সাত
দু'দিন ধরে বাড়ির পরিবেশটা বেশ গুমোট। সবই চলছে, কিন্তু কোথায় যেনো প্রাণ নেই। কোনো গান মনে না ধরলে দিদা যেমন বলেন, সুরটা ঠিক লাগছে না; অধরারও মনে হচ্ছে, বাড়ির সুরটা ঠিক মিলছে না। কোথায় যেনো একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে।
আজ বিকেলে অনলাইনে ক্লাশ শেষে অধরা নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছে, তখনই তার কানে আসে মায়ের কণ্ঠস্বর। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে কথা বলছেন মা। কিন্তু স্বরটা এত উঁচু যে, অধরা বাইরে থেকে মায়ের কথা শুনতে পাচ্ছে।
‘এত বড়ো একটা কথা আমার কাছে লুকানোর কারণ কী?’ বেশ রাগান্বিত হয়েই কথা বলছেন মা। অধরা বুঝতে পারছে না মা কার সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু মায়ের রাগটা অধরা বুঝতে পারছে তার কথোপকথন থেকেই।
আমি কি এই সংসারের কেউ না?...আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি কবে বাড়ি আসবে বলো। তোমার সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন।
এতক্ষণে অধরা বুঝল, মা বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাবাকে বাসায় আসার কথা বলছেন মা। এবার টানা প্রায় দু'মাসেরও বেশি হয়ে গেল বাবা বাড়ি আসছেন না। হাসপাতালেই থাকছেন।
কিন্তু অধরার যে খটকাটি কাটছে না তা হলো, বাবার সঙ্গে মা তো এভাবে কোনোদিন কথা বলেননি। তাহলে কী হলো আজ? এমন জরুরি কী কথা যার জন্য এই পরিস্থিতিতেও বাবাকে বাড়ি আসতে বলছেন মা? কিন্তু ভাবনাটা বেশিক্ষণ রইল না মনের কোণে। বাবা বাড়ি আসছেন, এটাই অধরার আনন্দ। কয়েকদিনের জন্য বাবাকে বাড়ি পাওয়া যাবে। অনেকদিন বাবাকে একটানা কাছে পায় না অধরা।
হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে হোটেলে তিনদিন কোয়ারেন্টাইন করে বাবা বাড়ি এলেন। যদিও বাসায় এসেও আরও ৪-৫ দিন বাবা আলাদা ঘরেই থাকবেন। খাওয়া-দাওয়া সবই হবে আলাদা। তবুও বাবা বাড়ি এসেছেন, এতেই খুশি অধরা।
সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছেন দিদার দিকে। কেবল বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন । দিদার কণ্ঠে কোনো উত্তাপ নেই।
বাবা বাড়ি আসার পর বাড়ির পরিবেশটা একটুখানি বদলালো। কয়েকদিনের সেই গুমোটটা এখন নেই। আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দিদাও যেনো আগের চেয়ে ভালো আছেন। এখন দিনের বেশ কিছুটা সময় গান করেন। তারপর রান্না করেন বাবার প্রিয় খাবারগুলো। মা দিদাকে রান্নার কাজে সাহায্য করেন। অধরাও অনলাইন ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে তাতে হাত লাগায়।
বাবা আসার আগেই গেস্টরুমটা ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন মা। নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে তিনি অধরা, দিদা আর মায়ের সঙ্গে গল্প করেন। তার ফাঁকে ফাঁকে ল্যাপটপে কাজ করেন। ছুটি নিলেও রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ তিনি অনলাইনে দেন।
দিদাকে সেই ছবিটা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করেনি অধরা। এমনকি এটাও জানতে চায়নি, তার যদি ফুমণি থেকেই থাকে, তবে তিনি কোথায়?
আট
সেদিন দুপুরে খাবার সময়ই দিদা বললেন, বিকেলের চা-আড্ডায় কিছু কথা বলবেন তিনি। অধরা তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও বেশ লক্ষ করলো, বাবা-মা দুজনেই কেমন যেনো চুপ হয়ে গেলেন।
বিকেল গড়াতেই দিদা যেনো আগের মতো হয়ে গেলেন। বেশ যত্ন করে বিকেলের নাশতা বানালেন। চায়ের জল চড়িয়ে বারান্দার গাছগুলোতে জল দিলেন। অধরাও হাত লাগালো দিদার সঙ্গে।
চা আর জলখাবার নিয়ে দিদা ঢুকলেন বসার ঘরে। মা আগেই বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। দিদাকে দেখে মা উঠে দাঁড়িয়ে ট্রে-টা হাতে নিলেন। সদ্য ভাজা নিমকির দুটো প্লেট নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। চা আর জলখাবার দিদা নিজের হাতে পরিবেশন করলেন। তার চোখে-মুখে এক চিলতে প্রশান্তির রোদ যেনো ঝলমল করছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে দিদাই কথা শুরু করলেন, অনি, সেদিন অধরা আমাদের ৬০ বছর আগের একটি ছবি দেখেছে। আসলে নমিতার মৃত্যু আমাকে সেই দুঃসহ দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমার মনে হয়, যা হয়েছে, ঠিকই হয়েছে। রুশমিলা আর অধরার জানা উচিত আমাদের পরিবারের কষ্টগুলো।
সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছেন দিদার দিকে। কেবল বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন । দিদার কণ্ঠে কোনো উত্তাপ নেই। তিনি বলতে শুরু করলেন, অধরা, তুমি সেদিন যার ছবি দেখেছিলেন, তার নাম অনুপমা। আমরা তাকে অনু বলে ডাকতাম। আমাদের প্রথম সন্তান অনুপমা। বড়ো আদরের। তোমার বাবা অনির্বাণ তার থেকে ৫ বছরের ছোটো। ফুলার রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাসভবনে ছিল আমাদের ছোট্ট সংসার।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিদা চুপ করে রইলেন। বাইরে তখন নরম অন্ধকার নেমে আসছে। সন্ধ্যা নেমে এলো মাত্রই। কখন যে এতটা সময় গড়িয়ে গেলো, টেরই পায়নি অধরা। দিদা হেলান দিয়ে বসলেন তার চেয়ারে। তারপর স্মৃতি হাতড়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের জেনোসাইডের কথা তো তোমরা জানো। বিশ্ববিদ্যালয় জ্বলছে। ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড। আমরা থাকতাম আবাসিক কোয়ার্টারের ৩৪ নম্বর ভবনে। এ ভবনের নিচতলাতেই থাকতেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। স্যারকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে কথাও তোমরা জানো। কী যে দুর্বিষহ একটি রাত ছিল!
কোনো রকমে পালিয়ে সে রাতে বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা, অধরার বাবাও দিদার সঙ্গে যোগ করলেন। দিদা কেবল মাথা নাড়লেন। ২৭ তারিখ কারফিউ উঠল, অল্প সময়ের জন্য। সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে পথে নেমে পড়লাম আমরা। নারায়ণগঞ্জে অনির দাদাবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। কখনো বা কিছুটা পথ রিক্সা পেলাম। এভাবেই পৌঁছালাম নারায়ণগঞ্জে। মাসখানেক ছিলাম সেখানে।
অধরা নিজের জায়গাটি ছেড়ে উঠে এসে বসল দিদার পাশে। দিদা অধরার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা তখন ক্লাশে যাচ্ছেন না, তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে মিলিটারি। আমাদের বাড়ির তালা ভেঙে ভাঙচুর করা হয়েছে। অনির দাদু তখন আমাদের বললেন, ভারতে চলে যেতে। অনির বাবাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
তখন নমিতা খালাও দাদুবাড়ি এসেছিলেন, তাই না মা? প্রশ্ন করলেন অধরার বাবা।
না বাড়িতে আসেননি। তোমার বাবাই যোগাযোগ করেছিলেন নমিতাদের সঙ্গে। ওদের সঙ্গে আরও দুটো পরিবার যাবে সীমান্ত পার হয়ে। তোমার বাবাই নানা জায়গায় কথা বলে জানালেন, কুমিল্লা দিয়ে বর্ডার পার হয়ে আগরতলা ঢোকার পথটা নিরাপদ। তারপর মে মাসের ৮ তারিখে আমরা রওনা হলাম। শ্বশুরমশাই আমার হাতে কিছু টাকা দিলেন। আর মা দিলেন দু'গাছা চুড়ি। বিদেশ বিভূঁইয়ে বিপদে কাজে লাগবে।
তারপর? এতক্ষণে কথা বললেন অধরার মা রুশমিলা।
দিদা তখন অতীতের কথা ভাবছেন। তার চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, সাত বছরের মেয়ে, আড়াই বছরের ছেলে আর অল্পকিছু পরার কাপড় নিয়ে বের হলাম অনিশ্চয়তার পথে। কিছুটা পথ নৌকায় গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নেমে হেঁটে আখাউড়া হয়ে বর্ডার পার হতে হবে। ৮ তারিখ ভোরে আলো ফোটার আগেই শীতলক্ষ্যায় নৌকায় উঠলাম আমরা তিন পরিবার। মাঝি বলে দিয়েছিলেন, বিপদ দেখলে তিনি সংকেত দিবেন আর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা চলে যাবো নৌকার পাটাতনের নিচে। সনাতন ধর্মের নারীদের শাঁখা খুলে ফেলতে হলো। যারা বিবাহিত ছিলেন, তাদের সিঁদুরও মুছে ফেলতে হলো। প্রায় দেড় দিন পর নৌকা ভিড়লো তিতাসের একটি ঘাটে।
অধরা অপলক শুনছে দিদার কথা। দিদা মুক্তিযুদ্ধের কত গল্প বলেছেন, কিন্তু এই কথাগুলো কখনোই শোনেনি সে। আজ যখন দিদা কথা বলছেন, তখন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে অধরা।
কিন্তু দিদা কাঁদছেন না। তিনি স্থির চোখে বললেন, কতক্ষণ যে বসে রইলাম, জানি না। হঠাৎ শুনি ‘মিলিটারি, মিলিটারি...’।
পথ চলতে চলতে কতবার নৌকা লুকাতে হয়েছে ঝোঁপের আড়ালে। মিলিটারির নৌকা চলে গেলে আবার আমরা সাবধানে যাত্রা শুরু করেছি। খাবার বলতে শুকনো চিড়া, গুড় আর সামান্য মুড়ি। প্রথম দু'বেলা সব বাচ্চাদের খাওয়া হয়েছে এসব দিয়েই। বড়োরা না খেয়েই ছিলাম। কোনো বাজারেও নৌকা থামানো যায়নি। সব বাজার-হাট পুড়ে গেছে। দাউ দাউ জ্বলছে সব জনপদ।
দিদা একটু থামলেন। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছলেন। চশমাটা হাতে রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে, দৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই।
প্রায় তিনদিন পর সন্ধ্যা নামতেই বর্ডারের পথে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। পথে নেমে দেখি কত মানুষ! কাউকে কাউকে টুকরিতে বসিয়ে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বনের ভেতরের পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে। নিরাপদে যাবার জন্য মানুষ পথেহাঁটা রাস্তা বাদ দিয়ে চলছে ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে, নালা-খাল পেরিয়ে। আমার কোলে অনির্বাণ আর অনুপমা ওর বাবার কাঁধে। অন্ধকারে পথ হাঁটা খুব কষ্টের।
ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর অনুকে কাঁধ থেকে নামিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দেন ওর বাবা। আমিও বাঁ হাতে অনুকে ধরে ডান কাঁখে অনিকে নিয়ে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
এবার আর দিদার গলা শান্ত থাকল না। হঠাৎ দিদা বেশ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অধরার মা উঠে এসে বসলেন দিদার পাশে। তাকে জড়িয়ে ধরলেন। মায়ের চোখেও তখন জল।
দিদা কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সূর্য যখন উঠল, তখন হঠাৎ খেয়াল হলো বাঁ হাতটা ফাঁকা। অনু কোথাও নেই। ওর বাবাকে বলতেই উনি পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে লাগলেন। কিন্তু কোথায় খুঁজবেন অনুপমাকে? চারপাশে মানুষ আর মানুষ। সবাই হেঁটে চলছেন মৃত্যুভয়ে। এর মধ্যে কোথায় পাবো আমার অনুপমাকে?
সবাই খুঁজছে...কিন্তু কোথাও তো নেই আমার অনুপমা। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লাম।
তারপর? মা প্রশ্নটা করতেই অধরা শুনতে পেল বাবার কান্নার শব্দ।
কিন্তু দিদা কাঁদছেন না। তিনি স্থির চোখে বললেন, কতক্ষণ যে বসে রইলাম, জানি না। হঠাৎ শুনি ‘মিলিটারি, মিলিটারি...’। অনির বাবা আমার হাত ধরে টেনে তুললেন। এরপর কতক্ষণ ছুটলাম জানি না। একসময় বুঝতে পারলাম, আমরা পৌঁছে গেছি আগরতলা বর্ডারে।
অধরার মা রুশমিলা দিদাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কিন্তু দিদা কাঁদছেন না। ডান হাতে মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু আমার অনুকে আর খুঁজে পেলাম না।
অধরার মা কেঁদে কেবল একবার ডাকলেন, মা...
দিদা দু চোখ বন্ধ করে বললেন, তুমিই তো আমার মা। আমার স্বাধীনতা।
অধরা দিদার বুকে এসে মাথা রাখল। দিদার দু চোখ বন্ধ।
তিনি যেনো তার হারানো অনুপমাকে দেখতে পাচ্ছেন, লাল-সবুজের প্রাণের পতাকায়, ভায়ের মায়ের স্নেহে গড়া এই বাংলাদেশে।
আগের পর্ব