্দ্র করে। ঢাকা-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিতায় ঊনিশ শতকে এ ব্যাপারটি প্রায় বিরল। বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে এটি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ঘটতে দেখব। আরও পরে পরিষ্কার করে দেখব, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে এই ইন্টিলেজেন্সিয়া এবং তাঁকে কেন্দ্র করে যাঁরা গড়ে উঠেছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে আলো ছড়িয়েছেন। সিরাজুল আলম খানের রূপে ঊনিশ শতকের বাংলার ওরকম ইন্টেলেক্ট অরগাইনাইজার তৎকালীন পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশে আবার একজন ফিরে এসেছিলেন বিশ শতকের তৃতীয় ভাগে। যেমন বুদ্ধিবৃত্তি, তেমনই বিদ্যাবৃত্তি। এমন লোকই তো আসলে কম বাংলাদেশে; ফলে, রাজনৈতিকভাবে বড় সংগঠক হওয়ার সমস্ত পথে তিনি পথিক সৃষ্টি করতে বিপুলভাবে সমর্থ হয়েছিলেন।
তাঁর হাত ধরেই পরবর্তী বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকের জন্ম। অনেকে বড় বড় পদে অভিষিক্ত হয়েছেন, ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছেন। অথচ, তিনি কিন্তু কোথাও নেই! সাংসারিক, জাগতিক, রাজনৈতিক কোন মোহ ও মায়াতেই তিনি নিজেকে জড়াননি। অথচ, তাঁর অনুসারীরা বলতে গেলে বাংলাদেশে আপাত সাফল্যের সঙ্গেই পলিটিক্যাল ও ইন্টেলেকচুয়াল ক্যারিয়ার গড়েছেন। বাইরে থেকে তাঁকে বলা হয়েছে 'বিভ্রান্ত বিপ্লবী'। কিন্তু, কোনদিনও তাঁর অনুসারীরা প্রকাশ্যে বলেননি, তিনি তাদের জীবন ও যৌবনের সবচেয়ে সুন্দর-সুকুমার সময়টিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন কিংবা সে সময়টি নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। বরং, তিনি যেমনটা বলেছেন, 'যৌবন বিসর্জন দেওয়া এতো সহজ নয়', ঠিক তাঁর শিষ্যরা তাদের রাজনৈতিক উত্থানের মর্মমূলে তাঁকেই স্মরণ করেছেন সর্বাগ্রে।
৪.
তাঁর রাজনৈতিক উত্থানটাও সাড়া জাগানিয়া বলতে হবে। আজকে যে সিরাজুল আলম খানকে আমরা চিনি, সেই ব্যক্তিটিকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। মহিউদ্দিন আহমেদ তাঁর 'প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান' গ্রন্থে জানিয়েছেন, "আমি শুনেছিলাম, ছাত্ররাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের উত্থান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে। পঞ্চাশের দশকের শেষ এবং ষাটের দশকের শুরুতে আওয়ামী বৃত্তের তরুণদের মধ্যে শেখ মুজিবের পরেই জনপ্রিয়তায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন তুঙ্গে।"
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ১৯৫৭-১৯৬০ সাল মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (সভাপতি: রফিকুল্লাহ চৌধুরী) এবং ১৯৬০-৬৩ সাল মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এই কমিটিতে শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ওই কমিটিতেই প্রথমে সদস্য, পরে ১৯৬১ সালে সহ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সিরাজুল আলম খান। গলায় রক্ত আসায় শেখ মণি অসুস্থ হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে ওই কমিটিতেই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সিরাজ। ১৯৬২ সালের বিখ্যাত শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগকে মূলত এই কমিটিই নেতৃত্ব দিয়েছে।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন হুইপ হয়েছিলেন। তবে, শেষ পর্যন্ত আর আওয়ামী লীগে থাকেননি। শেখ মুজিবের একনিষ্ঠ ভক্ত ও শিষ্য হয়েও, তিনি মুশতাকের মন্ত্রিসভায় ছিলেন। ছিলেন এরশাদ আমলের উপপ্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত শেষ ব্যক্তি যিনি এই পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। আরও পরে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের থিঙ্কট্যাঙ্ক। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে শাহ মোয়াজ্জেম জাঁদরেল পলিটিশিয়ান ও পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সিরাজুল আলম খানের রাজনীতিতে আসার পেছনে তিনি কী ভূমিকা রেখেছিলেন, সে প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমেদকে তিনি বলেছেন:
"একদিন খবর পেলাম ফজলুল হক হলে নতুন একটা ছেলে এসেছে। সারা দিন তাস খেলে। তার পার্টনার বদল হয়। কিন্তু তার বদল হয় না। কী ব্যাপার? আমার কৌতূহল হলো। তাকে ডেকে পাঠালাম এবং মুহূর্তেই তাকে পছন্দ করে ফেললাম। তাকে রিক্রুট করলাম। এভাবেই সিরাজুল আলম খান আমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হলো। ও ছিল খুব ভালো, হার্ডওয়ার্কিং। দিন-রাত কাজ করত। ...
... তবে ও আমার খুব আস্থাভাজন ছিল। অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারত। আমিই তো ওকে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বানিয়েছিলাম।"
আদতে ছাত্রলীগের ১৯৬৩-৬৫ মেয়াদের যে কমিটিতে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন, সেবার তাঁর হবার কথা সাংগঠনিক সম্পাদক। শেখ মণি সভাপতি, কেএম ওবায়দুর রহমান সাধারণ সম্পাদক। এমনটাই নির্দেশ ছিল শেখ মুজিবের, জানিয়েছেন সিরাজ নিজেই। কিন্তু, কমিটি যখন পাশ হলো, দেখা গেল, ওবায়দুর রহমান সভাপতি, সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক। শেখ মণি মূল নেতৃত্বে নেই। অসুস্থতাও এ না থাকার পেছনে কারণ হতে পারে। এর আগে থেকেই অবশ্য ছাত্রলীগে দুই বন্ধুর দু'টি ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে—সিরাজ গ্রুপ ও মণি গ্রুপ। কিন্তু, শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের ধারাটি তখন সিরাজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কাছে প্রায় ম্লান। সেই অগ্নিসময়ের অনেকেই নানান সময় বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিসংবাদিত নেতা মান্য করে চলা ছাত্রলীগের উভয় ধারার দুই নেতার মধ্যে সিরাজ তাঁর নেতৃত্বগুণ ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে আস্থাশীল সংগঠক ও 'ডানহাত' ছিলেন।
আরও পরে, আমরা দেখব, সত্তরের ঘটনাবহুল নির্বাচন ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ডাকসুর ভিপি আসম আব্দুর রব, জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং ছাত্রলীগের সভাপতি নূর আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এই চারজনের সম্বলিত বিখ্যাত পরিচয় হয়ে উঠেছিল 'বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা' নামে। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে এক থাকলেও, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের দু'টি ধারারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মাখন-সিদ্দিকী শেখ মণির নেতৃত্বাধীন ধারা এবং রব-সিরাজ সিরাজুল আলম খানের ধারার অনুসারী হিসেবে ছাত্রলীগের মধ্যে ক্রিয়াশীল থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
৫.
সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরা ১৯৬২-১৯৭২, এই এক দশকে এমন অনেক কিছুই করেছেন তাঁর নেতৃত্বে, যা ছিল অভূতপূর্ব। কিন্তু, দেখা যাবে, সিরাজ মূল নেতৃত্বে না থেকেও কিংবা আড়ালে-আবডালে থেকেও, আদতে তিনিই কাণ্ডারি, তিনিই এদের গন্তব্যপুরুষ। সেই যে তিনি টানা দু' মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা পালন করলেন, এটাই তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের ভূমিকায় সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ পদ। এর পরে আর কোনদিন কোথাও তিনি কোনো পদাধিকারের বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেননি। বরং, খুব গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, তাঁর অনেক বেশি মনোযোগের কেন্দ্রে তখন 'নিউক্লিয়াস'। জীববিজ্ঞানের নিউক্লিয়াস নয়, 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিউক্লিয়াস'! গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্তাতল, একাধারে জীববিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক, কী করে যেন একবিন্দুতে মিলে যান তৎকালীন পূর্ববাংলার এক ছাত্ররাজনৈতিক প্রকল্পে!
সিরাজুল আলম খান ১৯৬২ সালে আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরেই গোপনে গড়ে তুলেছিলেন এই রহস্যজনক গ্রুপ। এ বিষয়ে সে সময়ের অনেকেই কিছুই জানেন না বা জানতেন না বলে মত দেন। কারণটাও যুক্তিযুক্ত। গোপন যা, তা সম্বন্ধে জানার প্রশ্ন তো অবান্তর। এমনকি বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত এ বিষয়ে একদমই কিছু জানতেন না। আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্য মতে, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুটা ১৯৬৬ সালে এবং পুরোটা ১৯৬৯ সালে জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। এ নামটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ছাত্রলীগের একপক্ষের সম্মেলনের রাজনৈতিক রিপোর্টে।
নিউক্লিয়াস গোপনই ছিল, কিন্তু, নিজেদের অজান্তেই ছাত্রলীগের জেলা নেতৃত্বের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকরা রিক্রুট হয়ে যেতেন নিউক্লিয়াসে, কিংবা বলা ভালো, নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের যে ধারাটি শক্তিশালী হচ্ছিল, সে ধারায়। পরে দেখা যাবে, সারা বাংলাদেশে এর সদস্যসংখ্যা হয়ে গেল প্রায় সাত হাজার।
সেই তুমুল সময়ে ছাত্রলীগের অবদানের প্রসঙ্গ উঠলে, বলা হয়ে থাকে, ষাটের দশকে দুই ছাত্র ইউনিয়নের পাশাপাশি ছাত্রলীগের যে অবদান ছাত্ররাজনীতিতে, তাতে ছাত্রলীগের এ ধারাটিরই 'ব্রেন চাইল্ড' হলো—১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি প্রদান, ৬ ছফা-১১ দফা আন্দোলন, শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ), জয় বাংলা বাহিনী, মুজিব বাহিনী, স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত, জয় বাংলা স্লোগান, আসম আব্দুর রবের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজের স্বাধীনতার ইশতেহার, 'জাতির জনক' উপাধি প্রদান, এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে মুক্তিযুদ্ধ। কিছু তর্কসাপেক্ষ উদ্যোগ বাদ দিলে, দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশক্ষেত্রেই নিউক্লিয়াসের সদস্যরাই এই কাজগুলো করছেন। যাঁরা করছেন, তাঁরা জানেন সিরাজুল আলম খানই এর নেপথ্য-নায়ক, তাঁরা শুধু জানতেন না, কাজটা আসলে যতটা না ছাত্রলীগের মধ্য থেকে হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি হচ্ছে নিউক্লিয়াসের মধ্য থেকে। নিউক্লিয়াস গোপন, প্রকাশ্যে সেটি নাম নিচ্ছে 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ'। আদতেই এরা স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়েই পথ চলছিল এবং তার বিনিময়ে যে কোন কিছু করতে প্রস্তুতও ছিল এই 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ'। সিরাজুল আলম খানের মতে:
“স্বাধীনতার প্রশ্নে নিউক্লিয়াস যে কাজ করেছিল, এ কাজে যদি কেউ হ্যাম্পার করে, নির্মম হতে পারতাম, মারপিট করে, কেউ দাঁড়াতে পারত না। এ রকম একটা শক্তি ছিল। বিশেষ করে, মিছিলগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ওদের স্লোগান ছিল জয় সর্বহারা, আমাদের হলো জয় বাংলা। ওদের হলো শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, আমাদের হলো বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো। একটা হলো ক্ল্যাসিক মুভমেন্ট অব সমাজতন্ত্র, আরেকটা হলো ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট। এগুলো এস্টাবলিশ করতে কত-কী যে করেছি?”
আরও পরে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই গড়ে উঠবে বিএলএফ, যেটিকে সিরাজপন্থীরা বলেন, নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক উইং, যার সামরিক উইং 'জয় বাংলা বাহিনী'। তবে, এতোটা বললে, আদতে ছাত্রলীগের অপর ধারাটির অস্তিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। আসলেই কি তা-ই নয়? বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তিনি নিউক্লিয়াস থেকে সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক এবং অপর ধারাটি থেকে শেখ মণি ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গড়তে বলেছিলেন বিএলএফ।
মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে গিয়ে এটারই নাম হয়েছিল 'মুজিব বাহিনী'। বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর নেতা-কর্মী হিসেবে নিউক্লিয়াসের লোকজন ছিল বলেই, এটি নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক উইং হিসেবে সমাদৃত হবে কি না তা তর্কসাপেক্ষ। শুধু বলা যেতে পারে, সিরাজ ও মণির দু'টি ধারা একত্রে কাজ করলেও, আদতে হেজিমনিটি সিরাজপন্থীদের দখলেই ছিল। পুরোটার দায়িত্ব নিয়ে নিতে চাইলে, মুজিব বাহিনীর কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিন্দিত হওয়ার দায়ও তো পুরোটাই নিউক্লিয়াসকেই নিতে হয়!
৬.
ষাটের দশকের সিরাজুল আলম খান অনিবার্য নন্দিত নায়ক বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে। কিন্তু, স্বাধীন স্বদেশে তাঁর যখন আরও বড় জননায়ক হয়ে ওঠার অতলান্ত সম্ভাবনা, তখন তিনি ভূমিকা নিলেন প্রতিনায়কের। পট-পরিবর্তনের রাজনৈতিক খেলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন স্বদেশ নতুন করে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে শুরু করার কথা ছিল। এ রাষ্ট্রটি হয়ে উঠবে সমাজতান্ত্রিক, আকাঙ্ক্ষাটি এমনই ছিল। ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্র-মনস্ক ধারাটি আরও মরিয়া হয়ে উঠল তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে প্রণীত হলো ১৫ দফা। এসবের মধ্যে ছিল: ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থা, জাতীয় সরকার, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, প্রদেশভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন, নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা পরিষদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা, উভয় কক্ষের সম্বনয়ে সংসদীয় কমিটি, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল, সাংবিধানিক আদালত, জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল, স্থায়ী বিচার বিভাগ কাউন্সিল, দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ইত্যাদি। স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার এসব দাবি তেমন আমলে আনলেন না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতম শিষ্যের দূরত্ব বাড়তে লাগল প্রতিনিয়ত।
আরও পরে, এই দূরত্ব এক আদর্শিক আকাশচুম্বি দূরত্বে পরিণত হয়ে উঠল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যাওবা ছাত্রলীগের দু'টি ধারা মিলেঝিলে ছিল, মাত্র ৭ মাসের মাথায়, ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের দুই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ভাঙন প্রকাশ্যে চলে এলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উভয় পক্ষেরই সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি। তিনি শেখ মণির অনুসারী 'মুজিববাদী' ছাত্রলীগের সম্মেলনে গেলেন, পল্টনে নিমজ্জিত হলো 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী' সিরাজের অনুসারী ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ভাঙন চূড়ান্ত রূপ নিয়ে নিল অক্টোবরে, যুবলীগ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়, শেখ মণি ও মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হলো যুবলীগ, ১১ নভেম্বর ১৯৭২। এর আগেই ঘটনা পরিক্রমা বুঝতে পেরেই সম্ভবত, ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২ সালে সদলবলে বঙ্গবন্ধুর পথ ছেড়ে সিরাজুল আলম খান নেপথ্যে থেকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' কায়েমের ঘোষণা দিয়ে গড়ে তুললেন নতুন রাজনৈতিক দল-- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), মুখপত্রের নাম ‘গণকণ্ঠ’। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রতিষ্ঠিত বিরোধী দল, যারা সবাই এক সময় বঙ্গবন্ধুকেই তাঁদের আলটিমেট লিডার বলে মান্য করতেন।
সমাজতন্ত্র নিজেই এক বৈজ্ঞানিক ধারণা। তার সঙ্গে জাসদকে লাগাতে হলো 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র'। 'জাতীয় সমাজতন্ত্র' মূলত হিটলারের মতাদর্শ, যেটি পরে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জাসদের নামকরণে সেটিও আদর্শ হিসেবে থাকল। এসব নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর মতো প্রজ্ঞাবান নেতার তো ১৯৬৬ সালেই বুঝে ফেলার কথা যে, ছাত্রলীগে সিরাজরা সমাজতান্ত্রিক নতুন রাষ্ট্রই গড়তে চাইছেন, আওয়ামী লীগকেও সে পথেই নিয়ে যেতে চাইছেন। এতে তাঁর সায়ও ছিল। কথাটা আমরা সিরাজুল আলম খানের মুখেই শুনি। 'প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান' গ্রন্থে তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন:
"এ রকম আরও কয়েকবার গাড়িতে উনি আমাকে হলে নামিয়ে দিতেন। আমি তখন এস এম হলে থাকি। একদিন বললাম, মুজিব ভাই আমার একটা ইচ্ছা আছে, আওয়ামী লীগকে...
বল, বল?
গাড়িতে আমি সাধারণত সামনে বসতাম। উনি পেছনে, গাড়ি থামিয়ে বললেন, তুই পেছনে আয় তো? তারপর গাড়ি যাচ্ছে আবার। বললাম, আওয়ামী লীগকে ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির মতো করলে কেমন হয়? লেবার পার্টি সম্পর্কে আমার যে ভালো ধারণা আছে, তা-ও না। কিছু একটা ধারণা ছিল। যে, এটা মানুষের উপকার করে, শ্রমিকশ্রেণির। বললেন, খুব ভালো, করতে পারবি? কর। কোনো অসুবিধা নাই। উনি আমাদের নিউক্লিয়াসের কোনো কিছু ঘুণাক্ষরেও জানেন না।
এই কথা হলো নারায়ণগঞ্জের মিটিংয়ের আগের দিন। তারপর তো উনি জেলে চলে গেলেন।"
শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নয়, সিরাজের জনপ্রিয়তা ছিল শ্রমিকদের মাঝেও। গোপনে তিনি শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজটিও এগিয়ে নিচ্ছিলেন। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ঐক্য গড়ে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রটি গভীরভাবে বোপন করে দেয়ার এ প্রকল্পটি খুব দারুণভাবে কাজে দিয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। খুব স্বভাবতই সিরাজুল আলম খানরা সেদিকেই স্বাধীন রাষ্ট্র ও পার্টিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যখন দেখলেন, আর সম্ভব না, তখন নতুন পথ ধরলেন। আন্তঃপার্টি সংগ্রামের চেয়ে সরাসরিই নিজেদের বানানো কাল্ট ফিগারকে প্রশ্ন করাটা, তাঁর বিরোধিতা করাটাকে সহজ মনে করলেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থীও দিল সদ্যগঠিত জাসদ। কী দুর্দমনীয় সাহস! এই সাহসই তো সে সময় জাসদের উত্থানকে আরও তীব্রবেগে তরান্বিত করেছে। তারপর গড়ে তুলেছে জাসদের গণবাহিনী। একদম টিপিক্যাল র্যাডিক্যাল লাইন।
এরপর, ঘটনা পরিক্রমায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের সেই রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি। সিরাজুল আলম খান তাঁর আগেই ভারত গেছেন। কিন্তু, তাঁর পার্টিকে যথেষ্টই দায় দেয়া হয় নতুন রাষ্ট্রটিকে উত্তাল করার পেছনে। তবে, খোলা চোখে তাকালে, সরকারি দলকে চ্যালেঞ্জ করাটাই তো বিরোধী দলের কাজ। জাসদ সেটাই করেছে। অগাস্ট ট্র্যাজেডির পর ধেয়ে এলো নভেম্বর। ৩ নভেম্বর জেল হত্যা ও ৭ নভেম্বরের সিপাহীদের বিদ্রোহ। জাসদের কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উত্থান-স্বপ্ন মুহূর্তেই নানা সমীকরণ মেলাতে না পেরে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। রাষ্ট্র ক্ষমতার পালাবদল বিপুলভাবে বদলে গেল। রাষ্ট্র নাগরিক রাজনীতিকদের হাত থেকে চলে গেল সামরিকবাহিনীর হাতে। এর সমস্ত দায় একবাক্যে দেয়া হয় জাসদকে এবং নেপথ্য পুরুষ হিসেবে সিরাজুল আলম খানকে। আর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ইন্টারপ্রিটেশনে তিনি হয়ে পড়েন তখন নিন্দিত পুরুষ কিংবা প্রতিবিপ্লবী। অথচ, এই 'প্রতিবিপ্লব' ঘটানোর জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে যে বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ তৈরি হচ্ছিল, সে বিষয়ে তখনকার রাষ্ট্রনেতাদের ভূমিকাকে তলিয়ে দেখার অবকাশ আমরা বলতে গেলে নেইনি। শুধুই 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' দিয়ে বুঝতে চেয়েছি ঘটনা পরম্পরাকে এবং সেই তত্ত্বের আলোকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছি বিপুল ক্যারিশম্যাটিক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অসামান্য সংগঠক সিরাজুল আলম খানকে।
৭.
সিরাজুল আলম খানের অন্তরালে চলে যাওয়াটা মূলত তাঁর গুরু বঙ্গবন্ধুর চিরপ্রস্থানের পরপরই আরও বেশি ত্বরান্বিত হয়ে উঠল। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই মাটির সবচেয়ে জনপ্রিয় জননায়ক, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের চূড়ান্ত সিংহশিখরে তিনি তখন। সে সময়ই সিরাজুল আলম খান বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে যে রাজনৈতিক পরিভ্রমণ তিনি শুরু করেছিলেন, এক দশকের মাথায় তিনি তাঁর উত্তু্ঙ্গ অবস্থার চূড়ান্ত পরীক্ষা নিতে নিজেই যেন নিজের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। এতো অল্প বয়সে এ বড় কঠিন এক সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর। কিন্তু, ওই যে সাহসটা তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন, তেমনই পেয়েছিলেন তাঁর অনুসারী একঝাঁক বিপ্লব অন্তঃপ্রাণ তরুণের কাছেও। কিন্তু, গুরু-শিষ্যের সে দূরত্ব বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দু'জনকেই নিশ্চিহ্ন করে দিল, দুঃখজনকভাবে। বঙ্গবন্ধুর করুণ পরিণতি বাংলাদেশকে ডানের দিকে নিয়ে গেল। অন্যদিকে, আরও র্যাডিক্যাল সিরাজের পরিণতি রাজনীতির অন্তিম যাত্রায় নিঃশেষিত হলো।
এই নিঃশেষ হওয়াটাতেও তাও কিছুটা প্রলেপ পড়ত, যদি ধূমকেতুর মতো আস্ফালন করে আবির্ভূত হওয়া তারুণ্যের সাহসী-সৌম্য জাসদ রাজনীতির ময়দানে সেই গৌরব ধরে রাখতে পারত। সেই জাসদ 'চিরতরে' হারিয়ে গেল! রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু না থাকলেও, সেই হারানো গৌরব জাসদ আর কখনও ফিরে পাবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। পরে, জাসদ ভেঙে বাসদ (বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল) হয়েছে। সেই জাসদ ও বাসদও কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। জাসদের অনেকেই ক্ষমতাবানের সঙ্গে আপোষও করেছেন। তিনি জীবদ্দশাতেই এসব খাণ্ডবদাহন দেখে গেছেন। কিন্তু বরাবরের মতোই তিনি নিশ্চুপ ও নির্বিকার। হায় রাজনীতি, এক জীবনে কখনবা কী সুন্দর, কখনওবা কী নিষ্ঠুর!
তবুও আমরা জানি, মানুষ ঘুমালেও তার রাজনীতি কখনও ঘুমায় না। সিরাজুল আলম খান চিরঘুমে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর রাজনীতির কর্তৃ-মন ও কৃতি-মস্তিষ্কের চিরঘুম বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তত সম্ভব না। ব্যক্তি ও মতাদর্শভেদে ইন্টারপ্রেটেনশন ভিন্ন হতে পারে, তবে বাংলাদেশের জন্মগল্পে তিনি প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন।