রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, “গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ।”
Published : 27 Jul 2024, 02:42 AM
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মনে করতেন ‘শিল্প, বিজ্ঞান ও বন্ধুত্ব’ হলো এযাবৎ মানুষের পাওয়া সবচেয়ে সুন্দরতম জিনিস। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর (১৮৫৮-১৯৩৭) সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) বন্ধুত্বে এ তিনটিরই যেন সম্মিলন ঘটেছিল।
তাদের সম্পর্কের গোড়াপত্তন ঘটে ১৮৯৬ সালে। জগদীশচন্দ্র সার্থক বৈজ্ঞানিক সফর শেষে দেশে ফিরে এলেন। এক গুচ্ছ ম্যাগনোলিয়া ফুল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে বিজ্ঞানীকে অভিনন্দন জানাতে আসেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বাড়িতে ছিলেন না। তিনি ফুলগুচ্ছ জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে রেখে আসেন। সেই থেকেই রবীন্দ্র-জগদীশের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের শুরু।
বন্ধুত্বের সূত্রপাত প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরে লিখেন- “তখন বয়স অল্প ছিল। সামনের জীবন ভোর বেলাকার মেঘের মত অস্পষ্ট কিন্তু নানা রঙে রঙীন। এমন সময়ে জগদীশের সঙ্গে আমার প্রথম মিলন। তিনিও তখন চূড়ার উপরে ওঠেননি। পূর্ব উদয়াচলের ছায়ার দিকটা থেকেই ঢালু চড়াই পথে যাত্রা করে চলেছেন, কীর্তি-সূর্য আপন সহস্র কিরণ দিয়ে তাঁর সাফল্যকে দীপ্যমান করে তোলেনি। তখনো অনেক বাধা, অনেক সংশয়। কিন্তু নিজের শক্তিস্ফুরণের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের যে আনন্দ সে যেন যৌবনের প্রথম আনন্দের মত আগুনে ভরা, বিশ্বের পীড়নে, দুঃখের তাপে সেই আনন্দকে আরো নিবিড় করে তোলে। প্রবল সুখ-দুঃখের দেবাসুরে মিলে অমৃতের জন্য যখন জগদীশের তরুণ শক্তিকে মন্থন করছিল সেই সময় আমি তার কাছে এসেছি।”
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে ছিলেন, জগদীশচন্দ্র প্রায়ই এখানে আসতেন। তিনি সাধারণত শনিবার আসতেন। সাপ্তাহিক ছুটি কাটিয়ে আবার সোমবার ফিরে যেতেন কলকাতায়। সঙ্গে থাকতেন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী লেডি অবলা বসু।
মৃণালিনী দেবী আর লেডি অবলা বসু মিলে দিনের বেলায় রান্না করতেন নানা রকম তরকারি আর মিষ্টি। সন্ধ্যায় সবাই বোটে চড়ে বসতেন। স্রোতের টানে নৌকা আর সুরের টানে ভেসে চলতো শ্রোতাদের মন। জগদীশচন্দ্রের প্রিয় গানগুলো ফিরে ফিরে গাইতে হতো রবীন্দ্রনাথকে। কখনো লেডি অবলা বসুকে। এসব হতো গরমকালে।
শীতকালে ছিল আরেক বৈচিত্র্য। তখন পদ্মাচরে অস্থায়ী ডেরা গড়ে তুলতেন রবীন্দ্রনাথ। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রান্নার ও স্নানের ঘর তৈরি হতো। বোটে থাকবার জায়গা। এখানে পাচক থাকতেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বাবুর্চি গফুর মিয়া।
বিদেশে জগদীশচন্দ্রের সুখ্যাতির খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ তখন লিখেছেন, “বিজ্ঞানলক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিম মন্দিরে/ দূর সিন্ধুতীরে/ হে বন্ধু গিয়েছো তুমি; জয়মাল্যখানি/ সেথা হতে আনি দীনহীনা জননীর লজ্জানত শিরে/ পরায়েছ ধীরে।”
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে একবার বিদেশে থাকার সময় জগদীশচন্দ্র অর্থকষ্ট পড়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে অর্থসাহায্য করতে ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য বাহাদুরকে জানান। মহারাজা ১৫ হাজার টাকার একটি চেক দিয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ অর্থ সংগ্রহের জন্য চিরকাল কারো কাছে যেতে সংকোচবোধ করতেন। এমনকি বিশ্বভারতীর জন্যও তিনি অর্থভিক্ষা করতে পারতেন না।
এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, “কেবল জগদীশবাবুর কার্যে আমি মান অপমান অভিমান কিছুই মনে স্থানে দিতে পারি না। লোকে আমাকে যাহাই বলুক এবং যত বাধাই পাই না কেন, তাহাকে বন্ধনমুক্ত ভারমুক্ত করিতে পারিলে আমি কৃতার্থ হইব। ইহা কেবল বন্ধুত্বের কার্য নহে, স্বদেশের কার্য। আমি ধনীর পুত্র, কিন্তু ধনী নহি (দুর্ভাগ্যক্রমে পরের অবিবেচনাদোষে ঋণজালে আপাদমস্তক জড়িত)। অন্তরে ঈশ্বর যে সকল শুভ সংকল্প প্রেরণ করেন তাহা সাধনের ক্ষমতা আমার হাতে দেন নাই। সুতরাং শুভকর্মের অন্তরায়স্বরূপ সমস্ত অভিমানকে বিসর্জন দেওয়াই আমার কর্তব্য। জগদীশবাবুর জন্য তাহাই দিব।”
রবীন্দ্রনাথ তার ‘কথা’ কবিতাবই জগদীশচন্দ্রকে উৎসর্গ করে লিখেন, “সত্যরত্ন তুমি দিলে, পরিবর্তে তার/ কথা ও কল্পনা মাত্র দিনু উপহার।” জগদীশচন্দ্রও তার ‘অব্যক্ত’ বইটি রবীন্দ্রনাথকে উপহার দিতে গিয়ে লিখেন, “তাঁর এ অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য রচনা অনেকটা যেনো বিশাল দীপ্তিমান সূর্যের (রবি) কাছে খদ্যোতের ক্ষীণ আলোক শিখার মতো।” রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তরে মন্তব্য করেন, “বিজ্ঞানের জন্য জগদীশ দেবী সরস্বতীকে অবহেলা না করিলে দেবীই তাঁর প্রথমা প্রিয়া হতেন।”
দুই বন্ধুর মধ্যে সাহিত্য, দর্শন, সংগ্রাম ও কর্মপ্রয়াস বিষয়ে বহু পত্র বিনিময় হয়। সেসব পত্র আমাদের সাহিত্যের মূল্যবান সংযোজন। ১৯২৮ সালে জগদীশচন্দ্রের সত্তর বছর বয়স পূর্ণ হয়। সত্তর বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে সে বছরই পহেলা ডিসেম্বর তার জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এ উপলক্ষ্যে ঠাকুর একটি অভিনন্দন বাণী লিখেন। অভিনন্দন হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ কবিতা। কবিতার কিছু অংশ- “তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে দিগন্তরে/ সমুদ্রের এ কূলে ও কূলে; আপন দীপ্তিতে আজি/ বন্ধু তুমি দীপ্যমান, উচ্ছ্বসি উঠিছে বাজি/ বিপুল কীর্তির মন্ত্র তোমার আপন কর্ম মাঝে।/ জ্যোতিষ্ক সভার তলে যেথা তব আসন বিরাজে/ সেথায় সহস্র দীপ জ্বলে আজি দীপালী উৎসবে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, “গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ।”
তথ্যসূত্র
১. বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র, তপন চক্রবর্তী, অবসর প্রকাশনী।
২. রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্র বসুর পত্রাবলী, সম্পাদক: এ. এম. হারুন-অর-রশীদ, বাংলা একাডেমি।