কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে যাই। দরজা খুলে দেখি বাবার হাতে একটি বাক্স।
Published : 10 Aug 2023, 01:41 PM
আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। তখন থেকেই বিড়াল ভীষণ ভয় পেতাম। বাড়ির পাশেই ছিল অনেকগুলো বিড়ালছানা। আমার খুব ইচ্ছে করতো ওদের কাছে যেতে, আদর করতে। কিন্তু এত ভয় পেতাম যে ওদের কাছেও যেতে পারতাম না।
বিড়াল ভয় পাওয়া সত্ত্বেও একবার বিড়াল পোষার প্রবল ইচ্ছা হয় আমার। কেন? স্কুলে আমার এক বন্ধু একটা পারশিয়ান বিড়াল কেনে এবং ওই বিড়াল নিয়ে নানা গল্প করত। সেই থেকে বিড়ালের প্রতি ভয় কমতে থাকে। তারপর সিদ্ধান্ত নিই আমিও একটা বিড়াল পুষবো। যে কিনা আমার বন্ধু হবে, যার সঙ্গে আমি সারাদিন খেলাধুলা করবো, গল্প করবো, আরো কত কী!
বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা জানাই। বাবা প্রথমে রাজি হন না। নানাভাবে বুঝিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বাবাকে রাজি করিয়ে ফেললাম। কিন্তু বিড়াল কবে কিনে দেবে সে বিষয়ে কিছুই বলে না বাবা। একদিন দুপুরবেলা। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাবা-মা ঘরে নেই। কোথায় গেল তারা? দিদা হেসে বলল, তোমার জন্য বিড়াল আনতে গিয়েছে।
শুনে আমার সেকি আনন্দ! মনে মনে ভাবি নানা কিছু। বিড়ালটা কেমন হবে? ও কি ডাকলেই আমার কাছে দৌড়ে আসবে? ও আমার বন্ধু হবে তো? আমার হাতে খাবার খাবে তো? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনে! গোসল সেরে একদম পরিপাটি হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কখন বিড়ালছানা নিয়ে আসবে বাবা-মা?
কিছুক্ষণ পরই কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে যাই। দরজা খুলে দেখি বাবার হাতে একটি বাক্স, যার ভেতর থেকে মিউমিউ শব্দ আসছে। বাক্সটা খুলে বিড়ালছানাটিকে দেখি, কোলে নেওয়ার চেষ্টা করি। ওর বয়স তখন দেড় মাস।
প্রথম প্রথম ও খুব ভয় পেত। আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে আপন হয়ে ওঠে সে। কিন্তু বিড়ালছানাটির তো একটা নাম দেওয়া প্রয়োজন। বড় বোন পৃথা আপুর সঙ্গে আলাপ করে ওর নাম রাখলাম ‘টুনটুন’। এভাবে ভয় কেটে গিয়ে বিড়ালের জন্য আমার ভালোবাসা তৈরি হয়। তখন থেকে রাস্তায় কাউকে কোন বিড়াল বা কুকুর মারতে দেখলেই আমরা প্রতিবাদ করতে থাকি।
বাবা বলেন, ‘টুনটুন যেহেতু এ বাসায় আছে তাই পরিবারের সদস্যের মতো তার চিকিৎসার দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে।’
টুনটুন অন্যান্য বিড়ালের চেয়ে একদম আলাদা। তার দুটো চোখ দুরকম। একটা নীল, আরেকটা বাদামি। কেলিকো জাতের বিড়াল সে। টুনটুন আমাকে দেখলে খুব মিষ্টি করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে মিউ মিউ করে ডাকে! ওর সঙ্গে সময় কাটাতে, খেলতে, গল্প করতে আমার খুবই ভলো লাগে। সময় পেলেই ওর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিই, আর ও চোখ দুটো বন্ধ করে গরগর আওয়াজ করতে থাকে। সেটা বেশ উপভোগ করতাম!
এভাবে টুনটুন আমাদের সবারই প্রিয় হয়ে উঠল। টুনটুনের সঙ্গে আমার সময়টাও ভালোই কাটছিলো! টুনটুনের বয়স তখন দুই মাস। আমরা লক্ষ্য করলাম বয়স অনুযায়ী সে বড় হচ্ছে না। একদিন মধ্যরাতে ঘটল এক ঘটনা। হঠাৎ টুনটুনের পায়ে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়। ও কান্না করছিল। ওর কান্নায় আমিও কাঁদছি। কিন্তু এত রাতে ওকে নিয়ে কোথায় যাব?
বাবা-মা মধ্যরাতেই ছুটলেন এক ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকে পাওয়া গেল। ডাক্তার টুনটুনকে দেখামাত্র বলে দিলেন, ও নাকি বড় হবে না, নানা শারীরিক সমস্যা হবে, ও নাকি একটা বামন বিড়াল। কথাটা শুনে আমরা কেউই মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপর থেকে যতদিন যাচ্ছিলো ততই টুনটুনের শরীরে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হচ্ছিলো। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হতো। তার চিকিৎসার ব্যয়ও ছিল বেশি। তবুও আমরা টুনটুনের ভাল থাকার আশায় চিকিৎসা চালিয়ে গিয়েছি।
কিন্তু ছোট্ট টুনটুন খুব কষ্ট করেই বড় হতে থাকল। টুনটুনের বয়স এখন সাত মাস। ওর দুই পা-ই প্যারালাইজড হয়ে গেছে, ও এখন একদমই হাঁটতে পারে না। ওর পা-টিও নিজে নাড়াতে পারে না। সময় ভেদে আমরাই ওকে পটি করাতে সাহায্য করি। নিজে তেমন খেতেও পারে না। আমি আর মা মিলে ওকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছি।
রাতে উঠেও দেখতে হয় টুনটুন ঠিক আছে কিনা। কষ্ট হলেও টুনটুনের জন্য আমরা সেটা করছি এবং ওর পাশে আমরা থাকব। বাবা বলেন, ‘টুনটুন যেহেতু এ বাসায় আছে তাই পরিবারের সদস্যের মতো তার চিকিৎসার দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে।’
কিন্তু আমার টুনটুনকে তো এভাবে দেখতে ভালো লাগে না। ওর তো জীবন আছে। কিন্তু সে তো তার শারীরিক কষ্টের কথাগুলোও বলতে পারছে না। টুনটুনের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে খেলা, দৌড়াদৌড়ি করা এগুলো আমি খুব মিস করি! তার না বলা চোখের চাওয়া আমাকে খুব দুর্বল করে দেয়। টুনটুন তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা, আমাদের আবার একসঙ্গে ফুটবল খেলতে হবে তো! তোর জন্য আমার অসীম ভালোবাসা।
[লেখাটি কিডজ ঈদ সংখ্যা ২০২৩ এর ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত]