মানসিক প্রশান্তির জন্য ছোটবেলার শখগুলো বড়বেলাতেও পূরণ করা যেতে পারে।
Published : 15 Apr 2025, 06:17 PM
শৈশব মানেই ছিল অবাধ কল্পনা, খেলার মাঠে ছুটোছুটি, হাতে রং আর কাগজ নিয়ে বসে যাওয়া কিংবা বৃষ্টির দিনে জানালার পাশে বসে গল্প লেখা।
তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব আনন্দধর্মী, সৃজনশীল অভ্যাসগুলো জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। কাজের চাপ, দায়িত্বের ভার আর সময়ের অভাব শৈশবের সেই খেলাধুলা ও শখের জগৎ থেকে সরিয়ে দেয়।
অথচ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘চার্লি হেল্থ’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ক্যারোলাইন ফেনকল মনে করেন, “শৈশবের সেই পুরানো শখগুলোতেই লুকিয়ে রয়েছে মানসিক সুস্থতা ও জীবনের গভীর প্রশান্তির চাবিকাঠি।”
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই লেখিকা বলেন, “ছয় বছর বয়সে আমাকে ব্যালে ক্লাসে ভর্তি করা হয়। ব্যালে নিয়ে আমি রীতিমতো মুগ্ধ ছিলাম। সোয়ান লেক বা নাটক্র্যাকার-এর বার্বি ভার্সনগুলো আমার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু ক্লাসে গিয়ে আমার অস্বস্তি হত। টাইট লিওটার্ড, কঠোর নিয়ম, আর অন্যদের চোখে নিজেকে ‘প্রমাণ’ করার চাপ, এই সব কিছু আমাকে পিছিয়ে দেয়। মনে হত আমি যেন একটা সামাজিক অভিনয়ের মধ্যে পড়েছি, যেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।”
এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন, বয়সের জন্য অনেকেই মনে করেন, তারা আর নতুন কিছু শেখার বা পুরানো শখে ফেরার সুযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন।
বড় হওয়ার অর্থই হল আরও অভিজ্ঞ হওয়া, নিজের পছন্দ-অপছন্দ বোঝা এবং নিজের মতো করে জীবনকে গড়ে তোলার সুযোগ পাওয়া।
তিনি আরও বলেন, “আজ আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে নিজেকে আরও আত্মবিশ্বাসী মনে করি। তাই আবার ব্যালে শুরু করলাম। ক্লাসে ফিরে গিয়ে দেখি, এটা শুধু শরীরচর্চা নয়—এটা আত্ম-প্রকাশের এক অসাধারণ মাধ্যম।”
এখন প্রশ্ন হল শৈশবের অনেক শখ ও স্বপ্ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেলে শখগুলোতে কি আবার ফিরে যাওয়া যায়?
ডা. ক্যারোলাইন ফেনকল মনে করেন, “শৈশবের শখে ফিরে যাওয়া কেবল নস্টালজিয়া বা স্মৃতিকাতরতা নয় বরং এটি মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এক অসাধারণ ও প্রাকৃতিক থেরাপি।”
বাংলাদেশের মতো কর্মব্যস্ত ও চাপপূর্ণ সমাজে যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা এখনও সীমিত, সেখানে এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো মানসিক শান্তি ও আত্মতৃপ্তির এক বড় উৎস হতে পারে।
“খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ শুধু শিশুরাই করে এমন নয়। বয়স বাড়লেও মানুষের মস্তিষ্ক ‘খেলতে’ চায়, নতুন কিছু শিখতে চায় এবং সৃজনশীলতায় লিপ্ত হতে চায়” বলেন ড. ফেনকল ।
প্লে থেরাপি, গান, নাচ, নাটক, পাজল বা ধাঁধা এই সবই কর্টিসল (স্ট্রেস বা চাপের হরমোন) কমিয়ে ডোপামিন (আনন্দের হরমোন) বাড়ায়। এতে মানসিক চাপ কমে, উদ্বেগ কমে, মস্তিষ্ক সক্রিয় হয় এবং মানুষ নিজের সঙ্গে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত হতে পারে।
এই অভ্যাসগুলো কীভাবে কাজে আসতে পারে?
আমাদের দেশে মানসিক চাপ, একাকিত্ব এবং কাজের ক্লান্তি খুব সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্কুল-কলেজ পেরিয়ে চাকরি, পরিবার আর সামাজিক দায়িত্বে জড়িয়ে নিজেদের পছন্দগুলো প্রায় ভুলেই যাওয়া হয়। তবে এই শখগুলো আবার শুরু করলে মানসিক প্রশান্তি যেমন বাড়বে তেমনি শৈশবের সেই সরল আনন্দগুলোও ফিরবে জীবনে।
আঁকা, রং করা, পটারি বা হস্তশিল্প
একজন পেশাদার শিল্পী না হলেও সমস্যা নেই। একটি পেইন্ট-বাই-নাম্বার কিট, একটি সাধারণ রঙিন খাতা বা এয়ার ড্রাই ক্লে দিয়ে শুরু করা যায়।
কিছু না হোক, নিজের মতো করে কিছু সৃষ্টি করার মধ্যে যে শান্তি আছে, তা আসলে ব্যাখ্যা করা যায় না।
এখন অনেকেই ঘরে বসে আঁকা বা হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করেন। বিশেষ করে ফেইসবুক বা ইনস্টাগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন পেইজ গড়ে উঠেছে। চাইলে সেখান থেকেও অনুপ্রাণিত হওয়া যায়।
মনের আনন্দে লেখা
শেষ কবে শুধু নিজের আনন্দের জন্য কিছু লিখেছেন— একটি কবিতা, একটি গল্প, হয়ত বা দিনপঞ্জি? হোয়াটসঅ্যাপ বা অফিস ইমেল বাদ দিয়ে কি কখনও কল্পনার জগতে ভেসে গিয়ে কিছু লিখেছেন?
এখন অনেক ‘অনলাইন রাইটিং কমিউনিটি’ এবং কর্মশালা চালু রয়েছে। চাইলে কোনো একটি ‘রাইটিং প্রম্পট’ নিয়ে লিখতে শুরু করতে পারেন, শুধু নিজের জন্য।
বাইরে খেলা বা ঘুরে বেড়ানো
বাগান করা, সাইকেল চালানো বা কাছের কোনো পার্কে বা নিরিবিলি সড়কে হাঁটা— এসব ছোট ছোট কাজই শরীর ও মনকে সতেজ করে।
দিনের মধ্যে কিছুটা সময় রাখুন শুধু নিজের জন্য, ঠিক ছোটবেলার মতো মুক্তভাবে খেলতে বা ঘুরে বেড়ানোর জন্য।
শহুরে জীবনে ব্যস্ততা বেশি হলেও অনেক এলাকায় এখন ‘সিটি সাইকেলিং ক্লাব’ বা হাঁটার দল চালু হয়েছে। চাইলে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে এমন কিছুও শুরু করা যায়।
দলগত খেলা বা নাচ শেখা
যদি শরীরচর্চা করতে চান কিন্তু ব্যায়ামাগারে যেতে ইচ্ছা না করে, তবে নাচ বা ব্যাডমিন্টনের মতো কিছু বেছে নেওয়া হতে পারে ভালো বিকল্প।
ঢাকাতে এখন অনেক প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য জুম্বা, সালসা, ব্যাচতা বা ক্ল্যাসিকাল নাচের ক্লাস রয়েছে। দলগত খেলা বা নাচে কেবল শরীরচর্চা হয় না, বরং এটি সামাজিক যোগাযোগও বাড়ায়।
বাদ্যযন্ত্র বাজানো বা গান গাওয়া
শিশুকালে হরমোনিয়াম বা তবলা শিখেছিলেন? কিংবা গিটার! এখনও সেটা ঘরে পড়ে আছে? এবার সময় এসেছে ধুলা ঝেড়ে আবার শুরু করার।
গবেষণা বলছে, বাদ্যযন্ত্র বাজানো মস্তিষ্কের একাধিক অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে এবং প্রতিক্রিয়া দ্রুত করে তোলে।
নিদিষ্ট স্থান কিংবা অনলাইনে অনেক গানের ক্লাস বা বাদ্যযন্ত্র শেখার কোর্স পাওয়া যায়। এই সুযোগগুলো ব্যবহার করে ফেলতে পারেন।
নাটক বা ইম্প্রোভ (অভিনয়)
হয়ত স্কুল জীবনে নাটকে অভিনয় করতেন বা কোনো নাট্যদলের সদস্য ছিলেন। তাহলে আবার ফিরে যেতে পারেন সেই মঞ্চে।
অনেক নাটকের দল এখন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করে। নাটকে অভিনয় আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, বক্তব্য দেওয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং সামাজিক দক্ষতা গড়ে তোলে।
পাজল ও বোর্ড গেমস
চ্যালেঞ্জিং খেলা বা ধাঁধার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
পাজল, স্ক্র্যাবল, লুডু, চেস— এসব খেলা সামাজিক যোগাযোগ বাড়ায়, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এমনকি চাইলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ‘পাজল সোয়াপ’ বা ‘গেইম নাইট’য়ের আয়োজন করা যায়। আমাদের দেশের এ ধরনের চর্চা কম তবে শুরুটা নিজের থেকেই হতে পারে।
আরও পড়ুন