পুরোনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি হতো পুতুলের জামা। পুতুলের বিয়ে হতো। বন্ধুরা সবাই মিলে মেঝেতে বসে কলাপাতায় খেতো।
Published : 28 Apr 2023, 03:03 PM
মহামারীর এই সময়টা বাইরে যাওয়া বন্ধ। অধরার স্কুলও বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। তার বাবা অনির্বাণ পেশায় ডাক্তার। বাবাকে হাসপাতালে যেতেই হয়। তাই বাবা হাসপাতালের পাশে একটি হোটেলে থাকেন আরও অনেক ডাক্তার আঙ্কেল-আন্টির সঙ্গে। কোনো কোনোদিন রাতে রোগীদের অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে যে, বাবা হোটেলেও ফিরতে পারেন না। হাসপাতালেই থাকতে হয় ২৪ ঘণ্টা।
ব্যস্ততার মাঝেও বাবা কখনো কখনো ভিডিওকল করেন। বাবার সঙ্গে অধরার কথা হয় ভার্চুয়ালি। প্রথম প্রথম বাবা যখন হাসপাতালে থাকতে শুরু করেছিলেন, তখন ক্যান্টিনের বাবুর্চি কাকু করোনার ভয়ে পালিয়ে যান। তখন বাবার খাওয়ার খুব কষ্ট হয়েছিল। বাড়ি থেকে খাবার পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না। কোনো রকমে কলা, পাউরুটি, বিস্কুট খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। পরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য রান্না করা খাবার দিয়ে যেতেন দুবেলা। এখন অবশ্য হাসপাতালের ক্যান্টিন আবার চালু হয়েছে।
অধরার মা রুশমিলা একটি নামি কর্পোরেট অফিসের এক্সিকিউটিভ। মায়ের অফিস এখনও ওয়ার্ক ফ্রম হোম করাচ্ছে। তবে শোনা যাচ্ছে, অচিরেই সপ্তাহে ২/৩ দিন করে অফিসে যেতে হবে। মা সকালের নাশতা তৈরি করে টেবিলে দিয়ে, দুপুরের রান্নার যোগাড়যন্ত্র করে নিজের ঘরে চলে যান। তখন ফোন আর ল্যাপটপে শুরু হয় মায়ের অফিস। দুপুরে খাবার সময় একটু বের হন, তারপর একেবারে সন্ধ্যা সাতটায়। কখনো কখনো আটটা-নটাও বেজে যায়।
দিদা কাপড়ের পুতুল বানিয়ে দিতেন। জুতোর বাক্সে ঘর বানিয়ে সেখানে শক্ত কাগজের খাট, চেয়ার আর কাপড় রাখার তাক বানিয়ে পুতুলের সংসার সাজিয়ে দিতেন। দিদার পুরোনো শাড়ি আর মায়ের পুরোনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি হতো পুতুলের জামা।
অধরার সারাদিন কাটে ওর দিদার সঙ্গে। সকালে উঠে নাশতা করেই অনলাইন ক্লাশ করতে হয় ৮টা থেকে ১১টা। তারপর দিদাকে রান্নার কাজে সাহায্য করে। কখনো কখনো দিদার কাছে রান্নাও শেখে। মাঝে মাঝে ডায়রিতে টুকে রাখে দিদার শেখানো রেসিপি। দুপুরে খেয়ে দিদার বিছানাতে শুয়েই নানা গল্প করে অধরা। কখনো নিজের স্কুল আর বন্ধুদের গল্প, কখনো ক্লাশে যাবার দিনগুলোর গল্প। কোনো কোনোদিন আবার দিদার কাছে গল্প শোনার বায়না ধরে অধরা।
অধরার দিদা একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। খুব ভালো গান করেন তিনি। একটি গান শেখানোর ক্লাশও ছিল দিদার। কত ছাত্র-ছাত্রী এখনও খোঁজ নেন দিদার। দেখা করতে আসেন, নিজেদের গানের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করতে আসেন। এই লকডাউনেও দিদার বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর গানের লাইভ অনুষ্ঠান হয়েছে ফেইসবুকে। কখনো দিদার, কখনো মায়ের মোবাইল থেকে তাদের অনুষ্ঠান দেখেছে অধরা আর তার দিদা। কারও কারও গান তো অধরার ভীষণ ভালো লাগে। গান শুনতে শুনতে দিদাও সেই শিক্ষার্থীর গল্প করেন। আবার কখনো কারও গায়কির একটি বিশেষ অংশে হঠাৎ দিদার ভ্রু কুঁচকে যায়। মাথা নেড়ে বলেন, উঁহু! সুরটা লাগলো না।
অধরাও দিদার কাছেই গান শেখে। সে-ই এখন দিদার গানের ক্লাশের একমাত্র শিক্ষার্থী। দিদাই অধরার বন্ধু। মা ডিভাইসে খেলার সময় বেঁধে দিয়েছেন দিনে এক ঘণ্টা। টিভি দেখার সময়টাও নির্ধারিত; যদিও লম্বা সময় ধরে টিভি দেখতে ভালো লাগে না অধরার। তার চেয়ে দিদার গল্পতেই অধরার সুখ বেশি। আর ভালো লাগে দিদার হাতে মজার সব রান্না। দিদা যখন পিঠা বানান, কিংবা বিকেলের জলখাবারে সমুসা, কিমা পরোটা, লবঙ্গ লতিকা বা কুচো নিমকি বানান, তখন অধরাও পাশে বসে পড়ে একটি বেলুন-পিঁড়ি নিয়ে। দিদা হাতে ধরে তাকে শেখান।
অধরা যখন আরও ছোটো ছিল, তখন দিদাই ছিল তার পুতুল খেলার সাথী। দিদা কাপড়ের পুতুল বানিয়ে দিতেন। জুতোর বাক্সে ঘর বানিয়ে সেখানে শক্ত কাগজের খাট, চেয়ার আর কাপড় রাখার তাক বানিয়ে পুতুলের সংসার সাজিয়ে দিতেন। দিদার পুরোনো শাড়ি আর মায়ের পুরোনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি হতো পুতুলের জামা। পুতুল বিয়ে হতো। তখন বন্ধুদের ডেকে খাওয়া-দাওয়াও হতো। সবাই মিলে মেঝেতে বসে কলাপাতায় খাওয়া হতো। সেই কলাপাতাও যোগাড় করতেন দিদা। অধরা সঙ্গে সঙ্গে থাকতো।
অধরা এখন আর পুতুল খেলে না। তবে দিদার ঘরে পুতুলগুলো আর তাদের ঘর-সংসার যত্ন করে সাজানো আছে।
সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও কত বড়ো বড়ো মানুষের কথা বলেন দিদা। কাছ থেকে যাদের দেখেছেন। দিদার কাছে গল্প শুনতে শুনতে তাদের বড্ডো আপন মনে হয় অধরার।
দুই
দাদুকে দেখেনি অধরা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বাবা-মায়ের বিয়ের পরপরই দাদু মারা যান। দিদার কাছে শুনেছে, দাদু নাকি খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অধরার দাদু ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা। সেখানে তিনি খবর ও কথিকা পড়তেন, আবৃত্তি করতেন।
দিদাও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। দিদার কাছে গল্প শুনতে বসলেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গল্প করতেন। একাত্তরের নয়মাস কোলকাতা থাকার অভিজ্ঞতা বলতেন। সমর দাশ, অজিত রায়, রথীন্দ্রনাথ রায়, কল্যাণী ঘোষ, শাহীন মাহমুদ, ডালিয়া নওশীন, তিমির নন্দী, মাহমুদুর রহমান বেনু- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কত বড়ো বড়ো সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গে গান করেছেন দিদা! কতসব কালজয়ী গানের কথা বলেন! গানগুলো কীভাবে সৃষ্টি হলো, গীতিকার কীভাবে লিখেছিলেন, সুরকার কীভাবে সুর দিয়েছিলেন, কেমন করে হতো রিহার্সাল তারপর রেকর্ডিং...দিদার কাছে শুনতে শুনতে অনেক গানের নেপথ্য গল্প অধরার মুখস্থ হয়ে গেছে।
কোভিডের আগে অধরার স্কুলে একুশের গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদের ওপর একটি উপস্থিত বক্তৃতার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র অধরাই বলেছিল, কীভাবে ঢাকায় বসে গানে সুর দিয়ে স্পুলে করে সেটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠাতেন আলতাফ মাহমুদ। কীভাবে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সঙ্গে। এসব গল্প অধরা দিদার কাছেই শুনেছে। শহীদ আলতাফ মাহমুদের ওপর অধরার উপস্থিত বক্তৃতা শুনে স্কুলের শিক্ষকরা যেমন তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন; তেমনি বন্ধুরাও ভীষণ খুশি হয়েছিল। মিথিলা তো বক্তৃতা শেষ হতেই অধরাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আই অ্যাম সো প্রাউড অব ইউ অধরা। গোটা ক্লাশের হাততালি পেয়ে অধরার একটু লজ্জাও লাগছিল সেদিন।
দিদার কাছে অধরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেকগুলো গান শিখেছে। এই লকডাউনের সময় তুলছে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই...’ গানটি। এটা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। দিদা কী সুন্দর করে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সকালেই শহীদুল হক খান গানটি লেখেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী বিকেলে আত্মসমর্পন করলেও, তারা যে পরাজিত- এ খবর সকাল থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিসে। গানটি সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম আর কোরাসে গাওয়া গানটি লিড করেছিলেন শিল্পী অজিত রায়। গানটি এখনও পরিপূর্ণভাবে গলায় তুলতে পারেনি অধরা। প্রতিদিন একটু একটু করে রিহার্সাল করে। ভুল হলে শুধরে দেন দিদা।
সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও কত বড়ো বড়ো মানুষের কথা বলেন দিদা। কাছ থেকে যাদের দেখেছেন। দিদার কাছে গল্প শুনতে শুনতে তাদের বড্ডো আপন মনে হয় অধরার। এদের কাউকে কাউকে অধরা অবশ্য দেখেছে; কিন্তু অনেককেই দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওর। সালেহ আহমেদ নামে খবর পড়তেন সৈয়দ হাসান ইমাম, চরমপত্র পড়তেন এম আর আখতার মুকুল। সংবাদ বিভাগ দেখতেন কামাল লোহানী। অধরার দাদু ছাড়াও আবৃত্তি করতেন আশরাফুল আলম। কখনো কখনো খবরের কাগজ বা টেলিভিশনে গল্পে শোনা এই বড়ো মানুষদের দেখলে দিদা চিনিয়ে দিতেন। কেমন যেনো আপনজন মনে হতো এদের। দাদুকে তো সে দেখেনি, তাই দাদুর সহযোদ্ধাদের মধ্যেই যেন নিজের দাদুকে খুঁজে পেত অধরা। তাই যাদেরই সে দেখে না কেনো, তার একটাই সম্বোধন—‘দাদু’।
এই করোনার মধ্যে কয়েকদিন আগেই একজন চলে গেলেন। খবরের কাগজ ও টেলিভিশনে তার ছবি এসেছে। দিদা চিনিয়ে দিলেন, তার নাম কামাল লোহানী- সাংবাদিকতা করেছেন, নৃত্যশিল্পী ছিলেন।
কামাল লোহানী দাদুর মৃত্যুর পর দিদার মনটা খুব ভার হয়েছিল। অধরাও এসময় দিদার কাছে কোনো বায়না ধরে না। চুপচাপ দিদার পাশে শুয়ে বসে থাকে। ঘটনার দু'তিনদিন পর দিদার মনটা একটু হালকা হয়েছে ভেবে অধরা তার পাশে গিয়ে বসল। দিদা তখন ব্যালকনির গাছে জল দিচ্ছিলেন। দিদার শাড়ির আঁচলটা নিজের হাতে পেঁচিয়ে অধরা বলল, টিভিতে দেখলাম লোহানী দাদুকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সমাধিস্থ করা হয়েছে। পুলিশ তখন নানা পজিশনে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো...
এটাকে বলে গার্ড অব অনার। অধরার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই উত্তর দিলেন দিদা। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাকে বড়ো একটি জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় আর গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
অধরা দিদার আরও কাছে ঘেঁষে জানতে চায় তার দাদুকেও এভাবে সম্মান জানানো হয়েছিল কিনা। স্মৃতিতে ডুবে যাওয়া দিদা যেন শুনতেই পাননি প্রশ্নটি। শুধু অজান্তেই মাথাটা একটু নাড়লেন।
চলবে...