‘রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।’
Published : 26 Mar 2024, 10:10 AM
তখন বেলা ১টা। শাঁখারী বাজারের সরু গলিতে প্রতিদিনের মতোই হাঁকডাক। স্বর্ণ আর শাঁখার দোকানগুলোতে জমজমাট ক্রেতায়। তবে চারপাশের রংয়ের ছটায় ভিন্নতা এনেছে দুপরে।
নারীদের হাতে হাতে বাহারি থালা, তাকে হরেক রং। কেউ মন্দিরে প্রতিমার গায়ে চড়াচ্ছেন সেই রং, কেউ বা স্বামীর চরণে রং লাগিয়ে প্রণাম করছেন। দোকানে দোকানে আবির কেনার ধুম। কোথা থেকে যেন কয়েক ফোঁটা রং এসে লাগলো কাপড়ে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মন যখন রংয়ের মায়ায় আনমনে, তখনই ঘোর কাটলো একদল কিশোর আর তরুণের ‘এই ধর ধর ওরে রং দে’ হট্টগোলে।
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রার দিন এভাবেই আবিরের ছটায় ভরে ওঠে পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার-তাঁতিবাজারের অলিগলি। আর এই বছর সেটা পালিত হল সোমবারে।
দোলযাত্রা বা দোল পূর্ণিমা আসলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও পুরান ঢাকার রাস্তায় রং খেলায় মাতেন সবাই। সেখানে থাকে না জাতপাত বা ধর্মের গণ্ডি। তেমনটাই বলছেন, তাঁতিবাজার শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিউ ঠাকুর মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তারক বরাল।
শাঁখারী বাজার আর তাঁতিবাজার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হলেও হোলির দুদিন সব ধর্মের লোকজন মিলেমিশে একাকার হয় বলে জানান তারক। বলেন, “এতে তো আমাদের আপত্তি নেই। আমরা বিশ্বাস করি, ধর্ম যার যার হতে পারে, উৎসব তো সবার। আমরা বরং তাদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করি; রং খেলি একসঙ্গে।”
দীর্ঘ বিশ বছর ধরে শাঁখারী বাজারের পান্নিটোলা গলিতে আবিরের ব্যবসা করছেন ‘উৎসব ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’য়ের কর্ণধার উত্তম কুমার। বছরজুড়ে আবির বেচাকেনা থাকলেও দোল ঘিরে বিক্রির পরিমাণ বাড়ে।
তিনি বলেন, “রোজার মাস বলে আজ কিছুটা ভিড় কম। অন্যসময় হলে এখানে পা ফেলার জায়গা থাকত না।”
ধর্ম যার যার হলেও উৎসব সবার উল্লেখ করে উত্তম কুমার বলেন, “সনাতন ধর্ম ছাড়াও অন্য ধর্মের লোকেরা এখানে রং খেলতে আসেন। বিষয়টা বেশ ভালো লাগে আমার। হলি খেলাটা এখন আর শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, সবাই এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।”
আবির তৈরিতে কী কী উপকরণ লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ত্বকে ব্যবহারের পাউডারের সঙ্গে রং আর সুগন্ধি মিশিয়ে তারপর রোদে শুকিয়ে আবির তৈরি হয়। ফলে এটা ছোট থেকে বয়স্ক সকলেই ব্যবহার করতে পারে। অ্যালার্জি বা অন্য কোনো সমস্যা হয় না।”
“দোলের সময়টায় এখানকার আবিরের চাহিদা ঢাকার বাইরেও রয়েছে, জানান উত্তম। বলেন, “খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে এসেও আবির নিয়ে যায়।”
“দাম প্রসঙ্গে এ আবির বিক্রেতা বলেন, “সর্বনিম্ন দুইশ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচশ টাকার আবির পাওয়া যায়। দামের পার্থক্য হয় মান ভেদে। দেশি ও ভারতীয় দুই ধরনেরই মেলে। যেসব রংয়ের মান ভালো, তা ফুঁ দিলে উড়ে যায়। আর কম দামিগুলো ত্বক ও পোশাকে লেগে থাকে।”
আরও বলেন, “আগে শঙ্খের গুঁড়া থেকে আবির শুধু শাঁখারি বাজারেই তৈরি হত। তবে এখন বাইরের অনেকেই আবির তৈরি করেন।”
উত্তমের দোকানে কথা হয় গৌতম সূত্রধর নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। হরেক রংয়ের আবির ছোট ছোট প্যাকেটে পুরে নিচ্ছিলেন তিনি। আদি নিবাস মানিকগঞ্জ হলেও দীর্ঘদিন ধরে শাঁখারি বাজার থাকেন পরিবারের সঙ্গে। এখানেই স্বর্ণের দোকান চালান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে গৌতম বলেন, “পরিবারের সঙ্গে দোল খেলব; তাই আবির নিচ্ছি। এই দিনে রং দিয়ে একে অপরকে রাঙিয়ে দেই; এটাই আনন্দ।”
একটু এগোতেই কথা হয় তাঁতিবাজারের বাসিন্দা পায়েল ঘোষের সঙ্গে। এক বান্ধবীর সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন; তার দু্গাল তখন রাঙানো আবিরে।
তাদের সেই রংয়ের আড্ডা থামিয়ে দোলে কী করেন জানতে চাইলে বলেন, “সারা বছর এই দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকি। সকালে পূজা শেষে ঠাকুরের পায়ে আবির-বাতাসা দেই, তারপর বন্ধু বান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে আবির খেলি। এদিন সবার সঙ্গে দেখা হয়, ঘোরাফেরা হয়। পুরোদিন রঙিন হয়ে থাকে; বেশ উৎসবে কাটে।”
পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে শাঁখারি বাজারে হোলি উৎসব পালন করছেন অর্চনা সূর ও তীর মোহন সূর দম্পত্তি। স্বামীর গালে রং ছুঁয়ে বেশ খুনসুটি করছিলেন।
অর্চণা বলেন, “বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত, প্রতি বছর এখানে হোলি উৎসব দেখতে আসছি। আমার কাছে এর কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। আমাদের দেখাদেখি তিন ছেলে বৌ ও এক মেয়েও একই ধারায় এই উৎসব পালন করে। বংশ পরম্পরায় হোলির একই রীতি আমরা দেখে আসছি।”
“শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, দোলে অন্য ধর্মের মানুষজন এই এলাকায় তাদের সঙ্গে হোলি খেলে বলে জানান।
অন্য সম্প্রদায়ের যোগদান ভালো লাগে? এমন প্রশ্নে উচ্ছ্বাসের সুরে অর্চণা বলেন, “হ্যাঁ খুব ভালো লাগে। তারাও আবির, শঙ্খ, শঙ্খ গুঁড়া এসব কিনতে আসে, আমাদের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। আমরাও সাদরে গ্রহণ করি।”
“হোলিতে পুরান ঢাকার এই অংশ রঙিন হয়ে ওঠে এই দিনে”- বলেন, তীর মোহন।
শাঁখারি বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা যমুনা নন্দি বলেন, “হোলি খেলা হিন্দুদের উৎসব হলেও পরদিন সবাই মিলে রং খেলেন। হোলির দিন পূজা শেষে আবির খেলেন। আর পরেরদিন বাইরে থেকে অনেক মানুষ তাদের এলাকায় রং খেলতে আসেন।”
রং খেলায় কোনো ধর্মের ভেদাভেদ হয় না বলে মনে করেন যুমনা।
বলেন, “হিন্দ, মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই এই দিন অংশ নেয়। গান বাজায়, আনন্দ করে। আমরা প্রতি বছরই খুব উপভোগ করি এই দিনটা।”
এদিন বিশেষ কোনো খাবারের আয়োজন না থাকলেও ঠাকুরকে ভোগ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। যে যার সামর্থ্য মতো যেমন- খিচুড়ি, মিষ্টান্ন, পাঁচ রকমের ভাঁজা ইত্যাদি ঠাকুরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে থাকেন বলে জানান তিনি।
দোল কী
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত বরুণ বলছেন, “বৈষ্ণবদের মতে, এ আনন্দমুখর রঙিন দিনে পূজিত হন রাধাকৃষ্ণ। অর্থাৎ এই তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ, রাধা ও তার গোপীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। আর এই রঙ উৎসব-ই দোলযাত্রা। দোল পূর্ণিমায় চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয়েছিল, তাই এ উৎসবকে গৌর পূর্ণিমাও বলা হয়।”
দোল খেলার আবির কেনো ব্যবহার হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দোল উৎসবের দিন ভগবানের চরণে আবির রাখা হয়। সনাতন ধর্মালম্বীরা বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের জীবন থেকে রোগ-জরা দূর হয়ে জীবন রঙিন হয়ে উঠবে।”
শীতের মলিনতা পেরিয়ে বসন্ত যেমন ভালোবাসার রং নিয়ে আসে, তেমনি দোল উৎসবেও ভালোবাসা ছড়ায় রংয়ে রংয়ে।
আরও পড়ুন