অভ্যাস গড়তে পারলে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
Published : 31 Jan 2024, 11:30 AM
‘কর্টিসল’কে ‘স্ট্রেস’ বা মানসিক চাপের হরমোন বলা হয়। কারণ প্রাথমিকভাবে এটা মানসিক চাপ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
যদিও এই হরমোন নিয়ে নেতিবাচক কথা বেশি বলা হয়। তবে এর প্রয়োজনীয়তাও কম নয়।
কর্টিসল হরমোনের কাজ
“বৃক্কের ওপরে থাকা অন্তঃক্ষরা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হওয়া কর্টিসল হরমোন মানব দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে”- বলেন মার্কিন নিবন্ধিত স্থুলতা ও এই সম্পর্কিত সমস্যা বিষয়ক চিকিৎসক কেভিন হাফম্যান।
রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “এই হরমোন বিপাক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, প্রদাহ কমানো ও স্মরণশক্তি গঠন করতে কাজ করে।”
জরুরি বা ভয়ের পরিস্থিতিতে, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি এই হরমোনের নিঃসরণ ঘটায় রক্ত প্রবাহে। ফলে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য, এটা দেহের স্বাভাবিক আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা। ‘হয় মর নয় তো মার’- এরকম আরকি।
বেঁচে থাকতে তাই কর্টিসল হরমোনের এই উপকারের কথা জানার পর, মনে হতেই পারে এটা খুব একটা খারাপ নয়।
তবে সমস্যা তখনই শুরু হয় যখন অতি মাত্রায় কর্টিসল হরমোন উৎপন্ন হয় বা স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে যায় না।
রক্ত প্রবাহে অতি মাত্রায় এই হরমোনের উপস্থিতি মানসিক ও শারীরিক অবস্থার জন্য ক্ষতিকর।
উচ্চ মাত্রায় কর্টিসল থাকার লক্ষণ
কর্টিসলের জোয়ার-ভাটা প্রাকৃতিভাবেই দেহে ঘটতে থাকে। আর মানসিক চাপে ভুগলে পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে উদ্ধার পাওয়া যায়।
“তবে অতিরিক্ত ও অনেকদিন ধরে মানসিক চাপে ভুগলে ধরে নেওয়া যেতে পারে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা দেহে বেশি মাত্রায় রয়েছে। এক্ষেত্রে রক্ত, প্রস্রাব ও লালা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব”- বলেন ডা. হাফম্যান।
এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে আছে
ঘুমের সমস্যা: মানসিক চাপে থাকলে ভালো ঘুম হয় না। হয়ত ঘুমাতে সমস্যা হয়, ঘুম আসে না- অথবা দুটোই ঘটে।
পেশির দুর্বলতা: দেহের প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেইট প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলে কর্টিসল। যদি সাধারণ ব্যায়াম করার পরে দুর্বল ও অবসন্ন অনুভূত হয় তবে হতে পারে সেটা কর্টিসল বৃদ্ধি কারণ।
উৎকণ্ঠা: হয়ত অস্বস্তি বোধ হবে, হৃদগতি অস্বাভাবিক বা বুক ধরফর করতে পারে, নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা মনে হবে।
স্মরণশক্তি: কোনো কিছু মনে করা ও মনোযোগ দেওয়া কষ্টকর মনে হবে।
সব সময় শীত লাগা: অতিমাত্রায় থাকা কর্টিসল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দিতে পারে। যে কারণে ভাইরাস ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা দেহের কমে যায়।
ইরিটেবল বাওয়েল সিস্টেম: অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম’য়ের সাথে স্নায়ুতন্ত্রের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। মানসিক চাপ অন্ত্রের নড়াচাড়ায় প্রভাব ফেলে যে কারণে হজম-জনিত নানান সমস্যা দেখা দেয়।
নারীদের অতিরিক্ত লোম গজানো: উচ্চ মাত্রায় কর্টিসল থাকার কারণে লোমকূপ অতিসক্রিয় হয়ে যায়। ফলে অনেক নারীর গোঁফের রেখা দেখা দেওয়া-সহ দেহের বিভিন্ন জায়গায় লোম গজানোর পরিমাণ বেড়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ মাত্রায় কর্টিসলের প্রভাব
কর্টিসল প্রয়োজনীয় হলেও এর উচ্চ মাত্রা ও দীর্ঘকাল মানসিক চাপে ভুগলে দেহের অন্যান্য হরমোন প্রক্রিয়াতে বাধা দেয়। যেমন- বিপাকপ্রক্রিয়া, রোগ প্রতিরোধ ও জন্ম দেওয়া ক্ষমতায় বিরুপ প্রভাব ফেলে।
যৌন তাড়না কমায়: সব সময় কর্টিসলের মাত্রা বেশি থাকার ফলে যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যেতে পারে। বেশি মাত্রায় উৎপন্ন করতে করতে অ্যাড্রিনাল গ্রন্ত্রি এক সময় আর এই হরমোন পর্যাপ্ত হারে তৈরি করতে পারে না। ফলে কর্টিসলের মাত্রা কম থেকে যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যায়।
মাসিক অনিয়মিত বা বন্ধ হওয়া: মানসিক চাপে থাকার কারণে অতিরিক্ত এন্ডোর্ফিন্স এবং কর্টিসল উৎপন্ন হয়, যা ডিম্বস্ফোটন ও এই সংক্রান্ত হরমোন তৈরিতে বাধা দেয়। ফলশ্রুতিতে মাসিক চক্রে ব্যঘাত ঘটে।
মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা: দীর্ঘকাল মানসিক চাপে ভোগার সাথে নানান মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। যেমন- বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা। কর্ম শক্তি ও ভরসা হারানোর মতো পরিস্থিতির কারণে ড্রাগ, অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে যায়।
প্রাকৃতিকভাবে কর্টিসল কমাতে দীর্ঘমেয়াদি অভ্যাস
স্বাস্থ্যকর মাত্রায় কর্টিসল থাকা দেহের জন্য উপকারী। নিচের পন্থাগুলো পালন করতে পারলে এই ‘স্ট্রেস হরমোন’ স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা সম্ভব হয়।
পর্যাপ্ত ঘুম: সার্বিকভাবেই সুস্বাস্থের জন্য ভালো ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে। সেই সাথে কর্টিসলে স্বাভাবিক মাত্রা ধরে রাখতেও দরকার।
ভালো মতো ঘুমের জন্য যা করা যায় তা হল-
প্রতিদিন ব্যায়াম করা: “মানসিক চাপ কমানোর ভালো অস্ত্র হল শরীরচর্চা”- একই প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন নিবন্ধিত মার্কিন সেবক জুং ব্যাকাম।
প্রায় প্রতিদিন ৩০ মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন তিনি। সেটা হতে পারে- দ্রুত হাঁটা, ইয়োগা কিংবা রান্না করতে করতে নৃত্য করা।
ব্যায়াম ঘুমের মান উন্নত করে, মানসিক চাপ দূরে রাখে পাশাপাশি ভালো অনুভূতির হরমোন সেরোটনিন এবং এন্ডোর্ফিন্স নিঃসরণ বাড়ায়।
শিথিলতার কৌশল রপ্ত করা: গভীর নিঃশ্বাসের ব্যায়াম বা পেশি শিথিল করার মাধ্যমে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমানো যায়।
হাফম্যান বলেন, “গভীর শ্বাস, ধ্যান, ইয়োগা- মানসিক চাপ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারে। পাশাপাশি হৃদগতিও কমায়।
এই বিষয়ে আরও পড়তে পারেন
নিজের মানসিক চাপ সম্পর্কে জানা: নর্দান ক্যালিফোর্নিয়ার মানসিক রোগের চিকিৎসক সামিয়া এস্টার্ডা বলেন, “চাপে থাকাটা মানসিক না শারীরিক সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে।”
তিনি উদাহরণ দেন- ধরা যাক একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে আপনার দিকে। সেটা কাটাতে দ্রুত ফুটপাথে উঠে গেলেন। এই ধরনের মানসিক চাপ কিন্তু ভালো ফল দিল। আর এক্ষেত্রে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে গিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।
আবার চাকরি হারিয়েছেন এখন কীভাবে চলবেন বা বিলগুলো কীভাবে পরিশোধ করবেন?- সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে মানসিক চাপে পড়তে পারেন। এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে কর্টিসলের মাত্রা দীর্ঘমেয়াদে দেহে বেড়ে গেল। ফলে দেহ সতর্ক হয়ে অতিরিক্ত কাজ করা শুরু করলো।
তাই মানসিক চাপের কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে কার্টিসলে মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
আনন্দ দেয় এমন শখ বের করা: জীবনে মানসিক চাপের সব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তবে নিয়মিত আনন্দদায়ক কাজে যুক্ত থাকতে পারলে নিজেকে শান্ত রাখা সম্ভব হয়।
স্বাস্থ্যকর পন্থায় মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানো, মেজাজ ঠিক করার মাধ্যমে দেহকে অভ্যস্ত করানো সম্ভব।
চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য করা বা প্রিয় বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটানো বা ভ্রমণ করা মতো বিষয়গুলো বেশ কার্যকর।
ভ্রমণ মানেই যে দূরে কোথাও অর্থ খরচ করে যেতে হবে এমন কোনো মানে নেই। বন্ধু বা প্রিয়জনদের নিয়ে আশপাশে ঘোরাও মানসিক চাপ কমাতে পারে।
স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা: ব্যাকাম বলেন, “জোরালে সামাজিক যোগাযোগ মানসিক চাপ কমাতে কার্যকর।”
যদি আশপাশের মানুষ আপনাকে নিয়ে চিল্লায় তবে তাদের সাথে স্বাস্থ্যকর দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
তিনি উৎসাহ দেন, “আসলে সব সময় সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। তবে আপনি কী বেছে নেবেন সেটার নিয়ন্ত্রণ আপনার কাছে।”
প্রিয় মানুষদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা বা কোনো ক্লাবে যোগদান করার মাধ্যমে মানসিক সহচার্য পাওয়া সম্ভব।
মনে রাখতে হবে মানসিক চাপ স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া এবং জীবনের অংশ। মাঝে মধ্যে হতেই পারে।
তবে এটা যদি অন্যের সাথে আপনার সম্পর্কে ঝামেলা তৈরি করে, মানসিক বা শারীরিক স্বাস্থ্যে বাজে প্রভাব ফেলে জীবনের মান কমে যায় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আরও পড়ুন
পাঁচ মিনিটে মানসিক চাপ কমানোর ৭ কৌশল