নওশাদের স্যুপ

ঢাকার স্ট্রিট ফুডে যখন স্যুপের বাটির আগমন ঘটল, সলিমুল্লাহ রোডে তখন থেকেই এ খাবারটি বিক্রি করে আসছেন নওশাদ।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2022, 05:47 AM
Updated : 9 August 2022, 06:36 AM

ভারত ভাগের পাঁচ বছর আগে ১৯৪২ সালে বিহার থেকে তৎকালীন পূর্ববাংলায় আসেন মইনউদ্দিন। ঢাকার সূত্রাপুরে শুরু করেন খাবার হোটেলের ব্যবসা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন ঠিকানা হয় মোহাম্মদপুরে; সলিমুল্লাহ রোডে দেন পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান।

পঞ্চাশ বছর বয়সী ওই পান দোকানের পাশেই মইনের ছোট ছেলে নওশাদের ছোট্ট দোকান, সেখানে বিক্রি হয় স্যুপ। লাল আর সবুজ বাতির নকশায় দোকানের নাম লেখা ‘নওশাদ স্যুপ’।

দোকানে বসার জায়গা বলতে গোটা দশেক প্লাস্টিকের ‍টুল; বিকালের দিকে, বিশেষ করে ছুটির দিনে ভেতরে জায়গা পাওয়া ভার।

অবশ্য বাইরেও বসার ব্যবস্থা আছে। আর বসার জায়গা নিয়ে ক্রেতাদের খুব একটা চিন্তিত বলেও মনে হল না। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও তাদের নওশাদের স্যুপের স্বাদ দিতে আপত্তি নেই যেন।

নওশাদ স্যুপ রান্নার কলাকৌশল শিখেছেন তার বাবা মইনউদ্দিনের কাছে। সেই রেসিপি নিয়েই ২২ বছর ধরে দোকান চালিয়ে আসছেন। এখন প্রতিদিন তার দোকানে মোটামুটি ৩০০ বাটি স্যুপ বিক্রি হয়।

নওশাদের বড় ভাই আরিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আব্বা অনেক ধরনের রান্না করতে পারতেন। স্যুপটা তিনিই নওশাদকে শিখিয়েছেন। সূত্রাপুরের দোকান ছেড়ে দেওয়ার পর আব্বা আর খাবারের দোকান করেননি। এই পান-সিগারেটের দোকান দেন; বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা ভাইরা সেটা চালাই। আর নওশাদ স্যুপ বিক্রি করে।”

নওশাদের স্যুপ খেতে হলে তার দোকানে যেতে হয় বিকাল ৫টার পর। অবশ্য ভিড় বাড়তে শুরু করে সন্ধ্যার পর। বাসা থেকে রান্না করে প্রথম দফায় স্যুপ দোকানে পাঠিয়ে দেন নওশাদ। সন্ধ্যার সময় আরও স্যুপ নিয়ে নিজে আসেন দোকানে।

কী আছে নওশাদের স্যুপে

নওশাদের স্যুপের মূল উপাদান চিকেন স্টক, কর্নফ্লাওয়ার, ডিম, ফালি করা মুরগির মাংস আর সাদা গোলমরিচ।

বাটিতে পরিবেশনের সময় ভিনেগারে ভেজানো কাঁচামরিচ দেওয়া হয়। আলাদা করে ক্রেতার সামনে দেওয়া হয়- বিট লবণ, টমেটো ক্যাচাপ আর বোম্বাই মরিচের সস।

মিরপুর থেকে বান্ধবীকে নিয়ে স্যুপ খেতে আসা শরীফ রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যুপতো নানা জায়গায় খাই, এখানেও আরও কয়েকটি দোকান আছে, কিন্তু নওশাদ ভাই সেই শুরু থেকে একইরকম স্যুপ করে আসছেন। শুধু মুরগির মাংসই দেন। আর স্যুপে মাংসের পরিমাণও বেশি। স্যুপটা বেশ ঘন।”

শরীফের ভাষায়, “বোম্বাই মরিচের সসটা আসলেই অসাধারণ। যারা ঝাল সহ্য করতে পারেন না, তারা যদি খুব সামান্য একটু নেন; তবে ঘ্রাণে মাতোয়ারা হবেন আমি নিশ্চিত। যখনই সময় পাই বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলে আসি।”

নওশাদের স্যুপের তারিফ করে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বললেন, “নওশাদকে চিনি শুরু থেকেই। ওর খাবার যেমন ভালো, ব্যবহারও ভালো। হাসি মুখে কথা বলে সবার সঙ্গে।

“আর স্যুপে যতটা পারে- কৃত্রিম জিনিস না দিয়ে রান্না করে। এই কারণেই ওর স্যুপ আমার পছন্দ। যে কোনো ভালো চাইনিজ রেস্তরাঁকে টেক্কা দিতে পারে।”

২০০০ সালে সলিমুল্লাহ রোডে স্যুপের দোকান খোলেন নওশাদ। তখন দাম ছিল প্রতি বাটি ১০ টাকা, এখন ৫০ টাকা। আর পার্সেল নিতে চাইলে আছে বিভিন্ন সাইজের বাটি। শুরু ১০০ টাকা থেকে। সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকার বাটিও পাওয়া যায়, যাতে ছয়জনের খাওয়ার মত স্যুপ থাকে।

এই স্যুপ নিয়ে কেন মানুষের এতো আগ্রহ? প্রশ্ন শুনে নওশাদ হাসিমুখে বলেন, “আসলে আমার স্যুপে কেমিকেল জাতীয় সেইরকম কিছুই থাকে না। খুব সাধারণভাবে রান্না করি। মুরগীর সব অংশ দেওয়া হয়।”

স্যুপে গিলা-কলিজাও থাকে জানিয়ে নওশাদ বলেন, “আমি প্রথম থেকেই স্যুপে ওগুলো দেই। আমার কিছু কাস্টমার আছেন, যারা ওই গিলা-কলিজা খেতে আসেন।”

নওশাদের দোকানের পাশে জামালের হোটেল। সেখানকার লুচি দিয়ে চিকেন স্যুপের স্বাদ নেন অনেকে।

স্যুপের সঙ্গে লুচির সম্পর্ক কী? জবাবে নওশাদ বললেন, “একদিন আমি নিজেই লুচি দিয়ে স্যুপ খাচ্ছিলাম। ভালো লেগেছিল। তখন পরিচিত কিছু মানুষকে খেতে বলি। সেই দেখাদেখি এটা জনপ্রিয় হয়। আগে অনেকে পুরি দিয়ে স্যুপ খেতেন।”

নওশাদের দোকানে বসে অর্ডার করলে জামালের হোটেল থেকে লুচি আসে। অনেকে আবার জামালের দোকানে বসে লুচি দিয়ে নওশাদের স্যুপ খান।

ঢাকার স্ট্রিট ফুডে স্যুপ এল কেমন করে

বলা হয়, স্যুপের ইতিহাস হেঁশেলের মতই পুরনো। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে স্যুপের আছে নানা রূপ। রোজকার ঘরোয়া আয়োজনে বাঙালি যে ডাল খায়, সেটাও এক কায়দার স্যুপই।

ব্রিটিশরা দুইশ বছর ভারতবর্ষ শাসন করলেও ইউরোপীয় রন্ধন শৈলী বাঙালির রান্নাঘরে উপনিবেশ গড়তে পারেনি। তবে ওই ব্রিটিশ আমলেই এ অঞ্চলে চীনা খাবারের অনুপ্রবেশ।

ইস্ট-ইন্ডয়া কোম্পানি ভারতের শাসনভার নিজেদের হাতে নেওয়ার কিছু পরেই তখনকার ভারতের রাজধানী কলকাতায় চীনাদের বসতি গড়ে ওঠে। এদেশের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, জুতা তৈরি, চশমা, দাঁতের চিকিৎসাসহ নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে চীনারা। নানা প্রদেশ থেকে আসা চীনারা নিজেদের মধ্যে সংহতি ধরে রাখতে ছোট ছোট ক্লাবও গড়ে তোলেন।

ওই ক্লাবগুলোর মাধ্যমেই এ অঞ্চলে চৈনিক খাবার বিক্রি শুরু হয়। প্রথম চীনা খাবারের রেস্তোরাঁ চালু হয় ১৯২৪ সালে কলকাতায়। ‘নানকিং’ নামের ওই রেস্তোরাঁয় বলিউডের এক সময়কার তারকাদের যাতায়াত ছিল, পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় প্রথম চীনা খাবারের দোকান শুরু হয় আরো পরে।

ঢাকার খাদ্য-সংস্কৃতি বিষয়ক লেখক সাদ উর রহমান তার ‘ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন, ১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে মি. মিং নামে চীনের এক নাগরিক ঢাকার সেগুনবাগিচা রোডে ‘ক্যাফে চায়না’ নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন।

সাদ উর রহমানের মতে, ওটাই ঢাকায় প্রথম চাইনিজ খাবারের দোকান। তিনি লিখেছেন, ওই দোকান হওয়ার পর ধীরে ধীরে ইন্দো-চায়নিজ রীতির খাবার ঢাকায় জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।

‘চায়নিজ খাবার’ নামে জনপ্রিয় হওয়া খাবারগুলোর মধ্যে স্যুপও আছে। তবে সেটাও আসলে পুরোপুরি চীনা রেসিপির স্যুপ নয়। এসব খাবারে মিশেছে স্থানীয় মশলা আর রন্ধনপ্রণালী।

আর ঢাকায় ‘স্ট্রিট ফুড’ হিসেবে স্যুপের প্রচলন গত শতকের শেষের দিকে। মিরপুর আর মোহাম্মদপুরের কোনো কোনো কাবাবের দোকান তখন স্যুপ বিক্রি করতে শুরু করে। কাছাকাছি সময়ে সলিমুল্লাহ রোডে নওশাদের স্যুপের ব্যবসা শুরু।

সপ্তাহে প্রতিদিন খোলা থাকে নওশাদের দোকান। বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পাওয়া যায় গরম স্যুপ। শুক্রবার বা অন্য ছুটির দিন ভিড় বেশি হয়।

ছুটির দিনে বিক্রিবাট্টা ৪০০ বাটিতেও পৌঁছায় বলে জানালেন নওশাদ। আর মৌসুমি জ্বর বেড়ে গেলে পার্সেল বিক্রি হয় বেশি।