নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঝিমঝিম করতে পারে। যা হৃদরোগের লক্ষণও নির্দেশ করে।
Published : 05 Nov 2024, 04:46 PM
শুয়ে বা বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ানো মাত্রই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো! কারও কারও হয় মাথা ঝিমঝিম, কিংবা দেখে চোখে সরষে ফুল।
যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মায়ো ক্লিনিক জানাচ্ছে, চিকিৎসা শাস্ত্রে এই অবস্থাকে বলা হয় ‘অর্থস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন’ বা ‘পস্চুরাল হাইপোটেনশন’- যা এক ধরনের নিম্ন রক্তচাপ অবস্থা। শোয়া বা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে এরকম হয়।
যদিও বিষয়টা তেমন মারাত্মক কিছু নয়। তবে অনেকদিন ধরে এই অবস্থা চলতে থাকলে বিপজ্জনক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নির্দেশ করতে পারে।
মাঝেমধ্যে এই সমস্যা হওয়ার কারণে মধ্যে আছে- পানিশূন্যতা বা অনেকক্ষণ শুয়ে থাকা। তবে দীর্ঘমেয়াদে ‘অর্থস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন’ হতে পারে হৃদ-সংক্রান্ত সমস্যার লক্ষণ। তাই চিকিৎসা নির্ভর করবে, সমস্যার কারণ উদঘাটনের পর।
এই বিষয়ে হার্ভার্ড হেল্থ পাবলিশিংয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বস্টন’য়ের ‘লাওন কার্ডিওভাস্কুলার সেন্টার’য়ের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ডারা কে.লি লুইস বলেন, “পস্চুরাল অর্থস্ট্যাটিক ট্যাকাকার্ডিয়অ সিন্ড্রোম (পিওটিএস)’ নির্ণয় করতে প্রথমে রোগীকে কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখা হয়। তারপর দাঁড়াতে বলে রক্তচাপ মাপা হয়। এক্ষেত্রে ১০ মিনিটের মধ্যে, এক মিনিট সময় হিসেবে হৃদগতি স্বাভাবিকের চাইতে ৩০বার বেশি স্পন্দিত হতে পারে। আর রক্তচাপ স্বাভাবিক বা না বাড়লেও নিম্ন রক্তচাপ হবে।”
এসবের সাথে অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে দেখা দিতে পারে- মাথা হালকাবোধ হওয়া এবং ক্লান্তি কাজ করা।
মায়ো ক্লিনিক জানাচ্ছে, আরও লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া ও দ্বিধা কাজ করা।
পিওটিএস’য়ে ছয় মাসের বেশি ভুগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেন ডা. লুইস।
হওয়ার কারণ
শুয়ে বা বসে থাকলে পেটে ও পায়ে রক্ত বেশি চলে যায়, যা কিনা মধ্যাকর্ষণের কারণে হয়। এ কারণে দাঁড়ালে রক্তচাপ কমে যায় ফলে হৃদপিণ্ডে পরিমাণে কম রক্ত পৌঁছায়।
মায়ো ক্লিনিকের তথ্যানুসারে, বিশেষ করে হৃদপিণ্ড ও ঘাড়ের ধমনির কাছে থাকা ‘ব্যারোরিসিপ্টর’ কোষগুলো এই নিম্ন রক্তচাপ অবস্থা ধরতে পারে। তখন এই কোষগুলো হৃদপিণ্ডকে খবর দিতে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় যে, হৃদস্পন্দন দ্রুত করতে হবে আরও রক্ত ‘পাম্প’ করার জন্য। রক্তচাপ বাড়াতে এই কোষগুলো রক্ত প্রবাহের শিরা উপশিরা ও ধমনি সংকুচিতও করে।
তাই বলা হয়, শরীর যখন নিম্ন রক্তচাপ সামলাতে পারে না তখন ‘পিওটিএস’ অবস্থার তৈরি হয়।
অনেকগুলো কারণে এমন হতে পারে-
পানিশূন্যতা: জ্বর, বমি, ডায়রিয়া, পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ না করা এবং অতিরিক্ত কাজ বা ব্যায়াম যা প্রচুর ঘামের কারণ হয়, এসবের জন্য পানিশূন্যতা থেকে ক্লান্তি, মাথা ঝিমঝিমভাব হয়।
হৃদগত সমস্যা: নিম্ন রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন কমের সমস্যা থাকলে এই অবস্থা তৈরি হতে পারে। হৃদপিণ্ডের ভাল্ভের সমস্যা, হৃদরোগ বা দুর্বল হৃদপিণ্ডের কারণে দাঁড়ানোর পর দ্রুত রক্ত পাম্প করতে পারে না।
গ্রন্থির সমস্যা: থাইরয়েডের সমস্যা, ‘অ্যাড্রেনাল ইনসাফিসিয়েন্সি’ এবং রক্তে নিম্ন শর্করা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) কারণে ‘পিওটিএস’ হতে পারে। এছাড়া ডাবেটিসের কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংকেত আদার প্রদানে বাধা তৈরি হয় যে কারণে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
স্নায়ুতন্ত্রের রোগ: ‘পার্কিনসন’স ডিজিজ, পুষ্টির অভাবে ক্ষয় রোগ, অ্যামিলোইডিওস, লুই বডি ডিমেনশা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় সমস্যা ইত্যাদি থেকেও রক্তচাপ জনিত রোগ হতে পারে।
খাবার: খাওয়ার পর অনেকের নিম্ন রক্তচাপ দেখা দেয়। বিশেষ করে বেশি বয়সিদের মাঝে এই সমস্যা দেখা দেয়।
পরিত্রাণের উপায়
ডা. লুইস বলেন, “অনেকের ওষুধের প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে অবস্থার উন্নতি ঘটানোর যায় জীবনধারণের পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে।”
খাদ্যাভ্যাসে খানিকটা বাড়তি লবণ: জানা কথা রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করে সোডিয়াম বা লবণ। যারা পিওটিএস’য়ে ভুগছেন তাদের বাড়তি লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেন ড. লুইস।
তার মতে, “ইউএস ডায়েটারি গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রাপ্ত বয়স্ক একজনের দৈনিক ২,৩০০ মিলিগ্রাম লবণ গ্রহণ করা উচিত, অর্থাৎ প্রায় এক চা-চামচ পরিমাণ। আমি বলবো এই পরিমাণের চাইতে আরও খানিকটা বাড়তি লবণ গ্রহণ করতে যাদের উঠে দাঁড়ালেই মাথা ঝিমঝিম করছে। তবে কাঁচা লবণ খাওয়া যাবে না। রান্নায়, টিনজাত টমেটো জুস বা স্যালাইন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।”
সংকোচন তৈরি করে এমন পোশাক পরা: ‘কম্প্রেশন গার্মেন্টস’ মানে দেহে যেগুলো চেপে থাকে সে ধরনের পোশাক পরলে, দেহের ভেতরের শিরা উপশিরায় চাপ পড়ে, ফলে রক্ত ওপরে উঠতে সুবিধা হয়।
এমন পোশাকের মধ্যে আছে হাঁটু পর্যন্ত মোজা, পায়ের পাতা বিহীন ‘কাফ স্লিভ’ বা অ্যাংক্লিট’, লেগিংস, বাইক শর্টস ইত্যাদি।
ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ানো: পিওটিএস’য়ের চিকিৎসা ধীরে হয়। আর ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়িয়ে এই সমস্যা সমাধান করা যায়।
যেমন প্রথমে শুয়ে ব্যায়াম করায় অভ্যস্ত হতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যায়াম বা হাঁটার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
ডা. লুইস বলেন, “ব্যায়াম করার এক ঘণ্টা আগে অতিরিক্ত ৫শ’ মিলিগ্রাম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেই আমি। এতে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে। আর ঘামের সাথে বের হয়ে যাওয়া লবণের ঘাটতে পূরণে সহায়ক হয়।
তাই বলা যায়, যারা উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে ওঠা, ঝিমঝিম করা বা চোখে সরষে ফুল দেখছেন, তারা একধরনের নিম্ন রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। দীর্ঘদিন এই সমস্যায় থাকলে দ্রুত ডাক্তার দেখিয়ে, পরামর্শ নিয়ে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রতীকী ছবির মডেল: আলিফ। ছবি: ই স্টুডিও।
আরও পড়ুন
যেসব লক্ষণ দেহের জন্য হতে পারে বিপৎসংকেত