প্রথম দফায় ৮ মে রাঙামাটি সদর, কাউখালী, বরকল ও জুরাছড়ি উপজেলায় ভোট হবে।
Published : 06 May 2024, 02:12 PM
কোথাও প্রবল প্রতিপক্ষ, কোথাও নিয়ম রক্ষার প্রার্থী আর কোথাও সমঝোতায় ছাড়ে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রাঙামাটিতে নিজেদের অর্জন নিয়ে বেশ শঙ্কাতেই আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে পাঁচটিতে চেয়ারম্যান পদে ‘একক প্রার্থী’ রয়েছে আওয়ামী লীগের। বাকিগুলোতে একাধিক দলীয় নেতা প্রার্থী হয়েছেন। ফলে দলীয় কোন্দলও সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে।
ক্ষমতাসীন দলটির তৃণমূল নেতাদের মত, দলীয় এই বিভেদের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো সুবিধা পেতে পারে। বিগত নির্বাচনে পাঁচটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতারা চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছিলেন। এবার সেটা কমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রথম দফায় রাঙামাটির সদর, কাউখালী, বরকল ও জুরাছড়ি উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত দুইটি উপজেলায় এগিয়ে রয়েছে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস-সন্তু লারমা) সমর্থিত প্রার্থী।
সদর উপজেলায় দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান মহসিন শেষ বেলায় প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এখন মাঠে রয়েছেন দলের আরও দুই প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাজাহান।
তাদের সঙ্গে লড়ছেন তিন স্বতন্ত্র প্রার্থী সুফিয়া কামাল ঝিমি, পঞ্চানন ভট্টাচার্য এবং অন্নসাধন চাকমা। এদের মধ্যে প্রভাবশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস সমর্থিত অন্নসাধন চাকমা বেশ শক্তশালী প্রার্থী।
ভোটারদের ধারণা, সদরে অন্নসাধন চাকমা, বিপ্লব চাকমা ও শাহজাহানের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই বেশ জমজমাটই হবে। জিততে পারেন যে কেউই।
জয়ের আশা করছেন জানিয়ে পৌর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক তারাবুনিয়া মৌজার হেডম্যান অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা বলেন, “এখানকার নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা নানাভাবে ভূমিকা ফেলে। তবে আমি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মী।
“সে হিসেবে সব দল-মত-জাতির মানুষ আমাকে বেছে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমাকে পাহাড়ি-বাঙালি সবাই ভোট দেবেন এবং জয়ের ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী।”
জয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী আরেক প্রার্থী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহানও। তিনি বলছেন, “আমার বিশ্বাস জনগণ অতীতে অনেক বড়লোক প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে প্রতারিত হয়েছে।
“এবার আমার মত সাধারণ একজন প্রার্থীকেই বেছে নেবেন তারা।”
জনসংহতি সমিতি সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী অন্নসাধন চাকমার মনেও জয়ের আশা।নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হলে জয় সুনিশ্চিত বলে দাবি করেন এই প্রার্থী।
তিনি বলেন, “জয়ের ব্যপারে আমি খুবই আশাবাদী।”
সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন আরও দুইজন।তারা হলেন নারী সমাজকর্মী সুফিয়া কামাল ঝিমি এবং রাঙ্গামাটি পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঞ্চানন ভট্টাচার্য।নির্বাচনের প্রচারে সক্রিয় থাকলেও ভোটের সমীকরণে বেশ ‘পিছিয়ে’ দুজন।
তবে সাধারণ ভোটাররা চান অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয় হোক। এমনটাই বলছিলেন আসবাবপত্র ব্যবসায়ী ও তরুণ সমাজকর্মী মহিউদ্দিন পেয়ারু।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সদর উপজেলায় অবশ্যই এমন একজন প্রার্থী জয়ী হওয়া উচিত যিনি শিক্ষিত এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেন। আমাদের প্রত্যাশা এমন একজনরই জয় হোক।”
কাউখালীতে এগিয়ে আওয়ামী লীগ, জুরাছড়িতে জেএসএস
কাউখালী উপজেলায় আওয়ামী লীগের ‘একক প্রার্থী’ সামসুদ্দোহা চৌধুরী। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তার সঙ্গে লড়ছেন মংসুউ চৌধুরী। নানা সমীকরণে এই উপজেলায় এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তার জয়ের সম্ভাবনাই বেশি।
তবে ছেড়ে কথা বলবেন না মংসুউ চৌধুরীও। দলীয় নির্দেশ অমান্য করে ভোটে আসায় সম্প্রতি বিএনপি তাকে বহিষ্কার করেছে। তবে তাকে পাহাড়ের বড় দুটি আঞ্চলিক দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ সমর্থন দিচ্ছে এমন কথাও বলেছেন কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের এক কর্মী।
জুরাছড়ি উপজেলায় লড়ছেন আওয়ামী লীগের জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা ও জেএসএসের সুরেশ কুমার চাকমা।
জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা সজ্জন হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। তবে জুরাছড়িতে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের ভিত ততটা `মজবুত নয়'। বরং জেএসএসের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে এখানে।
এখানে কেতন চাকমা নামে আরও একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী থাকলেও তিনি ভোটোর লড়াইয়ে ততটা প্রভাব ফেলতে পারবেন বলে মনে করছেন না ভোটাররা।
বরকলে সাবেক-বর্তমানের লড়াই
বরকল উপজেলায় সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের শক্তিশালী নেতা সন্তোষ কুমার চাকমা লড়ছেন জেএসএস সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান বিধান চাকমার বিরুদ্ধে।
বিধান চেয়ারম্যান হওয়ার আগে উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন। টানা দুই দফায় দায়িত্ব পালন করা বিধান স্থানীয় প্রশাসনেরও বেশ আস্থাভাজন। আবার বরকল উপজেলায় জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক ভিতও বেশ শক্ত।
অপহৃত থাকা অবস্থায় একবার এই উপজেলাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সবাইকে চমকে দেওয়া সন্তোষও ছেড়ে কথা বলবেন না।
ফলে সাবেক ও বর্তমান দুই উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বৈরথ বেশ জমজমাট হবে বলেই ধারণা সবার।
তবে আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতার অভিযোগ এনে সন্তোষ কুমার চাকমা বলছেন, “তাদের তো জনভিত্তি নাই, অস্ত্র দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করে তারা। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।”
রিবেশ ঠিক থাকলে নিজের জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদের কথা জানালেন এই নেতা।
যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে বিধান চাকমা বলেছেন, “কারা কী করছে বরকলের মানুষ সেটা জানে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে বাইরে থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে শান্তিপ্রিয় বরকলে আনার ওনাদের একটি ঘটনা ইতোমধ্যেই ভিডিওতে ভাইরালও হয়ে গেছে। উল্টো উনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, বিষয়টি হাস্যকর।”
যেকোনো মূল্যে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষ অবস্থানের দাবি জানিয়ে বিধান আরও বলেন, “শান্তিপূর্ণ ভোটে যদি আমি হেরেও যাই, তবুও আমি সে পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ীকে ফুলের মালা পড়াব। কিন্তু ভোটের পরিবেশ যারা নষ্ট করছে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ চাই আমি।”
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর দাবি করছেন, “চারটির মধ্যে অন্তত দুটিতে এগিয়ে আছি আমরা, এগুলো হলো কাউখালী ও বরকল।বাকি দুটিতেও বিজয়ী হওয়ার মতই আমাদের প্রার্থী।সদরে হয়ত একক প্রার্থী থাকলে বিজয়ী হওয়া সহজ হত। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।”
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি-দুপ্রক এর রাঙামাটি জেলা সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, “খুব স্বাভাবিক কারণেই তুলনামূলক কম দুর্নীতিবাজ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে প্রকৃত অর্থে বিশ্বাসী ও অন্তত কিছুটা গণতন্ত্রমনা প্রার্থীই বিজয়ী হোক এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও ভয়হীন পরিবেশে হোক, এটাই সবার চাওয়া।”
তরুণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রজ্জ্বোল চাকমা বলছেন, “এমন ব্যক্তিই বিজয়ী হওয়া উচিত যিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবেন, সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন এবং জাতি ধর্ম-বর্ণের-ঊর্ধ্বে উঠে সবার জন্য সমানভাবে কাজ করবেন।”