Published : 04 Jul 2023, 03:30 PM
শিশুদের সাঁতার শেখাতে কাজ করবেন একদল নারী প্রশিক্ষক। কয়েক মাসের এই প্রশিক্ষণে প্রায় প্রতিদিনই নামতে হবে পুকুরে। কিন্তু প্রজনন বয়সী এই নারীদের প্রত্যেকেরই তো মাসিক হবে। কাপড় বা স্যানিটারি প্যাড যাই ব্যবহার করুন, তাতে পুকুরের পানিতে নামা আর সম্ভব হবে না। ফলে প্রতি মাসেই নারী প্রশিক্ষকদের কয়েক দিন করে অনুপস্থিত থাকতে হবে।
এই অনুপস্থিতি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছিল প্রকল্পে। মাসিকের দিনেও যেন সাঁতার প্রশিক্ষণের কাজে অনুপস্থিতির হার না বাড়ে, সেজন্য প্রত্যন্ত এলাকার ৮২ নারীকে মেন্সট্রুয়াল কাপের সঙ্গে পরিচয় করাল সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ-সিআইপিআরবি।
’ভাসা’ সাঁতার প্রকল্পে নারীদের মেন্সট্রুয়াল কাপ প্রশিক্ষণ যোগ করার প্রস্তাবটি রাখেন নাহিদ দিপা, যিনি সিআইপিআরবির কমিউনিকেশন ম্যানেজার ।
”আমাদের আসলে শিশুদের সাঁতার শেখানোর কার্যক্রম চলছে ২০১৬ সাল থেকে। প্রকল্পের নাম ভাসা; এর অর্থ পানিতে ভেসে থাকা। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন আমাদের ২০১৭ থেকে ফান্ড দিচ্ছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিপা বলেন, এই প্রকল্পে এ বছর ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী ১০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে তাদের।
”শিশুদের জন্য সিএসআই বা কমিউনিটি সুইমিং ইন্সট্রাকটর যদি ১০০ জন থাকে, তাহলে ৭০ জন নেওয়া হয় নারী। আমরা দেখেছি সাঁতার শেখানোর বিষয়ে নারী প্রশিক্ষকের চাহিদা রয়েছে। মনে করা হয়, নারীরা মনোযোগ দিয়ে ভালো শেখায়।”
কিন্তু মাসিকের দিনে পানিতে নামা নারীর জন্য একটি ’ফিজিক্যাল হ্যাজার্ড’ বলে মন্তব্য করেন নাহিদ দিপা।
তিনি বলেন, “আমরা সাধারণত পুকুরে সাঁতার শেখাই। এসব পুকুরে মাছ চাষ করা হয় না। এসব পুকুরের পানি সবাই খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করে। এসব কারণেও মেয়েরা পানিতে নামতে চায় না।”
একটি দলে যেহেতু অনেক নারী প্রশিক্ষক, মাসিকের কারণে তারা একেকজন তিন-চারদিন করে পানিতে নামছেন না; তাতে প্রতি বছর সাঁতার প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষকের উপস্থিতি শতভাগ হয়ে উঠছিল না এই প্রকল্পে।
”তাদের যেহেতু জোর করে পানিতে নামানোর সুযোগ নেই, তখন কী করা যায় তা নিয়ে ভাবছিলাম”, বলেন নাহিদ দিপা ।
ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার নিয়ে নারীদের সচেতন করতে কাজ করছেন তিনি। এবার কর্মক্ষেত্রেও সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর তাগিদ অনুভব করেন।
”শিশুদের সাঁতার শেখাতে গিয়ে এই নারী প্রশিক্ষকদের চার-পাঁচ ঘণ্টা পানিতে থাকতে হবে একটানা। তখন তারা কীভাবে থাকবে? এরই একটি সমাধান হল মেন্সট্রুয়াল কাপ।”
এই প্রস্তাবে সিআইপিআরবির সঙ্গী হয় মেনিয়েল ডানিয়েল ও রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন।
নাহিদ দিপা বলেন, ”প্রায় দুই বছর ধরে এই প্রস্তাব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছিল। এ বছর আমরা একটি ফান্ড এই কার্যক্রমে বরাদ্দ করতে পারি।”
কিন্তু নারীদের মেন্সট্রুয়াল কাপ পরার বার্তা দেওয়া কি খুব সহজ ছিল?
ভাসা প্রকল্পে ৮২ জন নারী কাজ করছেন বরিশালের পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বরগুনার তালতলী ও বেতাগী এলাকা থেকে।
একজন নতুন সিএসআই পাঁচ দিনের সাধারণ জ্ঞান প্রশিক্ষণ পান। এতে তাদের শিশুদের সাঁতার শেখানোর ২১ কৌশল ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর দুই দিন বরাদ্দ থাকে ফার্স্ট রেসপন্স নিয়ে।
এভাবে হাতেকলমে, কখনও কাগজেকলমে আবার কখনও ভিডিও দিয়ে শেখানো চলে সাত দিনের প্রশিক্ষণে।
এই সাত দিনের মধ্যে এক বেলায় তিন ঘণ্টার একটি সেশন রাখা হয় মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে। ৮২ জন নারীকে সাতটি দলে ভাগ করে মে ও জুন মাসে এই বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় সিআইপিআরবি।
প্রত্যন্ত এলাকার বয়সে তরুণ এই নারীরা কীভাবে মেন্সট্রুয়াল কাপের কথা সহজভাবে নেবেন, তাই ছিল প্রকল্প পরিকল্পনাকারীদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
দিপা বলেন, ”এই নারী সিএসআই যারা, তারা বেশিরভাগই সদ্য এসএসসি পাস করা, অথবা কলেজে পড়ে বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এমন বয়সী। ১৬ থেকে শুরু করে ২২ পর্যন্ত বয়সের; খুব কম আছে যাদের বয়স ৩০ বা এর কাছাকাছি।
”আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নারীর প্রজননতন্ত্র কেমন হয়, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নারীর নিজেরই থাকে না।”
মেন্সট্রুয়াল হাইজিন কর্মশালার প্রধান প্রশিক্ষক নাহিদ দিপা বলেন, তারা এমনভাবে প্রশিক্ষণটা পরিকল্পনা করলেন, যাতে মেন্সট্রুয়াল কাপের কথা একদম শেষে আনা হল।
”আগে রাখা হল প্রজননতন্ত্র নিয়ে ধারণা, মাসিক কীভাবে হয়, কেন হয়, মাসিক নিয়ে আমাদের একটা অস্বস্তি-রাখঢাক ভাব আছে সেসব কীভাবে ওভারকাম করা যায়।”
প্রশিক্ষণের শুরুতে নারীদের মনে ভয় ছিল; অনেক প্রশ্নও ছিল। কাপ কীভাবে পরিষ্কার করতে হবে; শরীরে কোনো সমস্যা হবে কি না।
”ভয় ভাঙ্গার জন্য অনেক রকম ভিডিও, কয়েকজনের সাক্ষাৎকার, যারা মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করেছে, যারা সাঁতারু বা যাদের অনেকক্ষণ পানিতে থাকতে হয়, তাদের অনেকের কথাবার্তা নিয়ে সেশন সাজানো হয়”, বললেন নাহিদ দিপা।
”মাসিকের রাস্তাটা যে আলাদা, এটা বেশিরভাগ মেয়েরাই জানে না। সবাই মনে করে যে রাস্তা দিয়ে ইউরিন পাস হয় সেখান দিয়েই মাসিক হয় – এসব মিথও ভাঙা হয় প্রশিক্ষণে।”
তবে প্রশিক্ষণে বলা ছিল, কাপ না পরলেও এই নারীরা সিএসআই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এরপরও মেন্সট্রুয়াল কাপে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া ছিল এই নারীদের।
নাহিদ দিপার ভাষ্যে, ”তারা একদম প্রত্যন্ত এলাকায় থাকে, সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই কিন্তু এই নারীরা সাহসী। দেখা গেল এই প্রান্তিক নারীরা খুবই এনার্জেটিক। এবং তারা মোটিভেটেড হয়। অনেকেই বলেছে ‘আমরা চেষ্টা করে দেখতে চাই’।”
প্রশিক্ষণ পেয়ে ৮১ জন নারী মেন্সট্রুয়াল কাপ নিতে এগিয়ে আসেন।
”মাত্র একজন কাপ নেননি। কারণ ওই নারী কিছুদিন আগে পিরিয়ড বন্ধ রাখার ইনজেকশন নিয়েছেন। আগামী এক বছর তার মাসিক হবে না।”
প্রশিক্ষণ শেষে একজন সিএসআই কাপ পরতে চান। তার তখন পিরিয়ড চলছে।
বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলা ও থানার সেই তরুণী হলেন রেশমা আক্তার।
তিনি বলেন, “মাসিক হলে স্যানিটারি প্যাড পরে কারও তো পুকুরে নামা হত না। আগে কখনও ধারণাও করিনি এমন হতে পারে।”
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রেশমা আক্তার এমনিতে সাঁতার জানলেও এবারই প্রথম সিএসআই হয়েছেন।
’সাহস করে’ কাপ পরার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ”আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করছিল কেমন লাগছে...?
”আমি যে কাপ পরে আছি এমন আলাদা কোনো অনুভব হয়নি। আমাদের খুব ভালো করে শেখানো হয়েছিল।”
প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক নারী সিএসআই একটি করে কাপ পায়। এর সঙ্গে দেওয়া হয় বাংলায় লেখা কাপ ব্যবহারের নির্দেশিকা।
একটি ব্যাগ বা থলে দেওয়া হয় কাপ সংরক্ষণ করার জন্য। একটি হাঁড়ি দেওয়া হয়; যেন মাসে দুই বার পিরিয়ডের আগে ও পরে কিছুটা ফুটন্ত গরম পানিতে এই কাপ স্টেরিলাইজ বা জীবাণুমুক্ত করা যায়।
মেন্সট্রুয়াল কাপ কী আর কেমন, তা আগে কখনো শোনেননি, কখনো দেখেননি ২৪ বছর বয়সী আকলিমা।
বাচ্চাদের সাঁতার শেখার প্রকল্পে ২০১৮ সালেও কাজ করেছেন পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার এই তরুণী। তখন চার থেকে পাঁচ মাস সাঁতার শিখিয়েছেন শিশুদের। কিন্তু মাসিকের দিনে অন্তত তিন দিন করে পানিতে নামা হত না তার।
সিআইপিআরবি থেকে প্রশিক্ষণ তাকে কাপে আগ্রহী করে তোলে। এরপর জুনে বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতে মাসিকের দিনেও পুকুরে নেমে যান মেন্সট্রুয়াল কাপ পরেই।
ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আকলিমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিদিন তো দেড়-দুই ঘণ্টা পুকুরে থাকতে হয়। ২৫ জন বাচ্চাকে সাঁতার শেখানো চলে। আগে তো স্যানিটারি প্যাড পরেছি। কাপ নিয়ে শুরুতে ভয় ছিল কীভাবে টয়লেট হবে। দেখলাম কোনো সমস্যা হল না।
”তারপর ভাবলাম তাহলে সাহস করে পানিতে নেমে যাই। এবার পিরিয়ডের প্রথম দিনই কাপ পরি। তিন দিন পরেছি। কখনও চার ঘণ্টা পর কাপ বদল করেছি। কখনও আট ঘণ্টা পর কাপ বদল করেছি। কাপ পরে পানিতে থাকাতে কোনো সমস্যা হয়নি।”
মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করার পর সাঁতার প্রশিক্ষক নারীদের মাসিকের সময় অনুপস্থিতির হার কী কমে আসছে? এ প্রশ্নে একটি হিসাব তুলে ধরলেন সিআইপিআরবির কর্মকর্তা নাহিদ দিপা।
একেক মাসে ২৪টি পাঠদান, এভাবে ৮২ জনের চার মাসে মোট কর্মদিবস হচ্ছে সাত হাজার আটশ ৭২ দিন। যদি প্রতি মাসে প্রত্যেক নারী দুই দিন করে প্রশিক্ষণে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ৬৫৬ দিন হয় মোট অনুপস্থিতি। যদি তিন দিন করে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে ৯৮৪ দিন এই নারীদের কাজে পাওয়া যাবে না।
জ্বর, মাথাব্যথা এমন অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিতি এখানে হিসাব করা হয়নি। শুধুমাত্র মাসিক হলে পানিতে নামা সম্ভব হচ্ছে না বলে যে অনুপস্থিতি, তাই হিসাবে দেখা হয়েছে।
সিআইপিআরবির ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ ডিভিশনের পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, জুন-জুলাই থেকে মধ্য অক্টোবর অথবা নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত পাঁচ-ছয় মাসই সাঁতার শেখানোর মৌসুম। একজন নারীর জন্য চারদিন করে ভাবলে সাঁতার মৌসুমের ছয় মাসে ২৪ দিন মাসিকের কারণে অনুপস্থিতি হয়ে যায়।
”এভাবে ৭০ জন নারীর জন্য ১৬৮০ কর্মদিবস হারাচ্ছি আমরা; এই সময়ে আরও অন্তত ১২০ জন বাচ্চাকে সাঁতার শেখানো যেত।”
তিনি বলেন, ”যখন মাসিক হয়, তখন ওই নারীর স্বাস্থ্যগত কারণে আমরা তাকে পানিতে নামা থেকে বিরত থাকতে বলি। অনেক সময় ডাঙ্গা থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং একজন সহকারী থাকেন। কিন্তু সাঁতার শেখানোর কাজটাতো আসলে হাতেকলমেই দেখাতে হবে।”
মেন্সট্রুয়াল কাপ পরার কারণে এ ধরনের অনুপস্থিতি কমে আসবে এমন প্রত্যাশা জানিয়ে নাহিদ দিপা বলেন, ”শিশুদের সাঁতার শেখানোর প্রশিক্ষণ চলবে অক্টোবর পর্যন্ত। মোটামুটি সিএসআই নারীরা তিন-চার মাস কাপ পরতে পারছে এই সময়ের মধ্যে। এরপরই আমরা একটা আপডেটেড রেজাল্ট পাব।”