নারী উদ্যোক্তা হওয়া মুখের কথা নয়

“নারী দিবস পালন না, মানুষ দিবস পালনের প্রচলণ শুরু হলে ভালো হত।”

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2023, 10:52 AM
Updated : 8 March 2023, 10:52 AM

আর্থিক বিষয় তো অবশ্যই, তবে ব্যবসা শুরু করতে সেই বিষয়ে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

উদ্যোক্তা হিসেবে পথে নেমে অনেকেই সাফল্যের আলো দেখেছেন। এই প্রতিবেদনে এমনই তিন নারীর গল্প বলা হল।

“স্বামী, সংসার ঘর সব সামলে নিজের চাকরি বা ব্যবসা সামলানোর বিষয়টা খুব একটা সহজ কাজ নয়। পরিবারের সবাই যদি একে অপরের সহযোগী হয়ে কাজ করেন তাহলে সংসার ও কর্মক্ষেত্র অনেকটাই সহজ হয়ে আসে,” এমনটাই মনে করেন দেশীয় চামড়ার ব্র্যান্ড ‘গুটিপা’র কর্ণধার তাসলিমা মিজি।

২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে ‘গুটিপা’; সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামালের তৈরি চামড়ার ব্যাগের প্রতিষ্ঠান। এখানে চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে তার প্রক্রিয়াজাতকরণ, রং, টেক্সার নির্ধারণ ও সমসাময়িক ট্রেন্ড অনুসরণ করে ব্যাগ তৈরি করা যাবতীয় প্রক্রিয়া এদেশের সম্পন্ন হয়।

“চামড়ার প্রতি ভালো লাগা থেকেই মূলত শুরু হয় গুটিপার যাত্রা,” এমনটাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তাসলিমা মিজি।

এরকমই আরেকজন ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করা দেশীয় পণ্যের ব্র্যান্ড ‘শৈলী’র কর্ণধার তাহমিনা শৈলী।

ছোটবেলা থেকেই নকশা করা, পোশাক বা গয়নার তৈরির প্রতি আগ্রহ ছিল। সেখান থেকেই সূচনা হয়। চাকরি ছেড়ে ব্যবসার পথ ধরেন। কলেজ জীবনে সাংবাদিকতা এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও কাজের আগ্রহ খুঁজে পেতেন শখের মালা বা নুপুর তৈরি মধ্য দিয়ে।

“অফিস শেষ করে কখন বাসায় যেয়ে মালা বানানো শেষ করবো এমন তাড়ায় থাকতাম। মালা বানানো, পোশাকে ডিজাইন করে পরা এই বিষয়কে বাসার মানুষজন শখ হিসেবেই দেখতেন। কিন্তু আমি যে এই শখকে পেশা হিসেবে নিতে চাই এটা বোঝাতেই অনেকটা ঝক্কি সামলাতে হয়েছে”, বললন তিনি।

২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে দেশীয় পোশাক ব্র্যান্ড ‘সাদাকালো’। কেবল সাদা ও কালো এই দুই রংয়ের সমন্বয়ে পোশাক, গহনা এমনকি ঘরে ব্যবহৃত তৈজসপত্র পাওয়া যায় এখানে।

“সাদা ও কালো দুটি রংয়ের প্রতি ভালো লাগা থেকেই ‘সাদাকালো’ ব্র্যান্ড তৈরি চিন্তা আসে মাথায়”, বললেন এর কর্ণধার তাহসিনা শাহীন।

ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে বের হওয়ার পরে প্রথম পাঁচ বছর ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’তে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন।

নিজে কিছু করার তাড়না থেকেই ব্যাবসায় উদ্যোগী হন। শুরুতে অনেকেই নিরুৎসাহিত করলেও কেবল একজন পার্টনারের সহযোগিতায় অংশীদারের ভিত্তিতে ব্যবসার প্রথম পসরা সাজান রাজধানীর সীমান্ত স্কয়ারে।

নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন তাহসিনা শাহীন। বলেন, “ব্যবসায়ের শুরু থেকে এখন অব্দি আমি পরিবার, বন্ধুবান্ধব, মার্কেটে থাকা অন্যান্য দেশীয় ফ্যাশন হাউজ ও তাদের কর্ণধারদের সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি।”

পরিবার বিষয়ে কথা বলার সময় শাহীন মন্তব্য করেন, “মেয়েরা নিজে কিছু করতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বাধা পায়। এদিক থেকে আমি অনেক সৌভাগ্যবান। আমরা চার বোন। এখন যদিও অবস্থায় উন্নতি ঘটেছে কিন্তু আমাদের সময়ে ভালো বিয়ে হওয়াকে মেয়েদের জীবনের একমাত্র সফলতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু আমার মা আমাদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে মানুষ করেছেন। তিনি বলতেন- আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, পরে বিয়ে। তাই ছোটবেলা থেকেই নিজের প্রতি বিশ্বাস ও মনে সাহস ছিল।“

“আবার বিয়ের পরে আমার শাশুড়ি ও অন্যান্য সদস্যরাও সন্তান পালন থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছেন।”

“শুধু তাই নয়, সেই সময়কার আরও কিছু দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড যেমন- বিবিয়ানা, কে-ক্রাফট, রঙ, প্রবর্তণা এরকম আরও কিছু দেশীয় ফ্যাশন হাউজের কর্ণধারেরা ‘সাদাকালো’র পথ চলায় অনেকটাই সাহায্য করেছে,” বললেন তিনি।

কীভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হবে, কোন তন্তটা সময়োপযোগী এসব কিছু বুঝতে এবং সেগুলো নিয়ে কাজ করতে সকলের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

সকলের যাত্রাটা এমন সহজ নাও হতে পারে।

তাহমিনা শৈলী বলেন, “সাংবাদিকতা বা কোনো চাকরি না করে কেবল নিজের পছন্দের কাজকে পেশা হিসেবে বাছাই করার প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না আমার জন্য। মেয়েরা ব্যবসা করবে এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পরিবারও তাই সহজে সম্মতি দেয় না। একই বিষয় পরিবারের ছেলের ক্ষেত্রে হলে চিত্রটা ভিন্ন হয়। ছেলে ব্যবসা করতে চাইলে যতটা আর্থিক ও মানসিক সহায়তা পায় মেয়ের ক্ষেত্রে সেটা হয়ে ওঠে না, আমার ক্ষেত্রেও হয়নি।”

“২০০৮ সালে চাকরি ছেড়ে গয়না বানানোর দিকে মনোযোগ দেই। একাজেই আনন্দ খুঁজে পেতাম। বাবা ফটোগ্রাফার হওয়াতে ছোট থেকেই ক্যামেরা, ছবি ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা ছিল। প্রথম অবস্থায় নিজেই পণ্যের ছবি তুলে ফেইস বুকে আপলোড করতাম। সে সময় ফেইস বুক একদম নতুন, এর ব্যাবহারকারীও কম। তবুও একটু একটু করে গয়না বিক্রি হতে শুরু করি। পরিবারের মানুষও বুঝতে পারে যে আমি এই পেশায় শতভাগ সিরিয়াস”, বলেন শৈলী।

গুটিপার’ কর্নধার মিজি বলেন, “রানিং হার্ডওয়ারের ব্যবসা বাদ দিয়ে চামড়ার পণ্যের ব্যবসা শুরু করায় প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে হয়েছে একাই। পরে ব্যবসার আউটকাম দেখে পরিবার সাপোর্ট করা শুরু করেছিল।”

ব্যবসাতে ঝুঁকি থাকেই, সেটা যেই ব্যবসা-ই হোক না কেনো। কেবল সাদা কালো রংয়ের পণ্য দিয়ে দোকান সাজানোটা এক ধরনের ঝুঁকির।

আবার পেশা পরিবর্তন করে নিজের পুঁজি দিয়ে প্রথমে গয়না ও পরে শাড়ির ব্যবসা শুরু করা, সকলের সহযোগিতা নিয়ে কাজ শুরু করে যদি বিফল হতে হয় তাহলে প্রত্যাশার যে ভাঙন পড়ে সেটাও একটা ঝুঁকি।

ক্ষতি বা হেরে যাওয়ার কথা চিন্তা করে উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। কেবল নিজের প্রতি বিশ্বাস ও লক্ষ্যে অটুট থাকলে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া যায় বলে মনে করেন, শৈলী।

একই বিষয় অন্তরে ধারণ করেন তাহসিনা শাহীন। তিনি বলেন, “আমি কী করতে চাই, এটা বোঝাটা জরুরি। তা না হলে লক্ষ্য নির্ধারণ করা যাবে না। লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে চললে সফলতা আসবেই।”

মিজির মতে, “লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক বাধা আসে। যারা উদ্যমী তারা সব বাধা উৎরানোর পথ খুঁজেন। আবার অনেকে হাল ছেড়ে দেয়। তাই নিজেকে কোথায় দেখতে চাই সেটা আগে ঠিক করতে হবে।”

মিজি আরও বলেন, “শুরুতে কম্পিউটারের হার্ডওয়ার নিয়ে কাজ করতাম। বাইরে থেকে ইম্পোর্ট করে দেশে বিক্রি করতাম। ট্রেডিংয়ে আগ্রহ কম থাকায় তা কেবল প্রয়োজনের তাগিদে করা হত। আমি আমার আগ্রহের জায়গা খুঁজে পাই লেদার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। একে-তো আমার লেদার গুডস পছন্দ ছিল। তারপর এটা যখন নিজের দেশের কাঁচামাল এমনকি এদেশের কারিগর দিয়েই তৈরি করি তখন আত্মতৃপ্তি আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়। এটা সফলতার জন্য খুব প্রয়োজন।”

সফলতার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘স্বকীয়তা’। পণ্যের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। সে সম্পর্কে ভালো মতো জানা, তা তুলে ধরা, নতুন কিছু সৃষ্টি করা ইত্যাদি। তবে সবাই যে সৃষ্টিশীল হবেন এমন কোনো কথা নেই।

শৈলীর কথায়, “যে পণ্য নিয়েই কাজ করা হোক না কেনো সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা উচিত। এতে নিজের ব্যবসা ও ক্রেতা উভয়ই লাভবান হন।”

ব্যবসায় পারিবারিক ও সামাজিক নানান চ্যালেঞ্জ ছাড়াও বর্তমান বাজার, ট্রেন্ড, এক এক প্রজন্মের চাহিদা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা উচিত। নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এদিকে পিছয়ে থাকেন। তাই এসকল শিক্ষালাভ, দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি সফল নারী উদ্যোক্তার অন্যতম শর্ত বলে মনে করেন তাসলিমা মিজি।

তিনি বলেন, “ব্যবসার শুরুতে আমার প্রধানত অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল। এছাড়া আমাদের মার্কেট খুব একটা নারীবান্ধব নয়। আমাদের দেশে সম্পদ কম। তাই সাহস, আগ্রহ ও দক্ষতা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। আমি এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। নতুন বিষয় সম্পর্কে জানা, দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি।”

তিনি আরও বলেন, “নারীদের বাইরে কাজের ক্ষেত্রে পারিবারিক যে প্রধান প্রতিবন্ধকতা থাকে তেমনটা আমারও ছিল। ঘর সংসারের সব কাজ শেষ করে বাইরে কাজ করা। তাছাড়া অনেক মানুষই নিরুৎসাহিত করত। বিভিন্ন কাজে বাধা ছিল। ঘরে ফেরার নির্দিষ্ট সময়সীমা- এমন অনেক কিছু। এগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব দিলে আজ হয়ত এখানে আসা হত না।”

তাই নিজের কাজ ও ইচ্ছার সঠিক সমন্বয় ঘটানোর পরামর্শ দেন মিজি।

অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মতো শৈলী ও মিজি- সংসারের কাজ সামলে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এই যুদ্ধে টিকে থাকা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

তারা মনে করেন, যদি পরিবার থেকে একটু সহযোগিতা আসে যেমন- বাচ্চা থাকলে দেখেশুনে রাখা বা ঘরের সব কাজ একা মায়ের ওপর না দিয়ে সবাই মিলেমিশে করলে বিষয়গুলো সহজ ও সুন্দর হয়।

নতুনদের উদ্দেশ্যে শৈলী বলেন, পরিস্থিতি খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও কিছুটা উন্নত হয়েছে। এখন কাঁচামাল অনেকটা সহজলভ্য। পণ্য প্রচার করাও আগের তুলনায় সহজ। ক্রেতারাও অনেক সচেতন ও পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন। তাই কেবল এককালীন না বরং নিয়মিত ব্যবসা চালিয়ে যেতে ক্রেতার চাহিদা বোঝা ও সে অনুযায়ী ভালো পণ্য যোগান দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”

মিজির কথা হল, “এখনও অনেকেই দেশীয় পণ্য কিনতে চান না। নতুনরা যদি দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করে তাহলে চারপাশের মানুষকে আরও সচেতন করা যাবে, দেশের জন্যও এটা ভালো। নতুনরা যদি বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করে, কাজের ছবি, ভিডিও বা ডকুমেন্টরির মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কে সবাইকে জানান তাহলে কাজটা আরও সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হবে।”

তাহসিনা শাহীনের মতে, “একা কেউ আগাতে পারে না। যদি সমসাময়িক সকল উদ্যোক্তা একসঙ্গে কাজ করেন ও পণ্যের মান ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালান তাহলে ব্যক্তিগত উদ্যোগ সফল হওয়ার পাশাপাশি দেশও উপকৃত হবে।”

“নারী দিবস পালন না, মানুষ দিবস পালনের প্রচলণ শুরু হলে ভালো হত”, বলেন শাহীন।

তার মতে, নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসে মানুষ হিসেবে নিজেকে চিনতে ও বাঁচতে শিখেছে। কিন্তু এখনও অনেক পুরুষ বা ছেলে আছেন যার সম্পূর্ণ মানুষ হওয়া শিখতে পারেননি। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।

“আমার বউকে আমি স্বাধীনতা দিয়েছি, সে তার মতো কাজ করে- এটা জাহির করার কিছু নেই। স্বাধীনতা দেওয়ার কিছু না, একটা মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। এটা নারী পুরুষ সবাইকেই বুঝতে হবে”, বলেন শাহীন।

অন্যদিকে, নারীদেরকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও সাবলম্বী হওয়ার আহ্বান জানান তাসলিমা মিজি ও শৈলী।