হিংসার সঙ্গে দুজন আর ঈর্ষা-বোধের সঙ্গে সাধারণত তৃতীয় কোনো বিষয় জড়িত থাকে।
Published : 31 Dec 2023, 01:01 PM
আপনার সাফল্যে কেউ খুশি হবে। আবার কারও মধ্যে হয়ত কোনো প্রভাবই ফেলবে না।
কাছের মানুষ আপনার ভালো খবরে যদি উচ্ছাস প্রকাশ না করে তবে মনে প্রশ্ন আসতেই পারে- সে কি ‘জেলাস’?
ঈর্ষাবোধ সাধারণত মনের গভীরের হতাশা থেকে জেগে ওঠে। তবে মনে রাখতে হবে হিংসা ও ঈর্ষা এক বিষয় না।
যেখান থেকে ঈর্ষাবোধের জন্ম হয়
হিংসা ও ঈর্ষা- সাধারণভাবে এক অর্থে ব্যবহার হলেও আসলে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বন্ধুত্ব-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্কিন মনোবিদ ড্যানিয়েল জ্যাকসন বেয়ার্ড বলেন, “হিংসার সঙ্গে দুজন আর ঈর্ষা-বোধের সঙ্গে সাধারণত তৃতীয় কোনো বিষয় জড়িত থাকে।”
‘গিভ ইট এ রেস্ট: দি কজ ফর টাফ লাভ ফ্রেন্ডশিপ্স’ বইয়ের এই লেখক ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলেন, “বন্ধুর যা আছে সেটা পাওয়ার ইচ্ছে জাগা হল হিংসা। তবে আমার যা আছে সেটা যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কারণে হারানোর ভয় বা বিপদ অনুভব করি সেটা হল ঈর্ষা।”
বন্ধু বা অন্যের কাছে থাকা কোনো বস্তু পাওয়ার ইচ্ছে থেকে হিংসার উদ্ভোব হয়। অন্যদিকে ঈর্ষার অনুভূতি জাগে যদি ওই জিনিসটাই সেই ব্যক্তি আপনার কাছ থেকে দূরে রাখতে চাইলে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন নিবাসী মনোবিজ্ঞানি মর্গান অ্যান্ডারসন ব্যাখ্যা করেন, “হিংসার অঙ্কুরোদগম হয় নিরাপত্তাহীনতা, আত্ম মর্যাদার অভাব, অবহেলা বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয় থেকে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করার অভিপ্রায় থেকেও এই অনুভূতি জাগতে পারে।”
সম্প্রসারিত মানসিকতা নয় বরং ‘স্থির মানসিকতা’ থেকেও ঈর্ষার জন্ম হয়। এই বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানি গবেষক ক্যারল ডিউইক।
তিনি ব্যাখ্যা করেন- স্থীর মানসিকতার ব্যক্তিরা চিন্তা করেন যে, আমার যা ক্ষমতা ও পরিস্থিতি রয়েছে সেটা পরিবর্তন করা সম্ভব না। অন্যদিকে সম্প্রসারিত মানসিকতার মানুষ সামনে আসা যে কোনো প্রতিযোগিতা সামলাতে চেষ্টা করে; ভাবে দক্ষতা ও সামর্থ্যের উন্নতির মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
জ্যাকসন উদাহরণ দিয়ে বোঝান- “ধরা যাক আমার কোনো বন্ধু নতুন অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছে। আর আমি এখনও বাবা-মায়ের সাথেই থাকি বা যে বাসায় থাকছি সেটা পছন্দ না। তবে এমন তো না যে, বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে আমি যেতে পারবো না। এক্ষেত্রে স্থীর মানসিকতার মানুষ মনে করে- ওই থাকার জায়গা জোগাড় করার যোগ্যতা তার নেই বা সামর্থ্য কম। ফলে বন্ধুর সাফল্যকে নিজের ক্ষতি হিসেবে দেখা শুরু করে।”
তবে এর ইতিবাচক দিকও আছে।
ড. মর্গেন বলেন, “আসলে আমরা কী চাই সেটা বুঝতে সাহায্য করে ঈর্ষার অনুভূতি। কোনো বিষয় নিয়ে যদি ঈর্ষাবোধ জাগে- যেমন হতে পারে আপনার সব বন্ধুরা বিয়ে করে ফেলছে আর সেটার কারণে ঈর্ষা জাগছে তাহলে সেটার সংকেত হল আপনিও আসলে বিয়ে করতে চাচ্ছেন।”
ঈর্ষার অনুভূতি শুধু জানায়- আপনি মনে করেন ওই জিনিসটা পাওয়া যাবে না, আর সেটার জন্য ভয় কাজ করে যে- কোনো দিনও হয়ত কাজটা বা বিষয়টা পাওয়া হবে না।
ঈর্ষার কারণে সুন্দর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই কেউ আপনাকে ঈর্ষা করছে কিনা সেটা বোঝার জন্য তিনটি বিষয়ে লক্ষ্য করতে পারেন।
আপনার ভালো খবরে তাদের উত্তেজনা কাজ না করা
“আপনার সৌভাগ্যের সংবাদে বন্ধুর উত্তেজনা বোধ না করার সাধারণ ইঙ্গিত হল ঈর্ষাপারায়ণতা”- বলেন ড. মর্গান।
অভাবি মানসিকতার মানুষ মনে করে, সম্পদের পরিমাণ সীমিত। তাই তারা আপনার সুসংবাদকে নিজের সুখের হুমকি হিসেবে গণ্য করে।
“আর সেটা তারা সূক্ষ্মভাবে বা সরাসরি জানান দেয়”- ব্যাখ্যা করেন জ্যাকসন।
যখন কোনো ইতিবাচক বিষয় আপনার ক্ষেত্রে ঘটবে তখন এই ব্যক্তি হয়ত সেটাকে খেলো করে দেখবে অথবা প্রশংসা করবে অবহেলার সাথে।
অতিরিক্ত সমালোচনা করবে
জ্যাকসন ও ড. মর্গানের মতে- পরক্ষ আক্রমণ, অতিরিক্ত সমালোচনা করার লক্ষণ হতে পারে ঈর্ষাবোধ। তারা এর মাধ্যমে এক ধরনের মানসিক শান্তি খোঁজে। ঈর্ষায় ভোগা মানুষ যদি মনে করে কেউ তার চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তবে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করে।
“এই ধরনের স্বভাব প্রায়শই আত্মরক্ষামূলক আচরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়” ব্যাখ্যা করেন ক্যালিফোর্নিয়ার নিবন্ধিত সম্পর্ক-বিষয়ক পরামর্শক অ্যাড্রিন ডেভটাইয়ান।
তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে ঈর্ষার অনুভূতি জাগে নিরাপত্তাহীনতা থেকে, সেটার কারণ হতে পারে তার শৈশব বা জীবনের কোনো অভিজ্ঞা।”
এই ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করে আপনার দোষগুলোকে প্রকাশ করার মাধ্যমে তারা প্রাথমিকভাবে এক ধরনের শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে।
তাই জ্যাকসন পরামর্শ দেন, “সে আপনার ততটুকুই ক্ষতি করতে পারে যতটুকু তাকে জানাচ্ছেন। যদি দেখা যায়, প্রতিনিয়ত সেই ব্যক্তি আপনাকে নিয়ে নেতিবাচক কিছু করছে তবে সেটা ঈর্ষা। আর এই ক্ষেত্রে আপনার সাবধান হওয়ার প্রয়োজন।”
আপনার সাফল্যকে খাটো করে দেখা
ঈর্ষায় ভোগা মানুষ আপনার সাফল্যকে খাটো করে দেখার পাশাপাশি সেটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। হয়ত কোনো আড্ডায় আপনার সাফল্য নিয়ে কথা হচ্ছে- তখন সেই ব্যক্তিটি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করতে পারে, অস্বস্তি প্রকাশ করতে পারে, অথবা চোখ উল্টিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারে।
ড. মর্গান বলেন, “আর এসবই হল ঈর্ষাবোধের লক্ষণ।”
জ্যাকসন বলেন, “খেয়াল করে দেখুন তো, আপনি কোনো ভালো খবর পাওয়ার পর সেটা কিছু নির্দিষ্ট লোককে জানাতে চান না। কেনো চাননা সেটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করুন।”
সম্পর্কে ঈর্ষাবোধ সামলানোর পন্থা
কৌতুহলী হওয়া: যে কোনো সম্পর্কে ঈর্ষার গন্ধ পেলে অভিযোগ না করে বরং জানার চেষ্টা করতে হবে ‘কারণ কী?’
কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে তাদের কার্যকরণে নজর দিন। যেমন- চাকরিতে আপনার উন্নতি দেখে কোনো বন্ধু যোগ্যতার প্রশংসা না করে যদি কীভাবে ‘প্রোমোশন’ জোগাড় করলেন সেই বিষয়ে বলা শুরু করে তবে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে, সে কেনো এভাবে বলছে!
জ্যাকসন ও ড. মর্গানের পরামর্শ হল- তর্ক না করে বরং তার সাথে একা কথা বলুন স্বাভাবিক কণ্ঠে। তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন, সে যা করছে তা ঠিক না। ঈর্ষায় ভুগলেও অনেক সময় মানুষ সেটা বুঝতে পারেনা।
সহানুভূতিশীল আচরণ: সাধারণত কর্থাবার্তা মাধ্যমে অনেক কিছুই সমাধান করা সম্ভব। আর সে যদি আপনার বন্ধু হয় তবে সহানুভূতি দেখানোই শ্রেয় হবে।
হতে পারে তার জীবনে এমন কোনো বাজে বিষয় ঘটে গেছে সেটার কারণে আপনার সাফল্যটাও তার ওপর বাজে প্রভাব ফেলছে। কার্যকরণে প্রকাশ পেলেও সেটাকে ধরে বিচার করতে না বসে বরং তার কোনো সমস্যায় অনুভূশীল আচরণ করার চেষ্টা করা উচিত।
ডেভটাইয়ান বলেন, “প্রায় সময় দেখা যায়, ঈর্ষান্বিত হওয়ার কারণ হল সেই ব্যক্তি প্রচণ্ড কষ্টে আছে। বুঝতে চেষ্টা করুন কারণটা আপনি না, বরং সে নিজেই।”
কারও মাঝে ঈর্ষা দেখা দিলে, সেটা ধরে পুরো মানুষটার চরিত্র বিশ্লেষণ করা আমাদের স্বভাব। তবে মনে রাখতে হবে, যে কেউ যে কোনো সময় এই অনুভূতিতে পড়তে পারে।
নিজের সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি: সমালোচনা ঈর্ষা করার লক্ষণ। তবে এটা অনেক সময় ভুলও হতে পারে। যদি দেখা যায় বেশিরভাগ বন্ধুবান্ধব পরিচিতরা আপনাকে নিয়ে একই রকম সমালোচনা করে যাচ্ছে তবে নিজের দিকেও নজর দিতে হবে।
প্রয়োজন হলে নিজেকে আলাদা করা: ওপরের বিষয়গুলো পর্যালোচনা করার পর যদি দেখা যায় ওই ব্যক্তি নেতিবাচক ভাব প্রকাশ করেই যাচ্ছে আর উন্নতি কোনো লক্ষণ নেই তবে সীমারেখা টানতেই হবে।
ডেভটাইয়ান বলেন, “সীমারেখা টেনে ওই ব্যক্তির মাধ্যমে ক্ষতি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কোন সম্পর্কে বা বন্ধুত্বে বিনিয়োগ করে যাবেন সেটা বের করা জরুরি। মনে রাখতে হবে ক্ষতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে আপনাকে হয়ত সেই বন্ধু্ বা পরিচিতজন থেকে দূরে সরে যেতে হবে নিজের ভালোর জন্য।”
নিজের আলো ছড়িয়ে যেতে হবে: যদি ঈর্ষার লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতেই থাকে- জ্যাকসন পরামর্শ দেন- তবে শক্তি আর মনোযোগ তাদের ক্ষেত্রেই দিন যারা আপনার আলো নিভিয়ে না দিয়ে আরও উজ্জ্বল করবে।
সাফল্য নিয়ে আনন্দবোধ ও মানসিকভাবে সেটা বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করার অধিকার আপনি রাখেন- যা কিনা বন্ধুত্বের প্রধান চাবিকাঠি।
জ্যাকসন বলেন, “আমি সবসময় পরামর্শ দেই, যেটা আপনাকে আনন্দ দেয় সেটা অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে গিয়ে থেমে যাবেন না। মনে রাখতে হবে নিজেকে খাটো করে অন্যকে কখনও বড় করে দেখার অনুভূতি দেওয়া যায় না।”
আরও পড়ুন