হারানো হিয়া

দিদার কাছেই অধরা শুনেছে নামটি, 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীসংস্থা'। তারা শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে গান গাইতো।

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 7 May 2023, 10:25 AM
Updated : 7 May 2023, 10:25 AM

তিন

দিদার কাছেই অধরা শুনেছে আরেকটি নাম, 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীসংস্থা'। এই দলের সঙ্গেও কিছুদিন গান করেছিলেন দিদা। তারা শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছেন। পুতুল নাচের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন পাকিস্তানের জেনোসাইডের কথা। সেইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা কী করে লড়াই করছেন, পাকিস্তানিদের পরাজিত করছেন সম্মুখ যুদ্ধে, এসবও ছিল পুতুল নাচের মধ্যে।

সেদিন বিকেলে হঠাৎ দিদা অধরাকে ডেকে বললেন, টিভিতে ইউটিউবটা চালাতে। এসব ব্যাপারে অধরার কোনো তুলনা নেই। সে চটপট সব বন্দোবস্ত করে ফেলল।

দিদা বললেন, মুক্তির গান ডকুমেন্টারিটা চালাতে পারবে এখানে?

দিদার বলতে যতক্ষণ, অধরার খুঁজতে ততক্ষণ। ডকুমেন্টারিটা চালিয়েই অধরা বলল, এটা কিন্তু আগে আরও দুবার দেখেছি আমরা। লিয়ার লেভিন ফুটেজ নিয়েছিলেন। জানো দিদা, তিনি এখনও বেঁচে আছেন। আমি গুগল করে দেখেছি। উনার একটি ওয়েবসাইটও আছে।

ততক্ষণে ডকুমেন্টারি শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ চলছে। দিদা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টেলিভিশনের দিকে। ডান হাতে অধরাকে কাছে ডেকে বললেন, আগে যখন দেখেছিলেন, তখন তো তুমি 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীসংস্থার' কথা জানতে না...এবার দেখবে সবাইকে কেমন চিনতে পারো।

চারপাশে মানুষের কতো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অধরা তো ঘরবন্দী। স্কুলে যেতে পারলে তবুও বন্ধুদের সঙ্গে কিছু কাজ করার প্ল্যান করা যেত!

ট্রাকে করে শিল্পীদের শরণার্থী শিবিরে যাবার দৃশ্যটা আসতেই অধরার চোখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওই তো, দলনেতা মাহমুদুর রহমান বেনু দাদু। পুতুল নাচের দৃশ্যটি আসতেই দিদা আনমনে বলে উঠলেন, মন্টু ভাই।

অধরা বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে দিদার দিকে, আগেরবার না বলেছিলে মোস্তাফা মনোয়ার?

দিদা এবার আর হাসি থামাতে পারলেন না, আমরা মন্টু ভাই বলেই ডাকতাম। ওটা উনার ডাকনাম।

দিদা শিল্পীদের একেকজনকে দেখিয়ে অধরা জিজ্ঞেস করছেন, বলো তো কে?

অধরাও মনের সুখে উত্তর দিচ্ছে। সবাইকে ও চেনে, বিপুল ভট্টাচার্য, নায়লা জামান, লুবনা মরিয়ম, স্বপন চৌধুরী, শারমিন মুরশিদ, লতা চৌধুরী। আজ অবশ্য আরও নতুন দুজনকে চিনলো সে। মেজর গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ও আমিনুল হক বাদশা। দিদাই বলে দিলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক বাদশা ছিলেন প্রথম সহকারী প্রেস সচিব। সহকারী প্রেস সচিবের কাজও খানিকটা বুঝিয়ে দিলেন; কিন্তু অতোটা মাথায় নিতে পারলো না অধরা।

স্ক্রিনে তখন মুক্তির গানের এন্ড টাইটেল উঠছে। সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রে বাজানো জনতার সংগ্রাম চলবেই গানের সুর। দিদা আর অধরা গলা মিলিয়ে গাইলো, 'আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে, জনতার সংগ্রাম চলবে...'।       

রাতে খাবার পর সবাই মিলে বাবার সঙ্গে ভার্চুয়ালি গল্প করলো। গল্প বলতে সব অধরারই কথা। মা আর দিদা সারাক্ষণ চিন্তায় থাকেন। কখনো বাবাকে নিয়ে, কখনো বাবার অন্য সহকর্মী আংকেল-আন্টিদের নিয়ে, কখনো বা দেশে করোনায় যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের নিয়ে। এসব শুনে অধরারও মন খারাপ হয়ে গেল। চারপাশে মানুষের কতো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অধরা তো ঘরবন্দী। স্কুলে যেতে পারলে তবুও বন্ধুদের সঙ্গে কিছু কাজ করার প্ল্যান করা যেত।

রাতে দিদার পাশে শুয়ে কথাটি বলতেই দিদি বললেন, তোমরা যে অনলাইনে ক্লাশ করছো, সেখানে আলোচনা করো। আমরা সবাই তো প্রকৃতির সন্তান। সবাই মিলে হাত লাগালে দুঃসময় কাটবে না?

দিদার কথায় অধরা যেনো ভরসা খুঁজে পায়। দিদার হাতটা ধরে শুয়ে থাকে।

গ্যালারিগুলো দেখে লিফটে নিচে নামার সময় দিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার সঙ্গে কোনো কিছুরই কোনো তুলনা করা যায় না। যে দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাদের এটা জানা থাকা দরকার।

চার 

মাত্র দু মাসের ব্যবধানে মারা গেলেন দেশের আরও দুজন গুণী মানুষ, দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই তো কদিন আগেই, ২৭ নভেম্বর মারা গেলেন অভিনয়শিল্পী আলী যাকের, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি সংবাদ পাঠক। তার অভিনীত অনেকগুলো টেলিভিশন নাটকও অধরা দেখেছে। ২০১৮ সালে দিদার সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমিতে তার ‘গ্যালিলিও’ নাটকটিও দেখেছিল অধরা। অধরার ৭ সেপ্টেম্বর তারিখটিও খুব মনে আছে। করোনাক্রান্ত হয়ে তারিক আলী দাদু চলে গিয়েছিলেন এই দিন। সকালে টেলিভিশনে খবরটি দেখেই দিদা মুষড়ে পড়লেন। অধরার মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারিক আলী দাদুর ছবি দেখাচ্ছিল টিভিতে। সঙ্গে মুক্তির গানের সেই ফুটেজ। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে ট্রাকে করে যাচ্ছেন।

সেদিন মুক্তির গান দেখতে দেখতে দিদা প্রশ্ন করেছিলেন, ধারাভষ্যের গলাটা কার জানো?

তারিক আলী দাদু! অধরা প্রায় চিৎকার করে ঘোষণা করেছিল, সে জানে।

তারিক আলী দাদুর সঙ্গে অধরা দেখাও করেছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। দিদার সঙ্গে সেবার যখন আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গেল, তখন দিদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারিক আলী দাদু কতো আদর করেছিলেন, আর জাদুঘর ঘুরে তার সঙ্গে দেখা করে যেতে বলেছিলেন। সেবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটা অনেক সময় নিয়ে দেখেছিল অধরা। এর আগে স্কুল থেকে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া হয়নি তখন। পুরো জাদুঘরটা ঘুরে অধরার মনটা ভার হয়েছিল। পাকিস্তানিদের নির্যাতন, নৃশংসতার ছবি আর ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অধরা।

গ্যালারিগুলো দেখে লিফটে নিচে নামার সময় দিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার সঙ্গে কোনো কিছুরই কোনো তুলনা করা যায় না। যে দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাদের এটা জানা থাকা দরকার।

ফেরার সময় তারিক আলী দাদুর সঙ্গে দেখা করেছিল দিদা আর অধরা। জাদুঘরের ক্যান্টিন থেকে সিঙারা খাইয়ে বুকশপ থেকে জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন তারিক আলী দাদু। বইয়ে লিখে দিয়েছিলেন, 'উত্তর প্রজন্মের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা দেশ গড়ার জন্য যুদ্ধ করবে’। সেদিন তারিক আলী দাদুর জীবনের নানা সংবাদ যখন দেখাচ্ছিল টেলিভিশনে, তখনও অধরার হাতে ছিল বইটি। 

সেদিন ছিল ২৬ মার্চ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাতেই মারা যান নমিতা দিদা। খবরটি শুনে দিদা প্রায় বিছানা নিয়ে ফেললেন। তার খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

কোভিডের সময়টাতে পরিচিত মানুষের মৃত্যু সংবাদে দিদা ক্রমেই ভেঙে পড়ছেন। অধরার মনে হয়, দিদা বেশি আঘাত পেয়েছিলেন সেদিন, যেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী নমিতা ঘোষ দিদার কোভিডাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবরটি পেলেন। সেদিন ছিল ২৬ মার্চ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাতেই মারা যান নমিতা দিদা। খবরটি শুনে দিদা প্রায় বিছানা নিয়ে ফেললেন। তার খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

মা তখন সব সময় দিদার পাশে পাশে থাকতেন। অফিসের নানা কাজ সামলেও প্রতিবেলা খাবার সময় মা দিদার সঙ্গে বসতেন। মাঝে কয়েকটি দিন তো দিদার শরীরও খারাপ হয়েছিল। বাবা তখন অনলাইনে ওষুধ দিয়েছেন। বাবার আরও দুজন ডাক্তার বন্ধুও দিদাকে দেখেছেন। দিন কয়েক যাবার পর দিদা সুস্থ হয়েছেন বটে, কিন্তু তাকে দেখলেই অধরা বুঝতে পারে, তার আগের হাসিখুশি দিদা যেন আর নেই। নিয়ম করে বাগানের গাছে জল দেওয়া, পাখিদের জন্য ব্যালকনিতে খাবার আর পানি রাখা, মাঝে মাঝে মায়ের নিষেধ ডিঙিয়ে অধরার পছন্দের রান্না করা- সবই চলছে, কিন্তু দিদার সেই স্বভাব হাসিটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

বাবা-মা দুজনেই কেমন চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অধরার চিন্তার চেয়েও বেশি হচ্ছে অভিমান। দিদা কি জানেন না, তার মন খারাপ থাকলে অধরার কিছুই ভালো লাগে না? তবুও মন খারাপ করে বসে থাকবেন দিদা?

দিদা মাঝে মাঝে হেসে বলতেন, আমি ঠিক আছি রে দিদুন। আর কটা দিন যাক, তোকে আবার গল্প শোনাবো।

মা অবশ্য অধরাকে বুঝিয়ে বলেছেন, নমিতা দিদার সঙ্গে দিদার বন্ধুত্বের কথা। একথা অধরাও জানে অবশ্য। নমিতা দিদার জন্য তারও খুব মন খারাপ হচ্ছে। সে যখন আরও ছোটো ছিল, তখন নমিতা দিদার সঙ্গে খুব ভাব ছিল। তিনি অধরাদের বাড়ি এসেছেন অনেকবার। দিদার চেয়ে বয়সে ছোটো হলেও, দিদার খুব ভালো বন্ধু উনি। দিদার কাছেই অধরা শুনেছে, দাদু-দিদা যখন একাত্তরে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে যান, তখন নমিতা দিদার পরিবারও তাদের সঙ্গে ছিল। যুদ্ধের সময় তারা একই আশ্রয়ে থেকেছেন, একসঙ্গে কাজ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে...কতদিনের সখ্য! সত্যিই তো! দিদার মন কী করে ভালো থাকবে?

চলবে... 

আগের পর্ব: হারানো হিয়া, প্রথম কিস্তি